কাজী নজরুল ইসলামের “উমর ফারুক” কবিতাটি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর জীবনাদর্শ ও মানবিক মহত্ত্বকে কেন্দ্র করে রচিত। নজরুল এতে উমরের ন্যায়বিচার, ত্যাগ ও সাম্যবাদের আদর্শকে কাব্যিক ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এই পোস্টে উমর ফারুক কবিতার জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
উমর ফারুক কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
১। ‘উমর ফারুক’ কবিতার রচয়িতা কে?
উত্তর: কাজী নজরুল ইসলাম।
২। ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত?
উত্তর: জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থ থেকে।
৩। কাজী নজরুল ইসলাম কবে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর: ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ (২৪শে মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ)।
৪। কাজী নজরুল ইসলাম জন্মস্থান কোথায়?
উত্তর: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে।
৫। ছোটবেলায় নজরুল কোন গানের দলে যোগ দেন?
উত্তর: লেটো গানের দলে।
৬। কাজী নজরুল ইসলাম কোথায় লেখাপড়া করেন?
উত্তর: বর্ধমান ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে।
৭। নজরুল কোন সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন?
উত্তর: ১৯১৭ সালে।
৮। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি কোথায় যান?
উত্তর: করাচি।
৯। কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য জীবনের সূচনা কোথায় হয়?
উত্তর: করাচিতে।
১০। কাজী নজরুলের কবিতায় কোন ভাষার শব্দের সার্থক ব্যবহার দেখা যায়?
উত্তর: আরবি ও ফারসি ভাষার।
১১। কত বছর বয়সে কাজী নজরুল দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন?
উত্তর: তেতাল্লিশ বছর বয়সে।
১২। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কাজী নজরুলকে কোথায় আনা হয়?
উত্তর: ঢাকায়।
১৩। কাজী নজরুল ইসলামে বাংলাদেশের কী মর্যাদায় ভূষিত করা হয়?
উত্তর: জাতীয় কবির মর্যাদা।
১৪। কাজী নজরুল ইসলামের কত তারিখে মৃত্যু হয়?
উত্তর: ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬।
১৫। কাজী নজরুল ইসলামকে কোথায় সমাহিত করা হয়?
উত্তর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
১৬। কবিতাটিতে কোন ইসলামী খলিফার কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)।
১৭। কবিতার প্রথম লাইনে কোন নামাজের আজান শোনা যায়?
উত্তর: এশার আজান।
১৮। উমর ফারুক (রা.) কে ছিলেন?
উত্তর: ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও মহান ন্যায়পরায়ণ শাসক।
১৯। কবিতায় ‘উমর ফারুক’কে কী নামে ডাকা হয়েছে?
উত্তর: আমির-উল-মুমেনিন।
২০। ‘সেদিন গিয়াছে’—এখানে ‘সেদিন’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: উমর (রা.)-এর ন্যায়বিচারের দিন।
২১। উমর (রা.) কী শাসনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন?
উত্তর: ন্যায়বিচার ও শোষণমুক্ত শাসনের জন্য।
২২। উমর (রা.) কার দক্ষিণ বাহু ছিলেন বলে বলা হয়েছে?
উত্তর: শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর।
২৩। শেষ নবী (সা.) উমর (রা.) সম্পর্কে কী বলেছিলেন?
উত্তর: “মোর পরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।”
২৪। উমর (রা.) কী ধরনের জীবনযাপন করতেন?
উত্তর: অত্যন্ত সরল ও সাদামাটা।
২৫। কবিতায় উমর (রা.)-এর কী কী খাদ্যের উল্লেখ আছে?
উত্তর: শুকনো রুটি, খেজুর, পানি।
২৬। উমর (রা.) কোন শহরে নগর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন?
উত্তর: মদিনা।
২৭। উমর (রা.) কোন দুর্গ অবরোধ করেছিলেন?
উত্তর: জেরুজালেমের দুর্গ।
২৮।‘সাইমুম’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: মরুভূমির শুকনো, উত্তপ্ত, শ্বাসরোধকারী প্রবল হাওয়া।
২৯। জেরুজালেমের শাসক কী শর্ত দিয়েছিল?
উত্তর: সন্ধিপত্রে উমর (রা.) নিজে স্বাক্ষর করলে তারা আত্মসমর্পণ করবে।
৩০। উমর (রা.) কী বাহনে চড়ে জেরুজালেম গিয়েছিলেন?
উত্তর: উট।
৩১। উমর (রা.)-এর সঙ্গে ভৃত্যের মধ্যে কী নিয়ে বিতর্ক হয়?
উত্তর: কে উটে চড়বে ও কে রশি ধরবে তা নিয়ে।
৩২। ‘তকবির’ কী?
উত্তর: ‘আল্লাহ’ ধ্বনি বা রব।
৩৩। উমর (রা.) ভৃত্যকে কী বলেছিলেন?
উত্তর: “আমি তোমাদের প্রতিনিধি মাত্র, মোর কোনো অধিকার নাই।”
৩৪। উমর (রা.) কোন যুদ্ধবীরকে সেনাপতি থেকে সাধারণ সৈনিক করেছিলেন?
উত্তর: খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)।
৩৫। উমর (রা.) কেন তার পুত্রকে শাস্তি দেন?
উত্তর: মদ্যপানের অপরাধে।
৩৬। উমর (রা.)-এর পুত্র কীভাবে মারা যান?
উত্তর: দোররা মারার শাস্তিতে।
৩৭। ‘তখত’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: সিংহাসন।
৩৮। উমর (রা.) ইসলামের কততম খলিফা ছিলেন?
উত্তর: দ্বিতীয় খলিফা
৩৯। “আখেরী নবির দক্ষিণ বাহু” বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: হজরত উমর (রা.)-কে
৪০। “তিমির রাত্রি” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: অন্ধকার রাত
৪০। ‘নান্দী’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: কাব্য বা নাটকের শুরুতে স্তুতি বা প্রশস্তি পাঠ।
৪১। উমর (রা.)-এর স্মৃতি কবির কাছে কীসের মতো?
উত্তর: আজানের ধ্বনির মতো
৪২। “মরুর শশী” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: মরুভূমির চাঁদ
৪৩। কবি আজান শুনে কী করেছেন?
উত্তর: শয্যা ছেড়ে উঠেছেন
৪৪। “অন্ধতা রাহু” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: অজ্ঞতা ও পাপ
৪৫। “ইসলাম-রবি” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ইসলামের সূর্য
৪৬। উমর (রা.) কীভাবে জগত শাসন করতেন?
উত্তর: আঙ্গুলি-হেলনে
৪৭। “শমশের” কীসের প্রতীক?
উত্তর: ন্যায়বিচারের
৪৮।”ফিরদৌস” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: স্বর্গ
৪৯। “পরশ-মানিক” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ইসলামের স্পর্শমণি
৫০। “তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে” – এটি কার কথা?
উত্তর: ভৃত্যের
৫১। উমর (রা.) ভৃত্যকে কী বলেছিলেন?
উত্তর: ‘তুমি উটে চড়ো, আমি রশি ধরব’
৫২। ক্ষুধার্ত মা ও শিশুদের সাহায্য করতে উমর (রা.) কী করেছিলেন?
উত্তর: নিজ হাতে খাদ্য বহন করেছিলেন
৫৩। “বায়তুল-মাল” কী?
উত্তর: রাষ্ট্রীয় কোষাগার
৫৪। উমর (রা.)-এর শাসনব্যবস্থার মূল নীতি কী ছিল?
উত্তর: সাম্য ও ন্যায়বিচার।
৫৫। উমর (রা.)-এর বাড়ি কেমন ছিল?
উত্তর: সাধারণ খেজুরপাতার কুটির।
৫৬। ‘মশক’ কী?
উত্তর: পানি বহনের চামড়ার থলে।
৫৭। উমর (রা.) মানুষের প্রতি কেমন ছিলেন?
উত্তর: দয়ালু ও সেবাপরায়ণ।
৫৮। উমর (রা.)-এর দরবার কেমন ছিল?
উত্তর: সাধারণ ও জনগণের জন্য উন্মুক্ত।
৫৯। উমর (রা.)-এর বিখ্যাত উক্তি কী?
উত্তর: “আমিই যদি অন্যায় করি, তবে তোমরা আমাকে সংশোধন করবে।”
৬০। উমর (রা.) কোন খেলাফতের অধীনে ছিলেন?
উত্তর: ইসলামী খেলাফত।
৬১। ‘চীর’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ছিন্ন বা ছেঁড়া বস্ত্র।
৬২। উমর (রা.) কীভাবে সেই ক্ষুধার্ত পরিবারকে সাহায্য করেন?
উত্তর: নিজে পিঠে খাবার বহন করে তাদের ঘরে পৌঁছে দেন।
৬৩। কবিতায় উমর (রা.)-কে কীসের সাথে তুলনা করা হয়েছে?
উত্তর: ইসলামের সত্য সূর্যের সাথে।
৬৪। কবিতায় ফেরেশতাদের কী বলা হয়েছে?
উত্তর: তারা উমর (রা.)-এর গুণগান গেয়েছেন।
৬৫। উমর (রা.) সত্যভাষণের জন্য কী উপাধি পেয়েছিলেন?
উত্তর: ‘আল ফারুক’ (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।
৬৬। ‘পিরান’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: জামা।
৬৭। ‘উমর ফারুক’ কে ছিলেন?
উত্তর: ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)।
৬৬। ‘ফারুক’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: যিনি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন।
৬৭। হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফতের সময়কাল কত?
উত্তর: দশ বছর (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)।
৬৮। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নামাজের জন্য প্রকাশ্যে আজান দেওয়া হতো না কেন?
উত্তর: কোরেশদের ভয়ে মুসলমানরা সাহস পেত না।
৬৯। হজরত উমরের ইসলাম গ্রহণের পর কী পরিবর্তন আসে?
উত্তর: প্রকাশ্যে আজান দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৭০। ‘আমির উল-মুমেনিন’ কাকে বোঝায়?
উত্তর: মুসলমানদের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রধান, এখানে হজরত উমর (রা.)।
৭০। ‘মুয়াজ্জিন’ কারা?
উত্তর: যারা আজান দেন।
৭১।‘পরশমণি’ কী?
উত্তর: এমন একটি বস্তু যার স্পর্শে লোহা সোনা হয়ে যায়।
৭২। আবু শাহমা কে ছিলেন?
উত্তর: হজরত উমরের পুত্র।
৭৩। হজরত উমর আবু শাহমাকে কী শাস্তি দেন?
উত্তর: মদপানের অপরাধে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন।
৭৪। আবু শাহমার কী পরিণতি হয়েছিল?
উত্তর: বেত্রাঘাতের ফলে তার মৃত্যু হয়।
উমর ফারুক কবিতার অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
১। হজরত উমরকে ‘আমিরুল মুমেনিন’ বলার কারণ কী?
হজরত উমর (রা.) ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় খলিফা ছিলেন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে তাঁর অত্যন্ত সম্মানজনক পদ ছিল ‘আমিরুল মুমেনিন’ বা ‘বিশ্বাসীদের নেতা’। তিনি মুমেনিন বা বিশ্বাসীদের সঠিক দিশা নির্দেশক ছিলেন এবং তাঁর শাসনামলে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন ন্যায়ের প্রতি অনুগত। তাঁর শাসন ব্যবস্থায় ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা তাকে এই বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করেছে।
২। “সাইমুম-ঝড়ে পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক’নুয়ে” বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
এখানে কবি সাইমুম (মরুভূমির তপ্ত বাতাস) বা ঝড়ের তীব্রতা দিয়ে হজরত উমরের অটল দৃঢ়তা এবং তাঁর জীবনযাত্রার কঠোরতা বর্ণনা করেছেন। কুটির বা ঘরবাড়ি সাইমুমের ঝড়ে পড়লেও, খলিফা উমর (রা.) নিজের জীবনে কোনো বিলাসিতা বা আরামকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি নিজের জীবনযাত্রা অতি সাধারণ রেখেছেন, যেখানে কোনো প্রকার ঐশ্বর্য বা সান্ত্বনা ছিল না। এই পঙ্ক্তিতে কবি তাঁর দুর্বলতা ও ধৈর্যের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরছেন।
৩। “তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।”- ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তিতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে হজরত উমর (রা.) ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমদের জন্য প্রকাশ্যে আজান দেয়ার অধিকার ও পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আগে কোরেশরা মুসলমানদের প্রকাশ্যে আজান দেওয়ার অনুমতি দিত না, কিন্তু হজরত উমরের ইসলাম গ্রহণের পর এই সীমাবদ্ধতা দূর হয়। মুয়াজ্জিন, যে আজান দেয়, তার স্মৃতি হজরত উমরের সাহসিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
৪। খলিফা হজরত উমর (রা) নিজ ভৃত্যকে তাঁর সঙ্গে সমান মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হননি কেন? ব্যাখ্যা কর।
হজরত উমর (রা.) ছিলেন একজন সাম্যবাদী নেতা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সমস্ত মানুষ সমান এবং তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা উচিত নয়। তাই তিনি তাঁর ভৃত্যকেও সমান মর্যাদা দিয়ে তাঁর পাশে বসতেন এবং তাঁর সঙ্গী হিসেবে তাকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি নিজে দুনিয়ার কোনো আভিজ্ঞান বা সম্মানকে খুবই গুরুত্ব দেননি, বরং মানুষের সেবা ও সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
৫। “মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি।” কে মানবপ্রেমিক? ব্যাখ্যা কর।
এখানে কবি ‘মানব-প্রেমিক’ হিসেবে হজরত উমর (রা.) কে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন মহান নেতা, যিনি মানবতার জন্য কাজ করেছেন। তাঁর জীবন ছিল উদাহরণস্বরূপ, যেখানে মানুষের জন্য তাঁর গভীর ভালোবাসা এবং দয়া ছিল। তাঁর শাসনকাল ছিল ন্যায়পরায়ণ, আর তিনি সবসময় মানুষের কল্যাণে সচেষ্ট ছিলেন।
৬। “পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক’নুয়ে।”- পঙ্ক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তি থেকে কবি হজরত উমরের কঠোর জীবনযাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন। কবি বলেছেন যে, কুটির বা ঘরবাড়ি সাইমুম ঝড়ে পড়ে গেলেও, হজরত উমর (রা.) কোনো প্রকার বিলাসিতা বা আরামকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত সাধারণ, এবং তিনি সকল ধরনের পৃথিবীসংশ্লিষ্ট আরাম-আয়েশের প্রতি উদাসীন ছিলেন। তিনি তার একগুঁয়ে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে মানুষকে শাসন করতেন।
৭। “এইবার আমি যাই উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে”- পঙ্ক্তিটি বুঝিয়ে গ লেখ।
এই পঙ্ক্তিতে হজরত উমর (রা.) তাঁর ভৃত্যকে নির্দেশ দিচ্ছেন, “তুমি উষ্ট্রের রশি ধরো এবং আমি আগে চলব।” এটি তাঁর অতি সাধারণ জীবনযাপনের এবং নিজেকে অন্যদের থেকে পৃথক না করার মনোভাবের প্রতিফলন। তিনি সিংহাসনে বসেও নিজের ভৃত্যের মতো পথ চলতেন, এবং ভৃত্যকে তাঁর বিপরীতে রেখে চলতে চাইলেন না।
৮। “সেদিন গিয়াছে’-শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।”- ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তিতে কবি সময়ের প্রবাহ ও জীবনের অমোঘতা বর্ণনা করেছেন। “শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি” অর্থাৎ, সময় চলে গেছে এবং তা অপ্রতিরোধ্য। জীবনের সীমিত সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি উমরের কর্মের মহত্ব এবং তাঁর ইতিহাসকে স্থায়ী করার গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলছেন।
৯। “এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের ‘পরে।”- পঙ্ক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তিতে হজরত উমর (রা.) বলেছেন, “এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের ‘পরে”, অর্থাৎ, যারা দরিদ্র, দুঃখী এবং অসহায়, তাদের ভার আমি নিজের ওপর নিতে প্রস্তুত। তিনি নিজেকে তাদের সেবক হিসেবে ভাবতেন এবং মানুষের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করতে কখনও পিছপা হননি।
১০। “অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ।” ব্যাখ্যা কর।
এখানে কবি বলছেন যে, হজরত উমর (রা.) কখনোই কোনো ব্যক্তির অপমান করতে চাননি, বরং তিনি সবাইকে সমান সম্মান দিয়েছেন। “নান্দী পাঠ” বলতে, তিনি কবিতার বা কোনো প্রশস্তি পাঠের কথা উল্লেখ করছেন, যাতে সম্মান প্রদর্শিত হয়। তিনি কখনও কাউকে ছোটো করেননি এবং সবসময় ন্যায়ের পথে চলেছেন।
১১। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা)-এর সাম্যবাদিতার পরিচয় দাও।
হজরত উমর (রা.) তাঁর খেলাফতের সময়ে সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেছেন। তিনি সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন, এবং তার শাসনামলে কোনো প্রকার জাতিগত বা সামাজিক বৈষম্য ছিল না। তিনি জনগণের সেবা ও কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন, এমনকি নিজে কোনো বিলাসিতা গ্রহণ করেননি এবং সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। একজন খলিফা হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন, যা তার সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে।
১২। ইসলামকে ‘পরশ-মানিক’ বলা হয়েছে কেন? ব্যাখ্যা কর।
ইসলামকে ‘পরশ-মানিক’ বলা হয়েছে কারণ ইসলাম মানুষকে সোনার মতো সুশুদ্ধ ও মর্যাদাবান করে তোলে, যেমন পরশ-মানিক (স্পর্শমণি) ছোঁয়ালে তামাও সোনা হয়ে যায়। ইসলাম সত্যের পথে চলতে এবং ঈমানের আলোর মধ্য দিয়ে মানুষকে সুশিক্ষিত ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী করে তোলে। এই কারণে ইসলামকে ‘পরশ-মানিক’ বলা হয়েছে।
১৩। আজানের ধ্বনির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোন স্মৃতির কথা বলা হয়েছে?
কবিতায় ‘আজানের ধ্বনি’ এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির কথা বলা হয়েছে হজরত উমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের সময়ের স্মৃতি সম্পর্কে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে মক্কার কোরেশরা মুসলমানদের মুক্তভাবে আজান দিতে দিত না, কারণ তারা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করত। কিন্তু হজরত উমর (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তিনি উন্মুক্তভাবে আজান দেওয়ার পথে অগ্রসর হন, যা আজানের ধ্বনির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্মৃতি।
১৪। “কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।” ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তিটি হজরত উমরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করে। এখানে বলা হচ্ছে যে, কবি (বা ব্যক্তিটি) হজরত উমর (রা.)-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে এবং তাঁকে সালাম জানায়। এটি উমরের মহত্ত্ব এবং ন্যায়ের প্রতি তাঁর গভীর অনুভূতির প্রতিফলন। এই পঙ্ক্তিটি হজরত উমরের প্রতি গভীর আবেগ এবং অনুরাগ প্রকাশ করছে, যিনি মানবতার জন্য অপরিসীম ত্যাগ করেছেন।
১৫। “অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি”- চরণটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
এখানে ‘অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন’ বলতে বোঝানো হচ্ছে যে, হজরত উমর (রা.) তার শাসনামলে এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন, যা আধুনিক পৃথিবীর অর্ধেক অংশের সমতুল্য ছিল। ‘ধুলার তখতে বসি’ বলে তিনি নিজের জীবনযাপন ও শাসনের সাধারণতা এবং অহংকারহীনতা উল্লেখ করেছেন। তিনি সিংহাসনে বসার পরিবর্তে সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন, এবং তাই তাঁর শাসন ছিল সাধারণ মানুষের জন্য এবং সহজ জীবনধারায় মেনে চলা।
১৬। শত প্রলোভন, বিলাস বাসনা কেন খলিফা উমরকে স্পর্শ করতে পারেনি?
হজরত উমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত নীতিবান, নিষ্ঠাবান এবং আত্মবিশ্বাসী। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসক হয়েও, কখনো বিলাসিতা বা প্রলোভনে আবেগতাড়িত হননি। উমর (রা.) এর মধ্যে এক গভীর আধ্যাত্মিকতা এবং সৎ-সংকল্প ছিল, যা তাকে সর্বদা সর্বদাই ন্যায়ের পথে রাখত। তাঁর এই দৃঢ় চরিত্র এবং আধ্যাত্মিকতা প্রলোভন ও বিলাসিতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁকে কখনোই তার শাসকত্বের সময় পৃথিবীভিত্তিক সুখের দিকে টেনে নিতে পারেনি।
১৭। হজরত উমরকে ফারুক বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা কর।
হজরত উমর (রা.)-কে ‘ফারুক’ বলা হয় কারণ তিনি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারতেন। ‘ফারুক’ শব্দটি আরবি থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘যিনি সত্য ও মিথ্যা পৃথক করতে পারেন’। হজরত উমর (রা.) অত্যন্ত বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ এবং সত্যের জন্য সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে তিনি যে কোনো ধরনের অন্যায় ও মিথ্যা নির্মূল করতে একের পর এক কঠিন পদক্ষেপ নিতেন। এজন্য তাঁকে ‘ফারুক’ উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়েছিল।
১৮। ‘সবে উদ্ধত কয়’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
‘সবে উদ্ধত কয়’ মানে হচ্ছে, উমরের মত একজন মহামানবের প্রশংসা সবাই একযোগে করেছে। ‘উদ্ধত’ শব্দটি এখানে ‘উচ্চ’ বা ‘বিশেষভাবে মর্যাদা দেওয়া’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কবি এখানে বোঝাতে চাচ্ছেন যে, হজরত উমরের মতো মহান ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে কেউ কোনো বিতর্ক পোষণ করেনি; বরং সবাই তাঁর মহত্ব, ন্যায়পরায়ণতা এবং সেবা-মনোভাবের প্রশংসা করেছে। এই পঙ্ক্তি দ্বারা উমরের সমগ্র সমাজে প্রতিষ্ঠিত শ্রদ্ধা ও সম্মানের কথা প্রকাশিত হয়েছে।
১৯। হজরত উমর ফারুক (রা)-কে ‘অর্ধেক ধরার মালিক’ বলা হয়েছে কেন? ব্যাখ্যা কর।
হজরত উমর (রা.)-কে ‘অর্ধেক ধরার মালিক’ বলা হয়েছে কারণ তাঁর শাসনামলে ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি শুধু আরব উপদ্বীপই নয়, মিশর, সিরিয়া, তুর্কিস্তানসহ বহু অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই তিনি এক অর্থে আধিপত্য ও শক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর শাসন ছিল এতটাই ব্যাপক এবং শক্তিশালী যে, বলা যায়, তিনি ‘অর্ধেক পৃথিবীর শাসক’ ছিলেন।
২০। “মোর পরে যদি নবি হত কেউ, হত সে এক উমর।”-কথাটি বুঝিয়ে লেখ।
এই কথা হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যেখানে তিনি হজরত উমর (রা.)-এর মহত্ত্ব ও ন্যায়পরায়ণতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পর যদি কোনো নবী হতো, তবে সে হতো উমর।’ এর মাধ্যমে রসুল (স.) হজরত উমরের চরিত্র, নেতৃত্ব, সত্যব্রত এবং ইসলামের প্রতি তাঁর নিবেদনকে প্রশংসা করেছিলেন। উমরের চরিত্রে এমন একটি শক্তি ছিল, যা নবী ছাড়া অন্য কোনো মানুষে দেখা যেত না, এবং তাঁর পরও কোনো নবী আসলে, তাঁর মতই নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ হতো।
২১। “ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।”- ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তিটি ইসলাম ধর্মের সাম্যবাদী দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। ইসলাম ধর্মে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, এবং কোন ব্যক্তি কোন সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানে থাকলেও তার মূল্যমান একই। হজরত উমর (রা.) তাঁর শাসনামলে এই ধারণা অনুসরণ করেছিলেন, যেখানে ধনী-গরিব, বড়-ছোট সকলকে সমান চোখে দেখা হতো। ইসলাম ধর্মের এই বার্তা ছিল, ‘সব মানুষ আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান’।
২২। কবি হজরত উমর ফারুক (রা)-কে চোখের পানিতে সর্বদা স্মরণ করেন কেন? বুঝিয়ে লেখ।
কবি হজরত উমর (রা.)-কে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত আবেগের সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি তাঁর জীবনের নিখুঁত ন্যায়পরায়ণতা, মানবিকতা এবং ইসলামি আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করেন। উমর (রা.) ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি শুধু রাজনীতি নয়, মানবতার পক্ষেও অবিচল ছিলেন। কবি তাঁর মহত্ত্ব ও মানবিক গুণাবলীকে স্মরণ করে এবং এটি তার চোখের পানিতে প্রভাব ফেলেছে, কারণ উমরের মতো ব্যক্তিত্বের অভাব একদিন গভীরভাবে অনুভূত হয়।
২৩। “তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক’ কারে ভয়।”-ব্যাখ্যা কর।
এই পঙ্ক্তিটি হজরত উমর (রা.)-এর নির্ভীক চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। উমর (রা.) ছিলেন এক ব্যক্তি যিনি শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে ভীত ছিলেন এবং কোনো শাসক, সম্রাট, বা পৃথিবীর কোনো শক্তির সামনে কখনো পরাভূত হননি। তিনি সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ ছিল, যা তাকে অন্যদের কাছে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহসী করে তুলেছিল। এর মাধ্যমে কবি তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস ও ন্যায়ের জন্য কোনো ভয়কে পরাজিত করার উমরের অটল মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
২৪। “মানুষেরে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
এই পঙ্ক্তিটি হজরত উমর (রা.)-এর মহানুভবতা ও নীতির কথা জানাচ্ছে। ‘স্বর্গে তুলিয়া’ বলার মাধ্যমে উমরের আদর্শ ও চরিত্রের উচ্চতায় তাঁকে অতিক্রমের জন্য মানবতাকে প্রচার করা হচ্ছে। ‘ধুলায় নামিল শশী’ এখানে ধ্রুবতারা বা চাঁদের মতো ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়ার পরেও তাঁর সরলতা, নম্রতা ও শান্ত মনোভাবের প্রকাশ। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য ন্যায়ের প্রতীক ছিলেন।
২৫। হজরত উমর (রা.)-কে মানবপ্রেমিক বলা হয়েছে কেন! ব্যাখ্যা কর।
হজরত উমর (রা.)-কে মানবপ্রেমিক বলা হয়েছে কারণ তিনি শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য সেবা করেছেন। তিনি একদিকে অত্যন্ত কঠোর হলেও, অন্যদিকে তিনি দয়া ও সহানুভূতির প্রতীক ছিলেন। তাঁর শাসনামলে গরিব, অসহায় এবং অত্যাচারিত মানুষের জন্য তিনি সদা সাহায্যপ্রবণ ছিলেন। তাঁর এই মানবিক গুণাবলীই তাঁকে ‘মানবপ্রেমিক’ হিসেবে খ্যাতি দিয়েছে।
আরও পড়ুনঃ জীবন বিনিময় কবিতার জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর