সোনার তরী কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী” কবিতায় জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং মহাকালের স্রোতে সমস্ত কিছুর হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে কবি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এই পোস্টে সোনার তরী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।

সোনার তরী কবিতার মূলভাব

নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষক আসলে সাধারণ মানুষকে বোঝায়, যে সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে জীবন গড়ে তোলে। তার “সোনার ধান” শুধু ফসল নয়, বরং তার শ্রম, স্বপ্ন, আশা ও অর্জনের প্রতীক। যেকোনো সময় নদীর স্রোতে যেমন ধান ভেসে যেতে পারে, তেমনি জীবনে যেকোনো সময় সবকিছু হারিয়ে যেতে পারে। হঠাৎ যে নৌকাটি আসে, তার মাঝি হলো সময় বা মহাকালের প্রতীক। কৃষকের মনে মাঝিকে চেনা চেনা লাগে, কারণ সময় মানুষের কাছে অচেনা নয়। কিন্তু মাঝি কোনো দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যায়, কারণ সময় কখনো কারো জন্য থামে না। কৃষক অনুরোধ করে, যেন নৌকাটি একটু থামে। শেষে সে তার সব সোনার ধান নৌকায় তুলে দেয়, অর্থাৎ মানুষ জীবনের শেষে নিজের সব অর্জন সময়ের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু নৌকাটি ছোট হওয়ায় কৃষকের নিজের জন্য জায়গা থাকে না। এর মানে হলো, মানুষ নিজে চিরস্থায়ী নয়। সময় মানুষকে সঙ্গে নেয় না, কিন্তু তার কাজ ও সৃষ্টি নিয়ে যায়। মাঝি চলে গেলে কৃষক শূন্য নদীর তীরে একা পড়ে থাকে। এটি মানুষের মৃত্যুর পরের নিঃসঙ্গতার ছবি। মানুষ চলে যায়, কিন্তু তার সৃষ্টি থেকে যায়। কবিতাটি আমাদের শেখায় যে জীবন ক্ষণস্থায়ী। তাই বেঁচে থাকতে ভালো কাজ করা ও কিছু সৃষ্টি করাই সবচেয়ে বড় সত্য।

সোনার তরী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা-
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা ॥

আকাশে ঘন কালো মেঘ গর্জন করছে এবং প্রবল বৃষ্টি নামছে। নদীর ধারে বসে থাকা কৃষক একেবারেই একা, তার মনে কোনো ভরসা নেই। সে সারা বছর পরিশ্রম করে ধান কেটেছে, চারদিকে স্তূপ করে ধান জমিয়েছে। কিন্তু নদী এখন পানিতে ভরে উঠেছে এবং তার স্রোত খুব তীব্র ও ধারালো অস্ত্রের মতো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই ক্ষুরধার স্রোত যে কোনো সময় কৃষকের সব ধান ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ধান কাটতে কাটতেই বর্ষা এসে পড়ায় কৃষকের কষ্ট ও দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। এখানে কবি দেখিয়েছেন, মানুষের কঠোর পরিশ্রমের ফল এক মুহূর্তে প্রকৃতি বা সময়ের আঘাতে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।


একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা-
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা-
এপারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা ।।

কৃষকের আছে মাত্র একখানি ছোট খেত, আর সে সেখানে সম্পূর্ণ একা। চারদিকে নদীর বাঁকা স্রোত ঘুরে ঘুরে চলছে, যেন জল খেলাচ্ছলে খেতটিকে ঘিরে রেখেছে। এই বাঁকা জল আসলে বিপদের ইঙ্গিত, যা যে কোনো সময় খেতটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। নদীর ওপার দিকে কৃষকের চোখে পড়ে একটি গ্রাম, যা গাছের ছায়ায় আচ্ছাদিত এবং মেঘে ঢাকা অবস্থায় দূর থেকে ছবির মতো সুন্দর লাগছে। সকালের আলোয় সেই গ্রামটিকে শান্ত ও নিশ্চিন্ত মনে হয়। কিন্তু এপারে কৃষক দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট খেতে, যেখানে নেই কোনো নিরাপত্তা বা সঙ্গী। ওপারের গ্রামের শান্তির সঙ্গে এপারের কৃষকের উদ্বেগ ও একাকীত্বের তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি হয়েছে। এই অংশে কবি মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র দেখিয়েছেন। একদিকে আকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা ও শান্তি অন্যদিকে বর্তমানের অনিশ্চয়তা ও নিঃসঙ্গ সংগ্রাম।


গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে-
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ।।

কৃষক দেখে, গান গাইতে গাইতে একটি নৌকা নদীর পারে এগিয়ে আসছে। মাঝিটিকে দেখে তার মনে হয়, যেন সে তাকে আগে থেকেই চেনে, যদিও ঠিক করে মনে পড়ে না কোথায় বা কীভাবে চেনা। নৌকার পাল ভরা, তাই সেটি খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝি কোনো দিকেই বিশেষভাবে তাকাচ্ছে না, কারও দিকে মনোযোগ নেই তার। সে যেন নিজের নিয়মে, নিজের পথে এগিয়ে চলেছে। নদীর ঢেউগুলো অসহায়ভাবে নৌকার দুই পাশে আছড়ে পড়ছে, কিন্তু নৌকাটিকে থামাতে পারছে না। এতে বোঝা যায়, নৌকার গতি ও শক্তি ঢেউয়ের চেয়েও বেশি। এই মাঝি আসলে সময় বা মহাকালের প্রতীক, যে কাউকে অপেক্ষা না করেই এগিয়ে চলে। মানুষের চেনা মনে হলেও তাকে থামানো যায় না। এই অংশে কবি বোঝাতে চেয়েছেন, সময় সবার পরিচিত হলেও সে কারও জন্য দাঁড়ায় না।


ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও-
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কুলেতে এসে ॥

এই অংশে কৃষক মাঝির উদ্দেশে করুণ কণ্ঠে কথা বলছে। সে জানতে চায়, মাঝি কোন অজানা বিদেশের দিকে যাচ্ছে। এখানে “বিদেশ” বলতে সাধারণ কোনো দেশ নয়, বরং অচেনা ভবিষ্যৎ বা চিরন্তন জগতের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কৃষক অনুরোধ করে, মাঝি যেন একবার নৌকাটি তীরে ভিড়িয়ে নেয়। সে বলে, তুমি যেখানে খুশি যাও, যাকে ইচ্ছা তাকে দাও, আমার কোনো আপত্তি নেই। তার একমাত্র অনুরোধ, মাঝি যেন একটু হেসে তার সোনার ধান নিয়ে যায়। এই “সোনার ধান” শুধু ধান নয়, বরং কৃষকের সারাজীবনের পরিশ্রম ও অর্জনের প্রতীক। কৃষক বুঝতে পারছে, তার শ্রমের ফল হয়তো সে নিজে ধরে রাখতে পারবে না। তাই সে নিজের সর্বস্ব তুলে দিতে রাজি। এখানে তার কণ্ঠে কোনো অভিযোগ নেই, আছে বিনয় ও অসহায়তা। এই অংশে কবি মানুষের জীবনের বাস্তব সত্য দেখিয়েছেন, মানুষ শেষ পর্যন্ত তার সব অর্জন সময়ের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়।


যত চাও তত লও তরণী-পরে।
আর আছে- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে-
এখন আমারে লহো করুণা করে ।

এই অংশে কৃষক মাঝিকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে যে, সে যত খুশি ধান নৌকায় তুলে নিতে পারে। তার কাছে আর কিছু বাকি নেই, যা ছিল সবই সে দিয়ে দিয়েছে। এতদিন নদীর ধারে বসে সে যে ধান আর সম্পদ আঁকড়ে ধরে ছিল, সেগুলোর জন্যই সে সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে ছিল। এখন সে একে একে সব ধান সুন্দরভাবে সাজিয়ে নৌকায় তুলে দিয়েছে। এখানে “থরে বিথরে” কথাটি তার যত্ন ও আন্তরিকতার প্রকাশ। ধান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের সব অর্জনও যেন সে তুলে দিল। সবকিছু দেওয়ার পর কৃষক বুঝতে পারছে, তার নিজের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তাই এবার সে করুণ কণ্ঠে মাঝির কাছে অনুরোধ করছে তাকে যেন নিজেকেও নৌকায় তুলে নেওয়া হয়। এই অনুরোধ আসলে জীবনের শেষ প্রান্তে মানুষের শেষ আকুতি। কবি এখানে দেখিয়েছেন, মানুষ যখন তার সব সৃষ্টি ও সম্পদ দিয়ে দেয়, তখন সে নিজেই হয়ে পড়ে নিঃস্ব ও অসহায়।


ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি-
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী ॥

মাঝি জানিয়ে দেয় যে নৌকাটি খুব ছোট, সেখানে আর জায়গা নেই। কৃষকের সব সোনার ধান নৌকাটি ভরে ফেলেছে, তাই কৃষক নিজে আর উঠতে পারে না। এখানে “সোনার ধান” শুধু ধান নয়, বরং কৃষকের সারাজীবনের পরিশ্রম, সৃষ্টি ও অর্জনের প্রতীক। আকাশে শ্রাবণের ঘন মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা দুঃখ, অনিশ্চয়তা ও শেষ সময়ের ইঙ্গিত দেয়। মাঝি নৌকা নিয়ে চলে যায়, আর কৃষক নদীর ধারে একা পড়ে থাকে। সে দেখে, তার যা কিছু ছিল। সবই সোনার তরী নিয়ে চলে গেছে। এখন তার হাতে আর কিছু নেই, এমনকি নিজের জন্যও কোনো স্থান নেই। এই নিঃসঙ্গতা মানুষের মৃত্যুর মুহূর্তের ছবির মতো। কবি বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের সৃষ্টি বা কর্ম টিকে থাকে, কিন্তু মানুষ নিজে একসময় হারিয়ে যায়। জীবন শেষে মানুষ শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তার কাজ সময়ের স্রোতে ভেসে যায়।


আরও পড়ুনঃ সোনার তরী কবিতার MCQ | বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর

Related Posts