বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন” প্রবন্ধটিতে বঙ্কিমচন্দ্র নবীন লেখকদের জন্য সাহিত্য সৃষ্টির মৌলিক নীতি ও আদর্শ সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই পোস্টে বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন মূলভাব ও প্রমিতরূপ লিখে দিলাম।
Table of Contents
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন মূলভাব
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই লেখায় নতুন লেখকদের জন্য মূল্যবান কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, লেখা শুরু করার পিছনে যেন খ্যাতি বা টাকার লোভ না থাকে, কারণ ভালো লেখা নিজেই যশ বয়ে আনে। তার মতে, লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দেশ বা মানবতার সেবা করা কিংবা শিল্পের সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। তিনি লেখকদের সত্য ও নৈতিকতার পথে থাকতে বলেন এবং পরনিন্দা বা স্বার্থসাধন থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করেন। লেখা শেষ করেই তাড়াহুড়ো করে ছাপানো উচিত নয়, বরং সময় নিয়ে বারবার সংশোধন করতে হবে। তিনি বিদ্যা জাহির করা, অহেতুক বিদেশি উদ্ধৃতি দেওয়া বা কৃত্রিম অলংকারের বিরুদ্ধে সতর্ক করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অলংকার হলো সরলতা। সোজা ভাষায় নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারাই সবচেয়ে বড় গুণ। অন্যের অনুকরণ না করে নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে এবং দায়িত্বশীল হয়ে কোনো কথা প্রমাণ ছাড়া লেখা যাবে না। সামগ্রিকভাবে, বঙ্কিমচন্দ্রের মূল বক্তব্য হলো সততা, দায়িত্ববোধ ও শৈল্পিক নিষ্ঠাই একজন লেখককে প্রকৃত মর্যাদার আসনে পৌঁছে দেবে।
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন প্রমিতরূপ (চলিত ভাষায়)
১। যশ বা খ্যাতির জন্য লিখবেন না। তাহলে যশও পাবেন না, লেখাও ভালো হবে না। লেখা ভালো হলে যশ নিজে থেকেই আসবে।
২। টাকার জন্য লিখবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে এবং টাকাও পায়, লেখাও ভালো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও সেই অবস্থা আসেনি। এখন শুধু অর্থের উদ্দেশ্যে লিখলে, শুধু পাঠকপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা প্রবল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষার স্তর বিবেচনা করে যদি শুধু তাদের খুশি করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে রচনা বিকৃত ও ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।
৩। যদি মনে করেন যে লিখে দেশের বা মানুষের কোনো মঙ্গল করতে পারেন অথবা কিছু সুন্দর সৃষ্টি করতে পারেন, তবেই লিখুন। যারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাদের যাত্রাওয়ালা ইত্যাদি নিচু স্তরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
৪। যা অসত্য, ধর্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা অপরকে কষ্ট দেওয়া বা শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধি যার উদ্দেশ্য—এ ধরনের রচনা কখনও ভালো ফল দেয় না, তাই একেবারেই বর্জনীয়। সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে লেখালেখি করা মহাপাপ।
৫। যা লিখবেন, তা হঠাৎ ছাপাবেন না। কিছুদিন রেখে দেবেন। কিছুদিন পরে সেটা সংশোধন করবেন। তাহলে দেখবেন, লেখায় অনেক ত্রুটি আছে। কবিতা, নাটক, উপন্যাস এক-দুই বছর রেখে দিয়ে তারপর সংশোধন করলে বিশেষ উন্নতি হয়। যারা পত্রিকা বা সাময়িকীর জন্য নিয়মিত লিখতে বাধ্য, তাদের পক্ষে এই নিয়ম মানা সম্ভব হয় না। তাই সাময়িক সাহিত্য লেখকের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৬। যে বিষয়ে কারও জ্ঞান বা অধিকার নেই, সে বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। এটি খুব সরল কথা, কিন্তু সাময়িক সাহিত্যে এই নিয়ম মানা হয় না।
৭। নিজের বিদ্যা জাহির করার চেষ্টা করবেন না। বিদ্যা থাকলে সেটা আপনা থেকেই প্রকাশ পাবে, চেষ্টা করতে হবে না। বিদ্যা দেখানোর চেষ্টা পাঠকের খুবই বিরক্তিকর এবং লেখার সৌন্দর্যের বিশেষ ক্ষতি করে। আজকাল প্রবন্ধে ইংরেজি, সংস্কৃত, ফরাসি, জার্মান উদ্ধৃতি বেশি দেখা যায়। আপনি যে ভাষা জানেন না, অন্যের বইয়ের সাহায্যে সে ভাষা থেকে কখনই উদ্ধৃতি দেবেন না।
৮। অলংকার বা মজার কথা বলার জন্য ব্যগ্র হবেন না। জায়গায় জায়গায় অলংকার বা ব্যঙ্গের দরকার হয় বটে; লেখকের ভাণ্ডারে এ সামগ্রী থাকলে, দরকার মতো আপনা থেকেই চলে আসবে—ভাণ্ডারে না থাকলে মাথা ঠুকে মরলেও আসবে না। অসময়ে বা খালি ভাণ্ডারে অলংকার বা রসিকতা করার চেষ্টার চেয়ে বাজে আর কিছু নেই।
৯। যেখানে অলংকার বা ব্যঙ্গ খুব সুন্দর বলে মনে হবে, সেটা কেটে দিতে হবে—এটি পুরোনো নিয়ম। আমি তা বলছি না। কিন্তু আমার পরামর্শ হলো, সেই অংশটি বন্ধুদের বারবার পড়ে শোনাবেন। যদি ভালো না হয়ে থাকে, তাহলে দুই-চারবার পড়লে লেখকের নিজেরই আর সেটা ভালো লাগবে না—বন্ধুদের কাছে পড়তে লজ্জা করবে। তখন সেটা কেটে দেবেন।
১০। সব অলংকারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অলংকার হলো সরলতা। যিনি সহজ কথায় নিজের মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। কারণ লেখার উদ্দেশ্যই হলো পাঠককে বোঝানো।
১১। কারও অনুকরণ করবেন না। অনুকরণ করলে দোষগুলোই অনুকরণ হয়, গুণগুলো হয় না। অমুক ইংরেজি বা সংস্কৃত বা বাংলা লেখক এভাবে লিখেছেন, আমিও এভাবেই লিখব—এ কথা কখনও মনে স্থান দেবেন না।
১২। যে কথার প্রমাণ দিতে পারবেন না, সে কথা লিখবেন না। প্রমাণ সব সময় লেখার সঙ্গে দিতে হয় না, কিন্তু হাতে প্রমাণ রাখতে হবে।
১৩। বাংলা সাহিত্য, বাংলার ভরসা। এই নিয়মগুলো বাংলার লেখকরা মেনে চললে, বাংলা সাহিত্যের উন্নতি দ্রুত হতে থাকবে।