ঋতু বর্ণন কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

আলাওলের ‘ঋতু বর্ণন’ কবিতাটি বাংলার প্রকৃতি ষড়ঋতুর পরিবর্তনে এক অনন্য রূপ ফুটে উঠেছে। বসন্তের প্রাণময়তা, গ্রীষ্মের দহন, বর্ষার সজীবতা, শরতের নির্মলতা, হেমন্তের পরিপূর্ণতা এবং শীতের নীরব শীতলতা এসব ঋতুর বৈশিষ্ট্য তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এই পোস্টে ঋতু বর্ণন কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন লিখে দিলাম।

ঋতু বর্ণন কবিতার মূলভাব

আলাওলের ‘ঋতু বর্ণন’ কবিতায় কবি প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর সৌন্দর্য ও সহজ চিত্রময় ভাষায় তুলে ধরেছেন। প্রথমে বসন্ত ঋতুর কথা বলা হয়েছে, যখন গাছে গাছে নতুন পাতা ও কুঁড়ি ফুটে প্রকৃতি নতুন রূপ ধারণ করে। দক্ষিণ দিকের শীতল বাতাস মানুষের মনে প্রেম ও আনন্দের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। পলাশ, মল্লি, লবঙ্গ, সুরঙ্গের মতো ফুলে বনভূমি রঙিন ও সুগন্ধে ভরে ওঠে। কোকিলের ডাক ও ভ্রমরের গুঞ্জনে প্রকৃতি সংগীতময় হয়ে ওঠে। এই দৃশ্য ও শব্দ যুবকদের মনে গভীর আবেগ সৃষ্টি করে। মানুষ ফুলের মালা পরে ও রঙিন পোশাক পরে আনন্দে মেতে ওঠে। এরপর কবি গ্রীষ্ম ঋতুর কথা বলেছেন, যখন প্রচণ্ড রোদ ও গরমে মানুষ কষ্ট পায়। তীব্র রোদের ভয়ে সবাই ছায়ার আশ্রয় নেয়। তবে চন্দন ও শীতল বাতাস কিছুটা স্বস্তি দেয়। তারপর বর্ষা ঋতুর আগমন ঘটে মেঘের গর্জন ও বজ্রধ্বনির সঙ্গে। চারদিকে অজস্র বৃষ্টি নেমে প্রকৃতি জলমগ্ন হয়ে ওঠে। বজ্রধ্বনিকে কবি মল্লার রাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সব মিলিয়ে কবিতাটিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য, পরিবর্তন ও মানুষের অনুভূতির গভীর সম্পর্ক সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

ঋতু বর্ণন কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

প্রথমে বসন্ত ঋতু নবীন পল্লব।
কবি প্রথমে বসন্ত ঋতুর কথা বলেছেন। বসন্ত এলে গাছপালায় নতুন নতুন কচি পাতা গজায়। চারদিক সবুজে ভরে ওঠে। প্রকৃতি যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। বসন্তকে তাই নবজাগরণের ঋতু বলা হয়।

দুই পক্ষ আগে পাছে মধ্যে সুমাধব।
বসন্ত ঋতুর মাঝামাঝি সময়টি খুব সুন্দর ও মনোরম। এই সময়টাকে বলা হয়েছে ‘সুমাধব’, অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বসন্তকাল। তখন প্রকৃতি সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয় এবং মানুষের মন আনন্দে ভরে ওঠে।

মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
দক্ষিণ দিক থেকে আসা মৃদু ও শীতল বাতাস বইতে থাকে। এই বাতাসকে কবি কামদেবের দূত বা সৈনিক বলেছেন। কারণ এই বাতাস মানুষের মনে প্রেম ও ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি ॥
এই বাতাসের প্রভাবে বনস্পতিগুলোতে কুঁড়ি ফুটতে শুরু করে। যেসব গাছে সাধারণত ফুল ফোটে না, সেগুলিও যেন প্রাণ ফিরে পায়। প্রকৃতি ধীরে ধীরে সাজতে থাকে।

কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
পলাশ গাছে লাল ফুল ফুটে পুরো বনকে লাল রঙে রাঙিয়ে তোলে। ঘন বনে আগুনের মতো লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তের সৌন্দর্য আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল ॥
সুরঙ্গ, মল্লি, লবঙ্গ প্রভৃতি ফুল ফুটে চারপাশে রঙ ও গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। আবির বা গুলালের মতো রঙিন পরিবেশ তৈরি হয়। প্রকৃতি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।

ভ্রমরের বাঙ্কার কোকিল কলরব।
ভ্রমররা গুঞ্জন করতে থাকে এবং কোকিল মধুর কণ্ঠে ডাকতে শুরু করে। এই সব শব্দে প্রকৃতি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। চারদিকে যেন সংগীত বাজতে থাকে।

শুনিতে যুবক মনে জাগে অনুভৱ ৷
এই সুন্দর শব্দ ও দৃশ্য যুবকদের মনে নানা রকম আবেগ ও অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। তাদের মনে প্রেম, আনন্দ ও কল্পনার জন্ম হয়। বসন্ত মানুষের মনকে নরম করে দেয়।

নানা পুষ্প মালা গলে বড় হরষিত ।
মানুষ ফুলের মালা গলায় দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। সবাই খুব খুশি থাকে। বসন্ত উৎসবের মতো মানুষের জীবনে আনন্দ বয়ে আনে।

বিচিত্র বসন অঙ্গে চন্দন চৰ্চিত ৷
মানুষ রঙিন পোশাক পরে এবং শরীরে চন্দনের প্রলেপ দেয়। এতে শরীর শীতল হয় এবং মনও শান্ত থাকে। বসন্তে সাজগোজ করার আনন্দ দেখা যায়।

নিদাঘ সমএ অতি প্রচণ্ড তপন।
এরপর কবি গ্রীষ্ম ঋতুর কথা বলেছেন। এই সময় প্রচণ্ড রোদ পড়ে এবং গরম খুব বেড়ে যায়। মানুষ ও প্রকৃতি দুটোই কষ্ট পায়।

রৌদ্র ত্রাসে রহে ছায়া চরণে সরণ ॥
তীব্র রোদের ভয়ে মানুষ ছায়ার আশ্রয় নেয়। গাছের তলায় বা ঘরের ভেতরে থাকতে চায়। রোদ থেকে বাঁচাই তখন মানুষের প্রধান লক্ষ্য।

চন্দন চম্পক মাল্য মলয়া পবন।
এই সময় চন্দন, চম্পক ফুল ও শীতল বাতাস মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। প্রকৃতি যেন গ্রীষ্মের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করে।

সতত দম্পতি সঙ্গে ব্যাপিত মদন ৷৷
গ্রীষ্মেও প্রেমের দেবতা মদন মানুষের জীবনে উপস্থিত থাকে। দম্পতিরা একসঙ্গে সময় কাটায়। প্রকৃতির কষ্টের মধ্যেও ভালোবাসা থাকে।

পাবন সময় ঘন ঘন গরজিত।
এরপর বর্ষা ঋতু আসে। আকাশে ঘন ঘন মেঘ গর্জন করে। বজ্রপাতের শব্দে চারদিক মুখরিত হয়।

নির্ভয়ে বরিষে জল চৌদিকে পূরিত ৷
বর্ষায় ভয় না পেয়ে অজস্র বৃষ্টি নামে। চারদিক জল দিয়ে ভরে যায়। খাল, বিল, নদী সব পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

ঘোর শব্দে কৈলাসে মল্লার রাগ গাত্র।
বজ্রধ্বনিকে কবি মল্লার রাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মনে হয় যেন কৈলাস পর্বতে প্রকৃতি নিজেই মল্লার রাগ গাইছে। বর্ষার ভয়ংকর অথচ সুন্দর রূপ এখানে ফুটে উঠেছে। কোন পরিবর্তন না করে কবিতার লাইনগুলো শুধু বোল্ড করে দিন

আরও পড়ুনঃ

ঋতু বর্ণন কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর

ঋতু বর্ণন কবিতার MCQ | বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর

Related Posts

Leave a Comment