প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা

‘প্রতিদান’ কবিতায় জসীমউদ্দীন ক্ষুদ্র স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে পরার্থপরতার মধ্যেই যে ব্যক্তির প্রকৃত সুখ ও জীবনের সার্থকতা নিহিত সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এই পোস্টে প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।

প্রতিদান কবিতার মূলভাব

‘প্রতিদান’ কবিতাটি কবি জসীমউদ্দীনের ‘বালুচর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। জসীম উদ্দীনের “প্রতিদান” কবিতায় কবি এমন এক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন যেখানে নিজের কষ্ট ও আঘাতের পরেও প্রতিশোধের পরিবর্তে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। কবি আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও অনিষ্টকারীর জন্য ভালো কিছু করতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের প্রকৃত সুখ ও শান্তি ত্যাগ এবং পরোপকারের মধ্যেই রয়েছে। সমাজের হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে সুন্দর, নিরাপদ পৃথিবী গড়া সম্ভব, আর সেটাই কবির আকাঙ্ক্ষা।

প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

জসীম উদ্দীনের “প্রতিদান” কবিতাটি হৃদয়স্পর্শী মানবিকতার প্রতীক, যেখানে কবি প্রতিশোধের পরিবর্তে ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে জীবনকে মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন। নিচে প্রতিদান কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন করে দিলাম।

১) আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,

ব্যাখ্যা: কবি এখানে ব্যক্ত করছেন যে যিনি তার ঘর ভেঙেছেন, অর্থাৎ তার জীবনকে আঘাত দিয়েছেন, সেই ব্যক্তির জন্যই তিনি ত্যাগ করছেন। কবি প্রতিশোধ না নিয়ে ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে তার ক্ষতিগ্রস্ত হৃদয় গড়ে তুলতে চেয়েছেন।

২) আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

ব্যাখ্যা: যে ব্যক্তি কবিকে পর করে দিয়েছে, দূরে সরিয়ে দিয়েছে, কবি তাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। এই লাইনটি বোঝায়, কবি তাকে আপন করতে ব্যাকুল, এমনকি তিনি কেঁদে কেঁদে চেষ্টা করেছেন সেই মানুষটিকে আবার আপন করে নিতে।

৩) যে মোরে করিল পথের বিরাগী- পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,

ব্যাখ্যা: যে কবিকে সমাজে একা, পরিত্যক্ত করে দিয়েছে, কবি তার জন্যই পথে পথে ঘুরেছেন, কষ্ট করেছেন। এখানে কবি বোঝাচ্ছেন যে নিজের দুঃখ ভুলে সেই ব্যক্তির কল্যাণের জন্যই তিনি বিচরণ করেছেন।

৪) দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;

ব্যাখ্যা: সেই মানুষটি, যিনি কবির শান্তি কেড়ে নিয়েছেন, কবি তার জন্য রাত্রের পর রাত্রি জেগে থেকেছেন। কবি নিজের কষ্টগুলো সত্ত্বেও অন্যের জন্য ভাবেন, তার জন্যই নিজের শান্তির ত্যাগ।

৫) আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,

ব্যাখ্যা: কবির জীবনের ভিত্তি ভেঙে দিয়েছে যে, কবি সেই মানুষের জন্যই আবার তার ক্ষতিগ্রস্ত জীবনকে নির্মাণ করেছেন। এর মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে অন্যের জন্য আত্মত্যাগ করা কতটা মহৎ কাজ।

৬) যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।

ব্যাখ্যা: যিনি কবিকে বেদনায় ডুবিয়েছেন, তার জন্যই কবি কেঁদেছেন। তিনি সেই ব্যক্তির ভালো চেয়েছেন, যিনি তার জীবনে কষ্ট দিয়েছেন।

৭) যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ, আমি দেই তারে বুকভরা গান,

ব্যাখ্যা: যে তাকে বিষাক্ত বাণ (আঘাত বা কষ্ট) দিয়েছে, কবি তাকে ভালোবাসা দিয়ে উত্তর দিয়েছেন। বিষের বদলে তিনি হৃদয় থেকে গান বা স্নেহময়তা তুলে ধরেছেন।

৮) কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর,

ব্যাখ্যা: যে তাকে কাঁটা দিয়েছে, কবি তাকে ফুল দিয়ে উত্তর দিয়েছেন। অর্থাৎ, জীবনের কাঁটাগুলোকে ভালোবাসা ও সহানুভূতির ফুলে রূপান্তরিত করেছেন।

৯) আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

ব্যাখ্যা: আবারও কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে যে তাকে পর করেছে, তাকে আপন করতে তিনি সবরকম চেষ্টা করেছেন, এমনকি তার জন্য কাঁদতেও পিছপা হননি।

১০) মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি

ব্যাখ্যা: যে কবির হৃদয়ে কবর, অর্থাৎ শূন্যতা, দুঃখ বেঁধে দিয়েছে, কবি সেই ব্যক্তির হৃদয়ে সোহাগ বা ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করেছেন।

১১) রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ান ফুল মালঞ্চ ধরি।

ব্যাখ্যা: কবি সেই আঘাতকে স্নেহময় ফুলের মালায় জড়িয়েছেন। তিনি বুঝিয়েছেন, তার হৃদয়ে আঘাত দিয়ে তাকে আরও সুন্দর কিছু গড়ে তুলতে শিখিয়েছে।

১২) যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী, আমি লয়ে করে তারি মুখখানি,

ব্যাখ্যা: যে তাকে কঠিন কথা বলেছে, তার মুখের কঠোরতা কবি ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করেছেন। তিনি কঠিন কথার জবাব ভালোবাসা দিয়ে দিয়েছেন।

১৩) কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি সাজাই নিরন্তর-

ব্যাখ্যা: কবি নিজের সম্পদ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা সবকিছু দিয়ে সেই আঘাতকারীকে সাজিয়েছেন, অর্থাৎ তার জীবনের শূন্যতা পূরণ করেছেন।

১৪) আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

ব্যাখ্যা: শেষ চরণে আবারও কবি জানিয়েছেন, যিনি তাকে পর করেছে, কবি তাকে আপন করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছেন।

Related Posts

Leave a Comment