শ দিয়ে সাহাবীদের নাম অর্থসহ তালিকা ও তাদের পরিচয়

সাহাবীদের জীবন এবং কার্যক্রম ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং মুসলিম সমাজে আদর্শ হিসাবে গৃহীত। এই পোস্টে শ দিয়ে সাহাবীদের নাম অর্থসহ তালিকা ও তাদের পরিচয় দিলাম।

শ দিয়ে সাহাবীদের নাম অর্থসহ

নিচে সাহাবীদের নাম অর্থসহ একটি টেবিল দেওয়া হলো:

ক্রমনামমূল নামনামের অর্থ
শাদাদ ইবনে আউসশাদাদসৌভাগ্যবান
শাম্মাস ইবনে উসমানশাম্মাসমহান
শিফা বিনতে আবদুল্লাহশিফাসুস্থতা বা স্বাস্থ্য
শুকরান সালেহশুকরানকৃতজ্ঞতা
শুজা ইবনে ওয়াহাবশুজাসাহসী
শুরাহবিল ইবনে হাসানাশুরাহবিলগণমান্য

শ দিয়ে সাহাবীদের নামের পরিচয়

১। শাদাদ ইবনে আউস (আরবি: شداد بن أوس)

পরিচিতি: শাদাদ ইবনে আউস ইসলামিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামের নবী মুহাম্মাদের সাহাবা এবং একজন প্রখ্যাত হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন। তার পিতার নাম ছিল আওস ইবনে সাবিত, তিনিও একজন সাহাবা। শাদাদ ইবনে আউস নেক আমল, নৈতিকতা ও আল-শাম সম্পর্কিত হাদিসের বর্ণনার জন্য সুপরিচিত। তিনি একটি হাদিসে উল্লেখ করেছেন:

“একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি নিজের জবাবদিহিতা সম্পর্কে সচেতন এবং মন্দ কাজ করা থেকে বিরত থাকেন। মৃত্যুর পরে পরকালে তার উপকারের জন্য ইহকালে মহৎ কাজ করেন; আর মূর্খ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি প্রলোভন ও আকাঙ্ক্ষার কাছে বশীভূত হয়ে যায় এবং আল্লাহর কাছে তার অযথা ইচ্ছা পূর্ণ করতে চায়।”

শাদাদ ইবনে আউস আল-শাম সম্পর্কিত আরও একটি হাদিসে বলেন:

“আল-শাম পরাভূত হবে এবং একই সাথে আল-কুদস (জেরুজালেম) পরাভূত হবে এবং আল্লাহ বাছাই করলে আপনি বা আপনার পুত্ররা সেখানে ইমাম হবেন।” (তাবারানি)

২। শাম্মাস ইবনে উসমান

শাম্মাস ইবনে উসমান (মৃত্যু ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ইসলামের একজন সাহাবা এবং সুদর্শন যুবক। তিনি উহুদের যুদ্ধে রাসুলের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। শাম্মাস মূল নাম, তবে তার প্রকৃত নাম উসমান। শাম্মাস অর্থ “অতিরিক্ত সূর্য কিরণ বিচ্ছুরণকারী”। তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু মাখযুম শাখার সন্তান। তার পিতা উসমান ও মাতা সাফিয়া বিনতু রাবিয়া। শাম্মাস ও তার মা ইসলামের প্রথম পর্বে নবী মুহাম্মদের দাওয়াতে ইসলাম গ্রহণ করেন। মুশরিকদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তারা হাবশায় হিজরত করেন, পরে মদিনায় চলে যান। শাম্মাস বদর ও উহুদ যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন। রাসূল (সাঃ) তাকে উহুদের শহীদদের কবরস্থানে দাফন করার নির্দেশ দেন। তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। শাম্মাস ইবনে উসমান ইসলামের ইতিহাসে একজন বীর ও আত্মত্যাগী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয়।

৩। আশ-শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রদিআল্লাহু আনহা)

আশ-শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রদিআল্লাহু আনহা) নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একজন নারী সাহাবা। তিনি চর্মরোগ চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু আদি শাখার সদস্য। তার ডাকনাম উম্মে সুলায়মান। পিতার নাম আবদুল্লাহ ইবনে আবদে শামস এবং মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আবি ওয়াহাব। শিফার স্বামী ছিলেন আবু হুসমা ইবনে হুযায়ফা। মক্কায় ইসলাম গ্রহণের পর তিনি প্রথম পর্বে মদিনায় হিজরত করেন। নবী (স) এর সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নবীর জন্য আলাদা বিছানা ও কাপড়ের ব্যবস্থা করতেন। শিফা খলিফা উমর (রদিআল্লাহু আনহু) এর চাচাত বোন ছিলেন এবং উমর তার মতামতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতেন।

শিফা একজন শিক্ষানুরাগী মহিলা ছিলেন এবং আরবের গুটিকয়েক শিক্ষিত মহিলাদের মধ্যে একজন। তিনি নবীর স্ত্রী হাফসা (রদিআল্লাহু আনহা) কে আরবি পড়ানো এবং চিকিৎসা শিখিয়েছিলেন। শিফা মোট ১২টি হাদিস বর্ণনা করেছেন, এবং তার পুত্র সুলায়মান ও অন্যান্য বিখ্যাত সাহাবি তার থেকে হাদিস গ্রহণ করেছেন। আশ-শিফা (র) এর মৃত্যু সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে অনেকের মতে তিনি উমর (র) এর খিলাফতের সময় ২০ হিজরির কাছাকাছি মৃত্যুবরণ করেন।

৪। শুকরান সালেহ

শুকরান সালেহ রাসুল মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একজন প্রখ্যাত সাহাবা এবং খাদেম ছিলেন। তাকে “শুকরান মাওলা” বা “রাসুলের আযাদকৃত দাস” নামেও পরিচিত। বদর যুদ্ধের পর রাসুল তাকে মুক্তি দেন। শুকরানের মূল নাম সালেহ, এবং তার উপাধি ‘শুকরান’। তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফের হাবশী বংশজাত দাস ছিলেন। তার পিতার নাম আদী। ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। শুকরান বিভিন্ন যুদ্ধে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ এবং বন্দীদের হেফাজতের দায়িত্ব পালন করতেন।

বদর যুদ্ধে তিনি দাস হিসেবে অংশগ্রহণ করেন এবং বন্দীদের দেখাশুনার জন্য কিছু অর্থ পেয়ে যান। বদর যুদ্ধে তার দক্ষতা দেখে রাসুল তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। মাররে ইয়াসী যুদ্ধে তিনি পরিত্যক্ত সম্পদ সংগ্রহের দায়িত্বেও নিয়োজিত ছিলেন। শুকরান রাসুলের খেদমতে দীর্ঘকাল নিবেদিত ছিলেন। রাসুল তার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্বে ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দেন। রাসুলের দাফন-কাফনের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং এই দায়িত্ব পালন করেন। আলী ইবন আবী তালিব ও অন্যান্য সাহাবিদের সাথে তিনি রাসুলকে কবরে শায়িত করেন। মৃত্যুর পর শুকরান মদিনা থেকে বসরা চলে যান, তবে এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।

৫। শুজা ইবনে ওয়াহাব

শুজা ইবনে ওয়াহাব ছিলেন ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একজন বিশিষ্ট সাহাবা। তিনি বদর এবং উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুহাম্মদের বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করেছেন। তার আসল নাম শুজা এবং ডাকনাম আবু ওয়াহাব। তিনি বনী আবদে শামস গোত্রের সদস্য ছিলেন।

শুজা ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হাবশায় হিজরত করেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি মক্কায় ফিরে আসেন এবং পরে মদিনায় হিজরত করেন। যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং হিজরী ৮ম সনে বনী হাওয়াযিনের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

মুহাম্মদ (স) তাকে গাসসানী শাসক হারেসের কাছে দাওয়াত নিয়ে পাঠান, যদিও হারেস দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। শুজা ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মুসাইলামা আল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৪০ বছর। শুজা ইবনে ওয়াহাব ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যার সাহস ও ত্যাগ আজও স্মরণীয়।

৬। শুরাহবিল ইবনে হাসানা (৫৮৩-৬৩৯)

শুরাহবিল ইবনে হাসানা, ডাকনাম আবু আবদিল্লাহ বা আবু আবদির রহমান, ছিলেন একজন বিশিষ্ট সাহাবা। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ এবং মাতা হাসানা, যিনি পরে সুফিয়ানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরে পরিবারসহ হাবশায় হিজরত করেন।

শুরাহবিলের জীবনকাল ছিল জিহাদের ময়দানে। তিনি হাদিস বর্ণনায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। খলিফা আবু বকর রা: তাঁকে মুসলিম বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নির্বাচন করেন। তিনি জর্দান, সিরিয়া এবং বসরার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইয়ারমুক যুদ্ধে তিনি অটল মনোবলে লড়াই করেন, যদিও রোমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে মুসলিম বাহিনীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।

৬৩৯ সালে আমওয়াসের প্লেগ মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে শুরাহবিল মারা যান। তাঁর জীবন ছিল এক নিবেদিত প্রাণ মুসলিম যোদ্ধার, যিনি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন।

Related Posts