শওকত আলীর “কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ” গল্পটি প্রান্তিক সাঁওতাল আদিবাসী সমাজের এক বৃদ্ধ ব্যক্তি কপিলদাসের মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও তার প্রতীকী প্রতিরোধের কাহিনী। এই পোস্টে কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ মূলভাব সহজ ভাষায় লিখে দিলাম।
Table of Contents
কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ মূলভাব
“কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ” গল্পটি একজন বৃদ্ধ সাঁওতাল আদিবাসী কপিলদাসের কাহিনী, যিনি শান্ত টাঙন নদীর পাড়ে বসে তাঁর যৌবনের শিকার, নাচ ও সংগ্রামের স্মৃতি মনে করতে থাকেন। তাঁর চারপাশে এখন আধুনিক জীবনের আওয়াজ ট্রাক্টর, চিনিকলের ট্রাক। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে তাঁর হারানো দিনগুলোর কথা ভাবেন। একদিন তিনি জানতে পারেন যে জমিদার ও ফার্মের মালিকরা তাদের সম্প্রদায়ের বসতভিটা উচ্ছেদ করে সেখানে ট্রাক্টর চালাতে চায়, যা তাদের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে আলোচনা করলেও কপিলদাসকে এতে অংশ নিতে দেওয়া হয় না, কারণ সবাই তাকে “বুড়ো ও অক্ষম” মনে করে। এই অপমান ও অসহায়ত্ব তাঁকে গভীরভাবে পীড়া দেয়, ফলে তিনি তাঁর অতীতের শক্তি ও পরিচয়ের দিকে ফিরে যান। রাতে তিনি তাঁর পুরনো ধনুক-তির বের করে নেন এবং বাচ্চাদের সামনে শিকারের গল্প বলতে শুরু করেন, যা তাঁর যৌবন ও সাহসের প্রতীক। অতীতের স্মৃতিতে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি প্রথম একটি তির ছোড়েন অন্ধকারের দিকে, তারপর দ্বিতীয়টি, এবং শেষে তৃতীয় তিরটি “সঠিক নিশানায়” ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হন। এই কাজটি তাঁর জীবনের শেষ প্রতিবাদ। এটি দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চান যে বয়স বা শারীরিক দুর্বলতা তাঁর প্রতিবাদী চেতনাকে দমাতে পারেনি। গল্পটি আসলে উন্নয়ন ও আধুনিকতার নামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভিটেমাটি, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব সংকটের চিত্র তুলে ধরে, পাশাপাশি দেখায় যে একজন মানুষ কীভাবে তাঁর শেষ মুহূর্তেও তাঁর মর্যাদা ও পরিচয় রক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।
কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ মূলভাব বড় করে
গল্পটি শুরু হয় শীতের এক শান্ত টাঙন নদীর দৃশ্য দিয়ে। নদীর জল এতই কমে গেছে যে স্রোতে কোনো কাঁপন নেই, এমনকি চিনিকলের ভারী ট্রাক সাঁকো দিয়ে গেলে নদীর জলও নড়ে না। এই শান্ত নদীর ধারে বসে আছেন কপিলদাস মুর্মু একজন বৃদ্ধ সাঁওতাল আদিবাসী। তার চারপাশে আধুনিক জীবনের শব্দ: ট্রাক্টরের ধকধক আওয়াজ, ট্রাকের চিৎকার, দূরের রাখালের বাঁশি কিন্তু কপিলদাস এ সবের দিকে কানই দেন না। তিনি বসে বসে ঝিমোতে থাকেন, আর তাঁর মনে পড়ে যায় অতীতের দিনগুলো।
- তাঁর মনে পড়ে যৌবনের দিনগুলো, যখন তিনি শিকারে পারদর্শী ছিলেন, তির চালাতেন, বাঘ শিকার করতেন।
- মনে পড়ে সাঁওতাল নাচ-গানের উৎসবের দিনগুলো, যখন তিনি মাদল বাজাতেন আর সবাই মিলে নেচে গেয়ে উৎসব করতেন।
- মনে পড়ে তাঁর বিশ্বস্ত কালো শিকারি কুকুরটির কথা, যেটাকে বাঘে খেয়ে ফেলেছিল।
- মনে পড়ে একবার মহাজনের গোলা থেকে ধান কিষানদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার ঘটনা, কিংবা মানুয়েল পাদ্রিকে নদীতে ধাক্কা দেওয়ার সাহসী কাজের কথা।
কিন্তু এইসব স্মৃতি ভেসে আসার মধ্যে দিয়েও কপিলদাস বুঝতে পারেন যে তাঁর চারপাশের দুনিয়া পাল্টে গেছে। এখন তাঁর বয়স হয়েছে, তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল, এবং সবচেয়ে বড় কথা তাঁর সম্প্রদায় একটি বড় সংকটের মুখে।
একদিন কপিলদাস নদীর পাড়ে বসে থাকতে থাকতে দেখেন কয়েকজন ভদ্রলোক পরিষ্কার জামাকাপড় পরে দূর থেকে তাদের বস্তির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কথা বলছেন। পরে তাঁর নাতি সলিমউদ্দিন এসে তাকে জানায়, “তোমার বসতটা এবার উঠিয়ে দিবে, এখানে এ বছর ট্রাক্টর চলবে।”
এই খবর শুনে কপিলদাসের মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগের একটি সভার কথা, যখন ফার্মের ম্যানেজার ও জমিদারপক্ষ তাদের ভিটেমাটি উচ্ছেদের পরিকল্পনা করছিল। তখন কপিলদাস কিছু বলতে চাইলে তাঁর নিজের ছেলে মহিন্দর তাকে বাধা দিয়ে বলেছিল, “তুই বুড়ো মানুষ, তুই এসবের কী বুঝবি!” এই কথাটা কপিলদাসকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল।
সন্ধ্যায় কপিলদাসের উঠোনে পুরো সাঁওতাল পাড়ার মানুষজন জড়ো হয়। মহিন্দর, দীনদাস, ভায়া মাঝি সবাই মিলে আলোচনা করে কীভাবে তাদের ভিটেমাটি রক্ষা করা যায়। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় কপিলদাসকে অংশ নিতে দেওয়া হয় না। বারবার তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে তিনি বৃদ্ধ, অক্ষম, এবং “তাঁর কিছু করার নেই।”
এই অপমান ও নিষ্ক্রিয়তা কপিলদাসকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকেন, এত বছর আগে তাঁর দাদা-প্রপিতামহরা এই জমিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন, শিবনাথ মড়ল তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর আজ সেই ঐতিহ্যবাহী বসতভিটা উচ্ছেদ হতে চলেছে।
গভীর রাতে, যখন সবাই আলোচনা করছে, কপিলদাস হঠাৎই এক কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উঠে যান তাঁর পুরনো ধনুক-তির এর কাছে। সেগুলো নিয়ে তিনি বাচ্চাদের কাছে বসে যান এবং তাদের শিকারের গল্প বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন কীভাবে তিনি একবার বাঘ শিকার করেছিলেন, কীভাবে তাঁর কুকুরটি তাঁকে সাহায্য করত।
গল্প বলতে বলতে কপিলদাসের মধ্যে যেন পুরনো যৌবন ফিরে আসে। তিনি হাতে ধনুক-তির নিয়ে দেখান কীভাবে ছিলা পরাতে হয়, কীভাবে নিশানা ভেদ করতে হয়। বাচ্চারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
একসময় কপিলদাস প্রথম তিরটি ছোড়েন তা উড়ে যায় অন্ধকারের দিকে। সবাই চিৎকার করতে থাকে, মহিন্দর ও অন্যান্যরা বাধা দিতে চায়। কিন্তু কপিলদাস থামেন না। তিনি দ্বিতীয় তিরটি ছোড়েন।
তারপর তিনি তৃতীয় তিরটি হাতে নেন। এবার তিনি শুধু ছোড়ার জন্য নয়, “সঠিক নিশানায়” ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হন। এই তির ছোড়া কোনো শিকার নয়, এটি একটি শেষ প্রতিবাদ।
এই কাজের মাধ্যমে কপিলদাস যেন বলতে চান:
- “আমি বৃদ্ধ হলেও আমি মরিনি।”
- “তোমরা আমার জমি কেড়ে নিতে পারো, কিন্তু আমার সাহস, আমার পরিচয়, আমার সংস্কৃতি কেড়ে নিতে পারবে না।”
- “এই তির ছোড়া আমার শেষ কাজ যা দিয়ে আমি প্রমাণ করছি আমি আজও লড়াই করতে পারি।”
গল্পটি শেষ হয় যখন কপিলদাস তার তৃতীয় তিরটি ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এটি তাঁর জীবনের “শেষ কাজ”, যা দিয়ে তিনি তাঁর সম্মান, তাঁর অস্তিত্ব এবং তাঁর সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুনঃ কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ MCQ | বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর