“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” কবিতার অংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ-কাব্যে’র ষষ্ঠ সর্গ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে তাদের সম্পর্ক, দেশপ্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৈতিকতার প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে। এই পোস্টে বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।
Table of Contents
বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতার মূলভাব
“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” অংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ-কাব্য” এর ষষ্ঠ সর্গ থেকে নেওয়া। এখানে মেঘনাদ, যিনি রাবণের পুত্র, তার পিতৃব্য (চাচা) বিভীষণের প্রতি অত্যন্ত হতাশ এবং ক্রুদ্ধ অবস্থায় কথা বলেন।
“বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” অংশে মেঘনাদ গভীর রাগ ও দুঃখ নিয়ে তার পিতৃব্য বিভীষণের সঙ্গে কথা বলে। সে জানায়, তার শত্রু লক্ষ্মণ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ঢুকে পড়েছে, যা তার কাছে চরম অপমানের বিষয়। মেঘনাদ মনে করে, এই ঘটনার পেছনে বিভীষণের দায় রয়েছে। সে প্রশ্ন তোলে, যে নিজের ধর্মস্থান ও ঘর রক্ষা করতে পারে না, সে কীভাবে ন্যায়ের কথা বলতে পারে। মেঘনাদ বিভীষণের রামচন্দ্রের পক্ষে যাওয়াকে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দেয়। তার মতে, নিজের দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। সে স্পষ্ট করে বলে, রাম বা লক্ষ্মণের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা নেই। মেঘনাদের কাছে রাবণ ও রাক্ষস জাতির সম্মানই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সে মনে করে, বিভীষণ নিজের ভাই, জাতি ও মাতৃভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ধর্মের নাম করে শত্রুকে সমর্থন করাকে সে ভণ্ডামি বলে মনে করে। বিভীষণ যখন নিজেকে রামের দাস বলে পরিচয় দেয়, তখন মেঘনাদ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সে এটাকে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ বলে মনে করে। মেঘনাদের কথায় তার প্রবল দেশপ্রেম ফুটে ওঠে। একই সঙ্গে শত্রুর প্রতি তার তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায়। এই অংশে রাক্ষসদের ভেতরের দ্বন্দ্বও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। মেঘনাদ জাতির ঐক্যের গুরুত্ব বোঝাতে চায়। সে বিভীষণকে নিজের অবস্থান বদলানোর আহ্বান জানায়। সব মিলিয়ে, এই অংশে মেঘনাদের দেশপ্রেম, আত্মসম্মান ও ক্ষোভ গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতার ব্যাখ্যা
“এতক্ষণে”— অরিন্দম কহিলা বিষাদে—
এতক্ষণ পরে মেঘনাদ (যাকে এখানে অরিন্দম বলা হয়েছে) খুব দুঃখ, বিস্ময় ও হতাশা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। এত বড় বিপদ ঘটে যাওয়ার পর সে অবশেষে বুঝতে পারছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা।
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল / রক্ষঃপুরে।”
মেঘনাদ বলছে, সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না লক্ষ্মণ কীভাবে রাক্ষসদের নগরে, অর্থাৎ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ঢুকে পড়ল। এই জায়গাটি ছিল খুব সুরক্ষিত, সেখানে শত্রুর ঢোকা প্রায় অসম্ভব ছিল।
“হায়, তাত, উচিত কি তব / এ কাজ,”
মেঘনাদ বিভীষণকে ‘তাত’ (পিতৃব্য বা চাচা) বলে ডেকে গভীর আক্ষেপের সঙ্গে প্রশ্ন করছে, আপনার পক্ষে কি এই কাজ করা ঠিক হয়েছে? আপনি কি এটা করেই ঠিক কাজ করেছেন?
“নিকষা সতী তোমার জননী”
সে বিভীষণকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, আপনার মা নিকষা ছিলেন একজন সতী ও মহীয়সী নারী। এমন মহৎ মায়ের সন্তান হয়ে আপনি কীভাবে শত্রুকে সাহায্য করতে পারেন?
“সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ?”
মেঘনাদ বিস্ময় ও ক্ষোভের সঙ্গে বিভীষণকে প্রশ্ন করছে, আপনি কি আপনার নিজের সহোদর, রাক্ষসকুলের শ্রেষ্ঠ রাবণের কথা একবারও ভাবলেন না? নিজের ভাইয়ের বিপদ কি আপনার চোখে পড়ল না?
“শূলিশম্ভুনিভ কুম্ভকর্ণ?”
সে আরও বলে, আপনি কি শূলধারী শিবের মতো শক্তিশালী ও ভয়ংকর কুম্ভকর্ণের কথাও ভুলে গেলেন? এত বড় বীর ভাইদের কথা কি আপনার মনে একবারও এল না?
“ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী।”
মেঘনাদ নিজেকেই ইঙ্গিত করে বলছে, আমি তো আপনার ভাইয়ের পুত্র, যে দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করেছে। এমন একজন বীর ভ্রাতৃ-পুত্রের কথা ভেবে কি আপনার হৃদয় কাঁপেনি?
“নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?”
মেঘনাদ অত্যন্ত তীব্র ভাষায় প্রশ্ন করছে, চাচা, আপনি কি নিজের ঘরের পথ একজন চোরের মতো শত্রুকে দেখিয়ে দিলেন?
“চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?”
সে আরও তীব্রভাবে বলে, একজন ঘৃণ্য চণ্ডালের মতো শত্রুকে কি আপনি রাজপ্রাসাদে এনে বসালেন? এতে কি রাক্ষসকুলের মান-সম্মান ধুলায় মিশে গেল না?
“কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি / পিতৃতুল্য।”
মেঘনাদ বলছে, আপনার কাজে সে খুব কষ্ট পেলেও আপনাকে সে তিরস্কার করছে না, কারণ আপনি তার গুরুজন এবং পিতার মতো সম্মানীয় ব্যক্তি। বয়স ও সম্পর্কের কারণে সে আপনাকে সম্মান দিতে চায়।
“ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,”
মেঘনাদ অনুরোধের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে বলছে, আপনি দরজাটা ছেড়ে দিন, আমি অস্ত্রাগারে যাব। অর্থাৎ, এখন আর কথা নয়, সে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে চায়।
“পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,”
সে দৃপ্ত কণ্ঠে জানায়, রামের ভাই লক্ষ্মণকে সে যমের ঘরে পাঠাবে, অর্থাৎ যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করবে। এখানে মেঘনাদের আত্মবিশ্বাস ও যুদ্ধউন্মাদনা স্পষ্ট।
“লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।”
মেঘনাদ বলে, আজ যুদ্ধের মাধ্যমে সে লঙ্কার এই অপমান ও কলঙ্ক মুছে ফেলবে। শত্রুর আক্রমণে যে লজ্জা এসেছে, তা রক্তের বদলে মুছে ফেলাই তার লক্ষ্য।
“উত্তরিলা বিভীষণ, ‘বৃথা এ সাধনা, / ধীমান।’”
এখানে বিভীষণ মেঘনাদের কথার জবাব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, হে বুদ্ধিমান মেঘনাদ, এই চেষ্টা সম্পূর্ণ বৃথা। অর্থাৎ, যুদ্ধ বা প্রতিশোধের কথা বলে এখন কোনো লাভ হবে না।
“রাঘবদাস আমি; কী প্রকারে / তাঁহার বিপক্ষ কাজ করিব,”
বিভীষণ স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, তিনি রামচন্দ্রের দাস বা ভক্ত। তাই তিনি কখনোই রামের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে পারেন না।
“রক্ষিতে অনুরোধ?”
তিনি প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলেন, যাকে তিনি আশ্রয় ও ভক্তি দিয়ে মান্য করেন, তার বিরোধিতা করে কাউকে রক্ষা করা তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব? অর্থাৎ, মেঘনাদকে তিনি সাহায্য করতে পারবেন না।
“উত্তরিলা কাতরে রাবণি;—”
এতে মেঘনাদ অত্যন্ত কাতর ও ব্যথিত হয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে। এখানে বোঝা যায়, বিভীষণের উত্তর মেঘনাদের মনে গভীর আঘাত দিয়েছে।
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে!”
মেঘনাদ বিভীষণকে পিতৃব্য (চাচা) বলে সম্বোধন করে বলছে, তোমার এই কথা শুনে আমার বাঁচার ইচ্ছাই চলে যাচ্ছে। এত কষ্ট আর অপমান সে সহ্য করতে পারছে না।
“রাঘবের দাস তুমি?”
মেঘনাদ বিস্ময় ও তীব্র ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করছে, তুমি কি সত্যিই রামচন্দ্রের দাস? এই কথা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না।
“কেমনে ও মুখে আনিলে এ কথা, তাত, কহ তা দাসেরে।”
সে আরও বলে, চাচা, তুমি কীভাবে এই মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে দাস বলে পরিচয় দিতে পারলে? এই কথা বলতে তোমার লজ্জা হলো না?
“স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থাণুর ললাটে:”
এখানে উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। মেঘনাদ বলছে, যেমন বিধাতা নিশ্চল আকাশে চাঁদকে স্থির করে বসিয়েছেন, তেমনি বিভীষণের এই কথা তার মাথায় বজ্রাঘাতের মতো লেগেছে।
“পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি / ধূলায়?”
মেঘনাদ প্রশ্ন করছে, চাঁদ কি কখনো আকাশ থেকে পড়ে মাটির ধুলোয় গড়াগড়ি খায়? অর্থাৎ, মহান কিছু কি কখনো নিজেকে এত নিচে নামায়?
“হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে / কে তুমি?”
সে বিভীষণকে প্রশ্ন করে, হে রাক্ষসকুলের বীর, তুমি কি ভুলে গেছ তুমি আসলে কে?
“জনম তব কোন মহাকুলে?”
মেঘনাদ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তোমার জন্ম তো কোনো সাধারণ ঘরে হয়নি, তুমি জন্মেছ এক মহান রাক্ষস বংশে।
“কে বা সে অধম রাম?”
রাগ ও ঘৃণার সঙ্গে সে বলে, রাম আসলে কে? আমাদের তুলনায় সে তো একজন তুচ্ছ মানুষ মাত্র।
“স্বচ্ছ সরোবরে / করে কেলি রাজহংস পঙ্কজ-কাননে;”
মেঘনাদ উপমা দিয়ে বলছে, রাজহাঁস যেমন স্বচ্ছ জলে ভরা পদ্মবনে আনন্দ করে থাকে।
“যায় কি সে কভু, প্রভু, পঙ্কিল সলিলে, / শৈবালদলের ধাম?”
সে প্রশ্ন করে, রাজহাঁস কি কখনো কাদা আর শেওলায় ভরা নোংরা জলে যায়? কখনোই না।
“মৃগেন্দ্র কেশরী,”
এখানে রাক্ষসদের তুলনা করা হয়েছে সিংহের সঙ্গে, শক্তিশালী ও সাহসী।
“কবে, হে বীরকেশরী, সম্ভাষে শৃগালে / মিত্রভাবে?”
সে আবার উপমা দেয়, সিংহ কি কখনো শেয়ালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে? না।
“অজ্ঞ দাস, বিজ্ঞতম তুমি,”
মেঘনাদ বিদ্রূপ করে বলে, তুমি নিজেকে অজ্ঞ দাস বলছ, অথচ তুমি সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষদের একজন।
“অবিদিত নহে কিছু তোমার চরণে।”
সে বলে, তোমার জ্ঞানের কাছে কিছুই অজানা নয়। তাই এই আচরণ তোমার কাছ থেকে সে আশা করেনি।
“ক্ষুদ্রমতি নর, শুর, লক্ষ্মণ;”
মেঘনাদ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলছে, লক্ষ্মণ তো এক সাধারণ বুদ্ধির মানুষ, কোনো মহান বীর নয়।
“নহিলে অস্ত্রহীন যোধে কি সে সম্বোধে সংগ্রামে?”
সে প্রশ্ন করছে, যখন আমি অস্ত্রহীন অবস্থায় যজ্ঞে ব্যস্ত, তখন কি এভাবে যুদ্ধ করা বীরের কাজ? এটি কি ন্যায্য যুদ্ধ?
“কহ, মহারথী, এ কি মহারথী-প্রথা?”
মেঘনাদ বিভীষণকে জিজ্ঞেস করছে, হে মহান যোদ্ধা, এ কি সত্যিই বীরদের যুদ্ধের নিয়ম?
“নাহি শিশু লঙ্কাপুরে, শুনি না হাসিবে এ কথা!”
সে ব্যঙ্গ করে বলছে, লঙ্কায় এমন কোনো শিশুও নেই যে এই কথা শুনে হাসবে না, কারণ এটা সম্পূর্ণ অন্যায়।
“ছাড়হ পথ; আসিব ফিরিয়া এখনি!”
মেঘনাদ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, পথ ছেড়ে দাও, আমি এখনই ফিরে আসছি।
“দেখিব আজি, কোন্ দেববলে,”
সে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, আজই দেখা যাবে, কোন দেবতার শক্তিতে লক্ষ্মণ দাঁড়িয়ে আছে।
“বিমুখে সমরে মোরে সৌমিত্রি কুমতি!”
সে বলে, এই মূর্খ সৌমিত্রি কি সত্যিই যুদ্ধে আমার মুখোমুখি হতে পারে?
“দেব-দৈত্য-নর-রণে, স্বচক্ষে দেখেছ,”
মেঘনাদ বলছে, দেবতা, দৈত্য ও মানুষের সঙ্গে যত যুদ্ধ হয়েছে, সেসব যুদ্ধে তুমি নিজের চোখেই আমার বীরত্ব দেখেছ।
“রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, পরাক্রম দাসের!”
হে রাক্ষসকুলের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, তুমি জানো আমার শক্তি ও সাহস কতটা প্রবল।
“কী দেখি / ডরিবে এ দাস হেন দুর্বল মানবে?”
সে প্রশ্ন করে, এমন দুর্বল মানুষ লক্ষ্মণকে দেখে আমি কি ভয় পাব? এটা কি সম্ভব?
“নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রগলভে পশিল / দন্তী;”
মেঘনাদ অভিযোগ করছে, অত্যন্ত দম্ভের সঙ্গে সেই উদ্ধত লোক (লক্ষ্মণ) নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ঢুকে পড়েছে।
“আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি নরাধমে।”
সে অনুরোধের সুরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলে, আমাকে আদেশ দাও, আমি সেই অধম মানুষকে উপযুক্ত শাস্তি দেব।
“তব জন্মপুরে, তাত, পদার্পণ করে / বনবাসী!”
মেঘনাদ ক্ষোভের সঙ্গে বলছে হে চাচা, এক বনবাসী মানুষ (রাম/লক্ষ্মণ) তোমার জন্মভূমি লঙ্কায় পা রাখার সাহস কীভাবে পেল?
“হে বিধাতঃ, নন্দন-কাননে / ভ্রমে দুরাচার দৈত্য?”
সে ঈশ্বরকে প্রশ্ন করছে, স্বর্গের সুন্দর উদ্যানে কি কখনো কোনো দুষ্ট দৈত্য ঘোরে? অর্থাৎ, এমন জায়গায় অযোগ্য কেউ ঢুকতে পারে না।
“প্রফুল্ল কমলে / কীটবাস?”
সে আরও উপমা দেয়, ফুলে ফোটা পদ্মে কি কখনো পোকা বাস করে? না, কখনোই না।
“কহ তাত, সহিব কেমনে / হেন অপমান আমি, ভ্রাতৃ-পুত্র তব?”
মেঘনাদ বলে চাচা, তোমার ভাইয়ের ছেলে হয়ে আমি এই অপমান কীভাবে সহ্য করব?
“তুমিও, হে রক্ষোমণি, সহিছ কেমনে?”
সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তুমি নিজে কীভাবে এই অপমান সহ্য করছ, হে রাক্ষসকুলের রত্ন?
মহামন্ত্র-বলে যথা নম্রশিরঃ ফণী,
মলিনবদন লাজে, উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে;-
“নহি দোষী আমি, বৎস। বৃথা ভর্ৎস মোরে
তুমি! নিজ কর্ম-দোষে, হায়, মজাইলা
এ কনক-লঙ্কা রাজা, মজিলা আপনি!
বিরত সতত পাপে দেবকুল; এবে
পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!
মেঘনাদ ক্ষোভ ও আক্ষেপের সঙ্গে বলে, যেমন এক মহামন্ত্র বলার সময় বিনম্রভাবে মাথা নত করে, তেমনি আমি, রাবণের ছোট ভাই বিভীষণকে বলছি, “হে শিশু, দোষ আমার নয়। তুমি বৃথা আমাকে তিরস্কার করছ। সব দায় আমার নয়, বরং তোমার নিজের ভুল ও কাজের ফল।”
তিনি আরও বলেন হে চাচা, তুমি এতক্ষণ যে অশোভন আচরণ করেছ, তা লঙ্কার রাজা হিসেবে ঠিক নয়। তুমি নিজে ভুলে চলেছ, আর দোষ অন্যের ওপর চাপাচ্ছ। এখন লঙ্কাপুরী পাপে পূর্ণ হয়ে গেছে। যেমন একটি প্রলয়ের সময় পৃথিবী ডুবে যায়, ঠিক তেমনি এখন লঙ্কা বিপদের জলে ভেসে যাচ্ছে।
মেঘনাদ এখানে নিজের দোষ নয় বলে পরিষ্কার করছে। তিনি বিভীষণকে বোঝাচ্ছেন, যে লঙ্কার বিপদ এবং অশান্তির মূল কারণ এখন তাদের নিজেদের কর্ম ও ভুল, শত্রুদের কারণে নয়। তাঁর বক্তব্যে নিজের দেশ ও পরিবারের প্রতি দায়বোধ এবং বিভীষণের অবহেলার জন্য ক্ষোভ ফুটে উঠেছে।
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেই আমি। পরদোষে কে চাহে মজিতে?”
রুষিলা বাসবত্রাস। গম্ভীরে যেমতি
নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমুতেন্দ্র কোপি,
কহিলা বীরেন্দ্র বলী,- “ধর্মপথগামী,
হে রাক্ষসরাজানুজ, বিখ্যাত জগতে
মেঘনাদ বলছে, “আমি রামচন্দ্রের পদের আশ্রয়ে লঙ্কা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছি। আমি কোনো অন্যায় বা পরদোষে লাঞ্ছিত হইনি, তাই অন্য কেউ আমার ওপর দোষ চাপাতে পারবে না।”
এরপর তিনি রুষ হয়ে, গভীর গম্ভীর কণ্ঠে, নিশীথের অন্ধকারে যেমন বজ্রপাত বা বীর শিরোমণির মত আওয়াজ করেন, ঠিক তেমনভাবে বলেন, “হে রাক্ষসরাজানুজ (রাবণের ছেলে), তুমি পৃথিবীতে বিখ্যাত, তবে তুমি কি ঠিক পথে চলছ?”
এখানে মেঘনাদের কথা থেকে বোঝা যায়, তিনি ধর্ম ও ন্যায়ের পথে অটল থেকে, সাহসী ও পরাক্রমী রূপে লঙ্কা রক্ষার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তিনি বিভীষণকে সতর্ক করছেন, যে যুদ্ধের সময় সততা, ধর্মপথ এবং জাতি-পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
মোটকথা, মেঘনাদ নিজের সাহস ও ন্যায়বোধ প্রকাশ করছেন এবং অন্যকে (বিভীষণকে) সঠিক পথে চলার জন্য জোরালোভাবে স্মরণ করাচ্ছেন।
তুমি; কোন্ ধর্ম মতে, কহ দাসে, শুনি,
জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি, এ সকলে দিলা
জলাঞ্জলি? শাস্ত্রে বলে, গুণবান্ যদি
পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি
নির্গুণ স্বজন শ্রেয়ঃ, পরঃ পরঃ সদা!
এ শিক্ষা, হে রক্ষোবর, কোথায় শিখিলে?
কিন্তু বৃথা গঞ্জি তোমা! হেন সহবাসে,
হে পিতৃব্য, বর্বরতা কেন না শিখিবে?
গতি যার নীচসহ, নীচ সে দুর্মতি।”
মেঘনাদ তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বিভীষণকে প্রশ্ন করছে, তুমি কোন ধর্মের কথা বলছ, তা আমাকে বোঝাও। কোন ধর্ম অনুযায়ী তুমি আত্মীয়তার সম্পর্ক, ভাইয়ের সম্পর্ক আর নিজের জাতিকে একসঙ্গে ত্যাগ করতে পারলে? সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, শাস্ত্রে তো স্পষ্ট বলা আছে। যদি বাইরের মানুষ গুণবানও হয়, আর নিজের মানুষ গুণহীন হয়, তবু নিজের মানুষই শ্রেয়; কারণ পর মানুষ চিরকাল পরই থাকে।
মেঘনাদ জানতে চায়, হে রাক্ষসশ্রেষ্ঠ, তুমি এই শিক্ষা কোথায় শিখলে? কোন ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে যে নিজের জাতি ও পরিবার ছেড়ে শত্রুর দাসত্ব করতে হবে? তারপর সে বলে, আমি আর তোমাকে তিরস্কার করব না, কারণ তোমার সঙ্গে এমন লোকদের বাস, যাদের মধ্যে বর্বরতা আছে—সেই সংসর্গে থেকে তুমি বর্বরতাই শিখেছ।
সবশেষে মেঘনাদ কঠোরভাবে বলে, যার চলার পথ নীচ মানুষের সঙ্গে, সে নিজেও নীচ ও দুর্মতি হয়ে যায়। এখানে মেঘনাদ স্পষ্টভাবে বিভীষণকে দেশদ্রোহী, জাতিভ্রষ্ট এবং নৈতিকভাবে অধঃপতিত বলে অভিযুক্ত করছে।
আরও পড়ুনঃ বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ MCQ | বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর
আরও পড়ুনঃ বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর