সোনার তরী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী” কবিতায় জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং মহাকালের স্রোতে সমস্ত কিছুর হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে কবি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এই পোস্টে সোনার তরী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।

সোনার তরী কবিতার মূলভাব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী” কবিতায় আত্মত্যাগ ও জীবনের গভীর দর্শন ফুটে উঠেছে। কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র এক নিঃসঙ্গ কৃষক, যিনি সোনার ফসল কাটার পর তার ছোটো খেতে বসে আছেন। চারপাশে ঘন মেঘ ও বর্ষায় সৃষ্ট খরস্রোতা নদী তার মনকে আতঙ্কিত করে তোলে। এমন সময় কৃষক দেখতে পান, সোনার নৌকায় এক মাঝি আসছে, আর তাকে দেখে তার মনে আশা জাগে। কৃষক মিনতি করে মাঝিকে তার ফসল নিয়ে যেতে। মাঝি ধান নিয়ে গেলেও ছোটো নৌকার সীমাবদ্ধতার জন্য সব কিছু নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে, কৃষক শূন্য হাতে ফিরে আসে এবং তার এই নিঃসঙ্গতা যেন তার বেদনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এখানে কবিতার প্রতিটি দৃশ্য আমাদের জীবনের রূপক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের সোনার ফসল আসলে তার জীবনের সংগ্রহের প্রতীক, আর মাঝি সেই মহাকালের প্রতিনিধি, যে আমাদের সঞ্চয় ও অর্জনকে একদিন নিজের করে নিয়ে চলে যায়। কবি বোঝাতে চেয়েছেন, জীবন কেবল সঞ্চয়ের জন্য নয় বরং ত্যাগের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য। আমাদের অস্তিত্ব একদিন মহাকালে মিলিয়ে যাবে, তবুও আমরা আমাদের সৃষ্টি রেখে যেতে পারি।

সোনার তরী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা

“গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।”

এই লাইনে বর্ণিত হয়েছে প্রকৃতির রুদ্ররূপ। আকাশে মেঘের গর্জন ও প্রবল বর্ষণের মধ্যে কৃষক একা বসে থাকে, যার মধ্যে কোনও ভরসা বা স্থিরতা নেই। এটি তার একাকিত্ব ও বিপদের সংকেত বহন করে।


“রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা-“

এই অংশে কবি কৃষকের সোনার ধানের সমৃদ্ধির কথা বলছেন, যা তার জীবনের প্রতীক। তবে প্রবল বর্ষণে নদী ক্ষুরের মতো ধারালো ও হিংস্র হয়ে উঠেছে, যা তার ফসলের জন্য হুমকি।


“কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা-“

কৃষক ধান কাটতে কাটতে বর্ষার শুরু হয়, আর সে নিজেই এক ছোটো খেতের মালিক, একা এবং অসহায়। এটি তার জীবনের সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জগুলির প্রতিফলন।


“চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসী-মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা”

চারপাশের বাঁকা জলে কৃষকের খেতকে ঘিরে রেখেছে। দূরে সে মেঘের আড়ালে এক গ্রাম দেখতে পায়, যা তার কাছে অধরা। এটি সেই আশা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যা তার জীবনে ধরা দিতে চায় না।


“গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।”

এখানে এক নৌকাওয়ালা তরী নিয়ে নদীর ওপার থেকে আসছে। কৃষক তাকে দেখে চেনার মতো অনুভব করে। এটি তার জীবনে আসা সুযোগ বা চেনা-অচেনা জীবনের সঙ্গীর প্রতি আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ।


“ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে-“

নৌকাটি ভরা পাল নিয়ে চলে যায় এবং পেছনে ফিরে চায় না। ঢেউগুলিও পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এটি সময়ের নিঃসংকোচ প্রবাহের প্রতীক, যা তার কোন কিছুর জন্য থামে না।


“ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।”

কৃষক নৌকাওয়ালার কাছে অনুরোধ করে তার তরীটি কূলে ভিড়ানোর জন্য। এটি তার জীবনের আকাঙ্ক্ষা এবং সময়কে ধরে রাখার প্রয়াসকে নির্দেশ করে।


“যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে-“

কৃষক বুঝতে পারে যে নৌকাটি তারই পথে চলে যাবে এবং সে যাকে খুশি তাকে সাহায্য করবে। তবে সে অনুরোধ করে তার সোনার ধান নিয়ে যেতে। এটি জীবনের অর্জনকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে।


“আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-পরে।”

এখানে কৃষক তার সম্পূর্ণ ধানের ভাণ্ডার নৌকায় তুলে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। এটি তার ত্যাগের প্রকাশ—তার জীবনের সঞ্চিত অর্জনকে ছেড়ে দেওয়ার প্রতীক।


“আর আছে— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে”

কৃষক তার সম্পূর্ণ ধানের সঞ্চয় শেষ করেছে। এতকাল যে ধান নিয়ে সে বেঁচে ছিল, সেই সোনার ধান সব দিয়ে দিতে সে প্রস্তুত। এটি তার জীবনের সংক্ষিপ্ততাকে মেনে নেওয়ার বহিঃপ্রকাশ।


“এখন আমারে লহো করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।”

কৃষকের জন্য তরীতে কোনও জায়গা নেই, কারণ তা সোনার ধানে পরিপূর্ণ। এটি জীবনকে আবারও আশাহত করে, যে জীবনের শেষে কিছুই তার জন্য অবশিষ্ট থাকে না।


“শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি-“

ঘন মেঘ ও বৃষ্টির মাঝে কৃষক নিঃসঙ্গ নদীর তীরে একাকী থেকে যায়। এটি সময়ের প্রবাহে আমাদের একাকিত্বের প্রতীক, যা সমস্ত কিছু শেষ করে ফেলে।


“যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।”

এই শেষ লাইনে নৌকাটি সমস্ত কিছু নিয়ে চলে যায়। এটি সেই সত্য প্রকাশ করে যে, জীবনের শেষে আমরা মহাকালের স্রোতে সব কিছু হারিয়ে ফেলি, শুধু থাকে অতীতের স্মৃতি।


Related Posts