রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে “নারীরা পুরুষের অর্ধাঙ্গ নয়, তারা পুরুষের সমান এবং স্বতন্ত্র মানুষ। নারীকে শিক্ষা, সম্পত্তি ও সম্মানে সমান অধিকার দিতে হবে। তবেই সমাজ সত্যিকারের উন্নতি করবে।” এই পোস্টে অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের মূলভাব সহজ ভাষায় লিখে দিলাম।
অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের মূলভাব
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে আমাদের সমাজের একটি বড় সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, তা হলো নারী-পুরুষের অসাম্য। তিনি বলেছেন, সমাজ নারীকে পুরুষের অর্ধেক বা অসম্পূর্ণ অংশ মনে করে, যেমন একটি গাড়ির এক চাকা বড় ও এক চাকা ছোট হলে তা সোজা পথে চলতে পারে না। নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তি ও মর্যাদায় পুরুষের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে, যার ফলে সমাজের অগ্রগতিও ব্যাহত হচ্ছে। শুধু বাইরের পর্দা তুলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, নারীর মন থেকে দাসত্বের মানসিকতা দূর করতে হবে। রামচন্দ্র সীতাকে কতটা ভালোবাসলেও শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছা বা সম্মানকে গুরুত্ব দেননি, এটা নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিরই উদাহরণ। নারীকে শুধু রান্নাঘর বা সেলাইয়ের কাজে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, তাকে বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই শিক্ষিত হতে হবে। কারণ একজন শিক্ষিত মাই তো শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলবে। আইনে নারী পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তারা তা পায় না, এমনকি পরিবারের স্নেহ-যত্নেও বৈষম্যের শিকার হয়। নারী যদি মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বাধীন হয় এবং সমান সুযোগ পায়, তাহলে সে পুরুষের পাশাপাশি সমাজ গঠনে সমান ভূমিকা রাখতে পারবে। রোকেয়ার মূল কথা হলো, নারী-পুরুষকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোদ্ধা হিসেবে দেখতে হবে এবং দুজনকে সমান শক্তিশালী করেই কেবল একটি সুস্থ ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের মূলভাব বড় করে
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের “অর্ধাঙ্গী” প্রবন্ধটি আসলে আমাদের সমাজের সেই চিরচেনা চিত্রই তুলে ধরেছে যেখানে নারীরা পুরুষের “অর্ধেক” বা অসম্পূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য হয়। রোকেয়া বলতে চেয়েছেন, নারী-পুরুষকে যদি একটি মানবদেহের দুটি অঙ্গ হিসাবে ভাবি ডান দিক পুরুষ, বাম দিক নারী। তাহলে আজকের সমাজে সেই দেহটিই বিকলাঙ্গ। একদিক শক্তিশালী, দীর্ঘ, শিক্ষিত; অন্যদিক দুর্বল, খর্ব, অশিক্ষিত। এমন দেহ দিয়ে কি সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা এগিয়ে চলা সম্ভব?
প্রবন্ধটি যেসব দিক তুলে ধরেছেঃ
১. নামে “অর্ধাঙ্গ”, কিন্তু বাস্তবে “সম্পূর্ণ উপেক্ষিত”
- আইনে নারীরা পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি পাবার কথা, কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই পায় না বা নামমাত্র পায়।
- পিতার স্নেহ-যত্নেও একই বৈষম্য: ছেলেকে ভালো স্কুল-টিউশন, মেয়েকে শুধু বাড়িতে পড়া।
- শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই: ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ে, মেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই বঞ্চিত।
২. শারীরিক পর্দা নয়, “মানসিক পর্দা”ই আসল সমস্যা
- অনেক নারী বাইরে পর্দা ছেড়েছেন, কিন্তু মন এখনও পরনির্ভরশীল। তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান, সব ক্ষেত্রে স্বামী বা পুরুষের মতামতই চূড়ান্ত।
- রোকেয়া বলেছেন, পুরুষেরা নারীকে পুতুল ভাবে। সেই পুতুলকে খুব আদরও করা যায়, আবার রাগ হলে ফেলে দিতেও পারেন। রাম-সীতার উদাহরণ দিয়েছেন: রাম সীতাকে খুব ভালোবাসলেও শেষ পর্যন্ত অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করলেন। এখানে সীতার নিজের ইচ্ছা বা সম্মানের কোনো মূল্য ছিল না।
৩. নারীশিক্ষার গুরুত্ব
- রোকেয়া বলেছেন, নারীকে শুধু রান্না-সেলাই শেখালে চলবে না। তাদেরও বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি সব বিষয়ে শিক্ষা দরকার।
- কারণ, মায়েরাই আগামী প্রজন্ম গড়ে তোলে। একজন অশিক্ষিত মা কখনও শিক্ষিত ও মর্যাদাশীল সন্তান গড়ে তুলতে পারবে না।
- তিনি বলেছেন, নারী যদি শিক্ষিত হয়, তবে সে পুরুষের সহধর্মিণী হবে, শুধু গৃহিণী নয়। তারা জীবনের সব ক্ষেত্রে একসাথে পাশাপাশি চলতে পারবে।
৪. সমাজের বিকলাঙ্গতা
- নারী-পুরুষ সমাজের দুটি চাকা। একটি চাকা বড়, অন্যটি ছোট হলে গাড়ি কখনও সোজা চলতে পারে না। এটা শুধু একই জায়গায় ঘুরতে থাকে।
- ভারতবর্ষ কেন পিছিয়ে আছে? কারণ সমাজের অর্ধেক জনশক্তি (নারী) পিছিয়ে রাখা হয়েছে।
- তিনি বলেছেন, নারীরা যদি শিক্ষা ও সুযোগ পায়, তাহলে তারাও দেশ গড়তে পুরুষের সমান ভূমিকা রাখতে পারে।
৫. সমাধানের পথ
- নারীকে মানসিকভাবে স্বাধীন করতে হবে। নিজের মতামত দিতে, সিদ্ধান্ত নিতে শেখাতে হবে।
- শিক্ষায় সমান অধিকার দিতে হবে। নারীকে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত করতে হবে।
- সম্পত্তিতে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
- পুরুষদেরও বুঝতে হবে যে নারী তাদের সহযোদ্ধা, শুধু সেবিকা বা পুতুল নয়।
রোকেয়ার শেষ কথাঃ
“আমরা পুরুষের অর্ধাঙ্গ নই, আমরা তাদের সমান এবং স্বতন্ত্র মানুষ। আমাদের শিক্ষা, সম্মান ও অধিকার দিন। তবেই আমরা দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিতে পারব।”