প্রমথ চৌধুরী তাঁর “সাহিত্যে খেলা” প্রবন্ধে বলেন, সাহিত্য কোনো উচ্চাভিলাষ বা শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যম নয়, বরং এটি এক ধরনের নিঃস্বার্থ খেলা। এই পোস্টে সাহিত্যে খেলা প্রবন্ধের মূলভাব ও সম্পূর্ণ প্রবন্ধ সহজ ভাষায় লিখে দিলাম।
Table of Contents
সাহিত্যে খেলা প্রবন্ধের মূলভাব
প্রমথ চৌধুরী তাঁর “সাহিত্যে খেলা” প্রবন্ধে সাহিত্যের একটি মৌলিক ও সৌন্দর্যময় দিক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, সাহিত্য কোনো বড় উদ্দেশ্য বা গুরুদায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি নিঃস্বার্থ ও আনন্দদায়ক খেলা, ঠিক যেমন একটি শিশু কোনো ফলাফলের চিন্তা না করে শুধু খেলার আনন্দেই মগ্ন থাকে। মহান শিল্পীরা, যেমন ভাস্কর রোদ্যাঁ, তাঁর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের পাশাপাশি কাদার পুতুল গড়াকেও খেলা হিসেবে উপভোগ করতেন। লেখালেখির ক্ষেত্রেও এই মনোভাব থাকা দরকার। এটা যেন কারো মন জয় করা বা সমাজে শিক্ষা ছড়ানোর একটি ভারী হাতিয়ার না হয়ে ওঠে। যখন লেখক শুধু পাঠককে খুশি করতে বা বিক্রি বাড়াতে লেখেন, তখন সাহিত্য সস্তা খেলনায় পরিণত হয়, যা কিছুক্ষণের জন্য চোখ জুড়ালেও স্থায়ী মূল্য রাখে না। আবার, সাহিত্যকে কখনও স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মতো শুকনো তথ্য বা নীতিশিক্ষার মাধ্যম বানানো উচিত নয়, কারণ এর আসল কাজ হলো গল্প, ছন্দ ও ভাষার মাধ্যমে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা এবং ভাবনার জগৎকে প্রসারিত করা। লেখকের উচিত নিজের অভিব্যক্তি ও সৃষ্টির আনন্দকে প্রাধান্য দেওয়া, বাহ্যিক স্বীকৃতি বা লাভের দিকে না তাকানো। কারণ, এই স্বতঃস্ফূর্ত খেলার মধ্য দিয়েই সাহিত্য শাশ্বত হয়ে ওঠে এবং সব বাধা-নিয়ম ছাড়িয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি আনন্দের জগৎ তৈরি করে।
সাহিত্যে খেলা প্রবন্ধ সহজ ভাষায়
জগদ্বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর রোদ্যাঁ, যিনি পাথরে থেকে জীবন্ত দেবদানবের মূর্তি বের করে আনতে পারেন, তিনিও সময় পেলে কাদা মেখে ছোট ছোট পুতুল বানাতে ভালোবাসেন। এটাই তাঁর খেলা। শুধু রোদ্যাঁ নন, পৃথিবীর সব শিল্পীই তাদের শিল্পকে এক ধরনের খেলা হিসেবে উপভোগ করেন। যিনি গড়তে জানেন, তিনি মহাদেবও গড়তে পারেন, একটা বাঁদরও গড়তে পারেন। আমাদের সাথে বড় শিল্পীদের পার্থক্য হলো তাদের হাতে কোনোটাই ‘ছোট’ বা ‘খেলো’ হয়ে ওঠে না। হয়তো এজন্যই মহান শিল্পীরা ইচ্ছেমতো সব কিছু গড়ার স্বাধীনতা পান, কিন্তু সাধারণ শিল্পীরা তা পান না। স্বর্গ থেকে দেবতা পৃথিবীতে নামলে কেউ আপত্তি করে না, কিন্তু মানুষ যদি নিচের দিকে নামতে চায়, তাকে দোষ দেয়া হয়। কিন্তু সত্যি কথা হলো, মানুষের মন স্বভাবতই সব দিকে যেতে চায় উঁচুতেও, নিচুতেও। বরং সাধারণ মানুষের মন নিজের স্বাভাবিক অবস্থানেই ঘুরপাক খেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, ওঠাতেও চায় না, নামতেও চায় না।
কিন্তু মানুষকে সব সময় উঁচুতে থাকার উপদেশই দেয়া হয় ধর্মে, নীতিতে, সাহিত্যে সব জায়গায়। বলা হয়, উঁচুতে না উঠলে দর্শক বা শ্রোতা আকৃষ্ট হয় না। মঞ্চে না বসলে কথার মূল্য পায় না, রঙ্গমঞ্চে না উঠলে কেউ অভিনয় দেখে না, মঞ্চে দাঁড়ালে তবেই বক্তৃতা শোনে। তাই জনপ্রিয় হওয়ার লোভে আমরাও সব সময় উঁচু মঞ্চে থাকতে চাই, কিন্তু পারি না। অনেকে উঁচুতে ওঠার চেষ্টায় আরও নিচে পড়ে যায়।
আসল কথা হলো, আমাদেরও উঁচু লক্ষ্য অনুসরণ করাই উচিত। কিন্তু পাশাপাশি ছোটখাটো গলিতে, সাধারণ বিষয়েও ‘খেলার’ মতো করে প্রবেশ করার অধিকার আমাদের থাকা দরকার। গান গাইতে গেলেই সব সময় উচ্চ সুরে গাইতে হবে, কবিতা লিখলেই গভীর দার্শনিক ভাব প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো নিয়ম হওয়া উচিত নয়। শিল্পের জগতে খেলার অধিকার সবার সমান। বলা যায়, খেলার মাঠেই একমাত্র ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ভেদাভেদ থাকে না। রাখালের ছেলেরাও সেখানে খেলতে পারে।
আমরা যদি সাহিত্যকে শুধু ‘খেলা’ হিসেবেই নিই, তাতেই আমরা বড় লেখকদের কাতারে মিশে যেতে পারব। কিন্তু সেখানে যদি বড় কিছু পাওয়ার আশা নিয়ে যাই, তবে নিচু স্তরেই পড়ে থাকব। লেখকেরা অবশ্য পাঠকের প্রশংসা চান, তালি না পেলে মন খারাপ করেন। কারণ কবি-লেখরাই আসল সামাজিক মানুষ তাদের কাজই হলো বিশ্বের মানুষের মনে নিজেকে যুক্ত করা। কিন্তু উচ্চ মঞ্চে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বললেই যে মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়, তা নয়। যাদের সাহিত্যে ‘খেলা’ করার ইচ্ছা, সাহস ও সামর্থ্য আছে, তারাই মানুষের মন জয় করতে পারেন।
মানুষ খেলা দেখতে ভালোবাসে তা ফুটবল হোক বা অন্য কিছু। টাউন হলে বক্তৃতা শুনতে যতজন যায়, তার চেয়ে বেশি যায় মাঠে খেলা দেখতে। অথচ বক্তৃতার উদ্দেশ্য মহৎ, আর খেলার কোন উদ্দেশ্যই নেই এটা শুধু আনন্দের জন্য। আসলে মানুষের সব কাজের মধ্যে ‘খেলা’ই শ্রেষ্ঠ, কারণ এটা উদ্দেশ্যহীন। খেলায় মানুষ শুধু আনন্দ চায়, বাড়তি কিছু নয়। যে ‘খেলা’তে আনন্দ নেই, শুধু লাভের আশা আছে, সেটা খেলা নয় জুয়া।
সাহিত্যেও এই ‘খেলা’ করার অধিকার আমাদের আছে। শুধু তাই নয়, নিজের ও পরের মঙ্গলের জন্য এই মানসিক খেলাই আমাদের প্রধান কর্তব্য। যে লেখক সাহিত্য ক্ষেত্রে শুধু ফলাফল বা লাভের চাষ করেন, তিনি না গানের মর্ম বুঝেন, না গীতার শিক্ষা। কারণ খেলাই একমাত্র নিস্বার্থ কাজ, মোক্ষলাভের উপায়। স্বয়ং ভগবানও খেলাচ্ছলেই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কোন অভাব ছিল না। কবির সৃষ্টিও তেমনি এতে কোন অভাব পূরণের চেষ্টা নেই, এ শুধু আত্মার প্রকাশ ও আনন্দের জন্য। সাহিত্য জীবাত্মার খেলা, আর এই খেলা বিশ্বলীলারই অংশ।
সাহিত্যের উদ্দেশ্য সবাইকে আনন্দ দেওয়া, কারও মন জয় করা নয়। এই দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। অনেক লেখক এই তফাত ভুলে গিয়ে নিজে না খেলে, অন্যকে খেলনা বানাতে বসেন। সমাজকে খুশি করতে গিয়ে সাহিত্য নিজের ধর্ম হারায়। আজ বাংলা সাহিত্যে তার বহু উদাহরণ আছে কবিতার ঝুনঝুনি, বিজ্ঞানের খেলনা, দর্শনের বেলুন, রাজনীতির রঙিন লাঠি ইত্যাদি দিয়ে বাজার সয়লাব। এসব পাঠককে কিছুক্ষণের জন্য খুশি রাখতে পারে, কিন্তু লেখককে তৃপ্তি দেয় না। কারণ পাঠক আজ যে খেলনা কিনছে, কাল সেটা ভেঙে ফেলবে।
এ যুগের পাঠক হলো সাধারণ মানুষ, তাই তাদের খুশি করতে হলে সস্তা খেলনা বানাতে হবে। আর সস্তা করার মানেই হলো জিনিসকে তুচ্ছ করা। লেখক যদি ব্যবসায়ী হয়, তবেই পাঠককে তুচ্ছ জিনিস দিয়ে খুশি করা যায়। তাই সাহিত্যে পাঠককে খুশি করার চেষ্টা করো না।
তাহলে সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি শিক্ষা দেওয়া? না, মোটেও না। কারণ কবি আর শিক্ষকের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। স্কুল বন্ধ না হলে খেলার সময় আসে না এটা সবার জানা। সাহিত্য হলো আত্মার খেলা, এটা শিক্ষকেরা মানতে চান না। শিক্ষা হলো যা মানুষ অনিচ্ছায় গিলে, আর সাহিত্য হলো যা মানুষ আনন্দে গ্রহণ করে। শিক্ষার উদ্দেশ্য তথ্য দেওয়া, সাহিত্যের উদ্দেশ্য মনকে জাগানো। শিক্ষকের কাজ অন্যের অভাব পূরণ করা, আর কবির কাজ নিজের ভাবনা প্রকাশ করা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাল্মীকি প্রথমে মুনি-ঋষিদের জন্যই রামায়ণ লিখেছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। ঋষিরা এতে এতটাই আনন্দ পেয়েছিলেন যে, তারা অভিনয়কারীদের সব কিছু দান করেছিলেন। রামায়ণ আজও মানুষকে আনন্দ দেয়, কারণ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ার মতো জিনিস। কিন্তু শিক্ষামূলক গ্রন্থ (যেমন যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ) কেউ পড়ে না, কারণ সেখানে আনন্দ নেই, শুধু শিক্ষা আছে।
সাহিত্য কখনও স্কুলমাস্টারের দায়িত্ব নেয়নি। বরং দুঃখের বিষয়, আজকাল স্কুলমাস্টাররাই সাহিত্যের দায়িত্ব নিয়েছেন। স্কুলে কাব্য পড়ানো হয় টীকা-ভাষ্য দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে নয়। আমরা হীরে আর কাঁচের তফাত শিখি, কিন্তু সাহিত্যে তবু ভুল করি। কারণ সাহিত্য অনুভবের বিষয়, তর্কের নয়।
সাহিত্য হলো মানুষের আত্মার খেলা, এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করা।
Related Posts
- তাহারেই পড়ে মনে কবিতার MCQ প্রশ্ন ও উত্তর (বোর্ড পরীক্ষায় আসা)
- প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও উত্তর
- বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন উত্তর – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর
- প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা