রেইনকোট গল্পের অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “রেইনকোট” গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। নুরুল হুদা চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক যে ভীতি, দ্বিধা এবং বিবেকের যাত্রা প্রকাশ করেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পোস্টে রেইনকোট গল্পের অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা দিলাম।

রেইনকোট গল্পের অনুধাবন প্রশ্ন

১। ক্রাক ডাউনের রাতে কী ঘটেছিল?

‘ক্রাক ডাউনের’ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে, তারা নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, যা ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ রাতটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অমানবিকভাবে গণহত্যা চালায়।

২। “যেন বৃষ্টি পড়ছে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর” – বাক্যটি বুঝিয়ে লেখ।

এই বাক্যটি মিন্টুর রেইনকোট পরা অবস্থায় নুরুল হুদার ওপর পাকিস্তানি মিলিটারিদের নির্মম অত্যাচারকে বোঝায়। নুরুল হুদা, যিনি কলেজের শিক্ষক, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে মিলিটারির হাতে ধরে পড়েন। এক পর্যায়ে, তাকে চাবুকের আঘাত করা হয়, এবং এই আঘাতের তীব্রতা বোঝাতে মিন্টুর রেইনকোটের ওপর বৃষ্টির মতো আঘাতের তুলনা করা হয়। এখানে বৃষ্টির প্রতীকী ব্যবহার তার উপর অত্যাচারের অসহনীয়তা এবং দ্রুততার প্রতিফলন।

৩। “রাশিয়ায় ছিল জেনারেল উইনটার, আমাদের জেনারেল মনসুর” – ব্যাখ্যা কর।

এই উক্তিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার প্রচণ্ড শীতের কারণে হিটলারের বাহিনীর পরাজয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিপদজনক পরিস্থিতির তুলনা করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বর্ষার দুর্যোগে পড়েছিল, তখন তাদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। লেখক এই উক্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শত্রুদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীর পতনের সঙ্গে সমান্তরাল।

৪। “আব্বু ছোটমামা হয়েছে” ছোট মেয়ের এ উক্তিতে প্রফেসর কেন চমকে ওঠেন?

ছোট্ট মেয়ের এই উক্তিতে প্রফেসর চমকে ওঠেন কারণ তিনি ভেবেছিলেন, তার শ্যালক মিন্টু আবার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। মিন্টু একজন মুক্তিযোদ্ধা, এবং যখন তিনি কলেজে যাওয়ার সময় তার রেইনকোট গায়ে দেন, তখন মেয়ের এই কথা শুনে প্রফেসরের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। মেয়ের কথা শুনে তিনি বুঝতে পারেন, মিন্টু বাড়িতে এসেছে, যা বাড়িতে মিলিটারির আগমনের সংকেত হিসেবে ধরা হয়।

৫। “এগুলো হলো পাকিস্তানের শরীরের কাঁটা” – উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।

এই উক্তিটি শহিদ মিনার সম্পর্কে পাকিস্তানি মিলিটারির কর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রিন্সিপাল ডক্টর আফাজ আহমদ বলেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর হিসেবে তাদের সহযোগিতা করতেন। শহিদ মিনারগুলো বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রতীক, তাই তিনি পাকিস্তানি কর্তাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, “পাকিস্তানকে বাঁচাতে হলে শহিদ মিনারগুলো অপসারণ করা উচিত। এগুলো পাকিস্তানের শরীরের কাঁটা।” এই কথার মাধ্যমে তার দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা প্রতিফলিত হয়েছে।

৬। নুরুল হুদার স্ত্রী কেন বাড়ি পাল্টানোর জন্য হন্যে হয়ে লেগে গেলেন?

নুরুল হুদার স্ত্রী বাড়ি পাল্টানোর জন্য হন্যে হয়ে গেলেন কারণ পাশের ফ্ল্যাটের এক মহিলা মিন্টুর খোঁজ করলে, তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। মিন্টু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুক্ত থাকায়, তার ভগ্নিপতির দুশ্চিন্তা ছিল। মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করলে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে, এই ভেবে তিনি বাড়ি পাল্টানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এই প্রেক্ষাপটে, মিন্টুর পরিচয়ই তাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

রেইনকোট গল্পের অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর

৭। “ক্যাপ্টেনের এদিকে তাকে ঠেলা মুশকিল” – কেন?

উত্তর: “ক্যাপ্টেনের এদিকে তাকে ঠেলা মুশকিল” উক্তিটি ইসহাক মিয়ার দাপট বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসহাক মিয়া পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। সে নিজেকে কর্নেল বা লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মতো ভাবতে শুরু করে, অথচ ক্যাপ্টেনের নিচের পদে তাকে ভাবা সম্ভব নয়। এ কারণে, তার দাপট এত বেড়ে গেছে যে তাকে ঠেলা দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

৮। নুরুল হুদাকে এক্সট্রা তটস্থ থাকতে হয় কেন?

উত্তর: মিন্টু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ফলে নুরুল হুদাকে অতিরিক্ত তটস্থ থাকতে হয়। নুরুল হুদা ভীরু প্রকৃতির একজন মানুষ, যিনি দেশকে খুব ভালোবাসেন কিন্তু ভয়ের কারণে তা প্রকাশ করতে পারেন না। তার শ্যালক মিন্টু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায়, হানাদার বাহিনী এ খবর জানতে পারলে তার বিপদ ঘটতে পারে, তাই তিনি সবসময় উদ্বেগে থাকেন।

৯। ‘রেইনকোট’ গল্পে ‘মিসক্রিয়ান্ট’ শব্দটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে?

উত্তর: ‘রেইনকোট’ গল্পে ‘মিসক্রিয়ান্ট’ শব্দটি মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ দুষ্কৃতিকারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনী এই শব্দটি মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার জন্য ব্যবহার করেছিল। তাই লেখক এ শব্দটি ব্যবহার করে যুদ্ধের সময়কার সামাজিক বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন।

১০। নুরুল হুদা কেন চারবার বাড়ি পাল্টায়?

উত্তর: নুরুল হুদা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক গোপন রাখতে চারবার বাড়ি পাল্টান। তার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে, যা হানাদার বাহিনী জানতে পারলে বিপদে পড়তে পারে। সেজন্য তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন ঠিকানায় চলে যান, যাতে আশপাশের লোকেরা তাকে চিনতে না পারে।

১১। ইসহাক মিয়ার দাপট বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষ অবলম্বন করায় ইসহাক মিয়ার দাপট বেড়ে যায়। সে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ছিল, এবং তারা তাকে সমর্থন করত। ফলে সে অবাধে চলাফেরা করত এবং সব সময় উর্দুতে কথা বলত। এ কারণে সবাই তাকে ভয় পেত, যা তার ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

১২। প্রিন্সিপাল কেন দিনরাত দোয়া-দরুদ পড়ত?

উত্তর: প্রিন্সিপাল পাকিস্তানিদের জন্য দিনরাত দোয়া ও দরুদ পড়তেন। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের মঙ্গল কামনা করতেন। তার বিশ্বাস ছিল, পাকিস্তানিদের জয়ের জন্য দোয়া করা উচিত, এবং তাই তিনি প্রতিদিন দোয়া-দরুদ পড়ে যেতেন।

১৩। নুরুল হুদা কেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাটের নিচে শুয়েছিলেন?

উত্তর: মিলিটারিদের ভয়ে নুরুল হুদা পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাটের নিচে শুয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতন চালাত। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষ নানা কৌশল অবলম্বন করেছিল। সেই পরিস্থিতিতে, নুরুল হুদা রাতভর ট্যাংকের হুঙ্কার এবং মেশিনগানের গুলি থেকে বাঁচতে পরিবারকে নিয়ে খাটের নিচে আশ্রয় নেন। আতঙ্কিত হয়ে জীবন রক্ষার জন্য এটি তার একটি কৌশল ছিল।

১৪। মিলিটারি প্রাদুর্ভাবের পর পিওনকে দেখে সবাই তটস্থ থাকত কেন?

উত্তর: যুদ্ধের সময় প্রিন্সিপালের পিওন ইসহাক মিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে সবাই তাকে দেখে তটস্থ থাকত। ‘রেইনকোট’ গল্পে দেখা যায়, ইসহাক উর্দু বলার মাধ্যমে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। লেখক ব্যঙ্গাত্মকভাবে উল্লেখ করেন, “ইসহাক নিজেই এখন মিলিটারির কর্নেল বললেও চলে।” যদিও আসলে তার ক্ষমতা কর্নেলের সমান নয়, তবে ক্যাপ্টেনের নিচে নামানো সম্ভব নয়। এই কারণে মিলিটারি প্রাদুর্ভাবের পর তাকে দেখলে সবাই সতর্ক হয়ে যেত।

১৫। নুরুল হুদা অনেক সুরা মুখস্থ করেছে কেন?

উত্তর: নুরুল হুদা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেকে মুসলিম হিসেবে প্রমাণ করার জন্য অনেক সুরা মুখস্থ করেছে। ‘রেইনকোট’ গল্পে পাকিস্তানি বাহিনী বিশেষভাবে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যা করছিল, এবং মুসলিমদের কালেমা ও সুরা পাঠ করিয়ে রেহাই দেওয়া হত। এই পরিস্থিতিতে, নুরুল হুদা পাকবাহিনীর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঁচতে সুরা মুখস্থ করে, যাতে তিনি সংকটময় সময়ে নিরাপদ থাকতে পারেন।

১৬। “এদিককার মানুষ চোখে খালি নৌকা দেখে, নৌকা ভরা অস্ত্র”- উক্তিটিতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর: এই উক্তিটি মুক্তিবাহিনীর তৎপরতাকে নির্দেশ করে। মিলিটারি অভিযান শুরু হলে নুরুল হুদা চারবার বাড়ি পরিবর্তন করে, এবং তার নতুন বাড়ির সামনে বিল ও ধানখেত দেখা যায়। এই বিল দিয়ে মুক্তিবাহিনী অস্ত্র নিয়ে আসতো, যা সাধারণ মানুষের চোখে খালি নৌকা হিসেবে ধরা পড়ত। এভাবে, মানুষের চোখে নৌকা ভরা অস্ত্রের অস্তিত্ব লুকিয়ে থাকত, যা মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয়।

১৭। পিয়নকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছা করেছিল কেন?

উত্তর: পিয়নের মুখ দেখার পর পাকিস্তানি মিলিটারির ভয় কেটে যাওয়ায় কথকের তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছা করেছিল। দরজায় প্রবল কড়া নাড়ার শব্দে কথক হানাদার বাহিনীর আতঙ্কে শিউরে ওঠেন। বিপদের সময়ে মুসলমান রীতি অনুসারে তিনি দোয়া পড়েন। দরজা খুলে দেখতে পান, সেখানে হানাদার নয়, বরং প্রিন্সিপালের পিয়ন। এ পরিস্থিতিতে ভয় কাটিয়ে পিয়নকে কাছে পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন।

১৮। রেইনকোট পরার পর থেকে নুরুল হুদার পা কেন শিরশির করতে থাকে? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: রেইনকোট পরার পর নুরুল হুদার অনুভূতির পরিবর্তন ঘটে, ফলে তার পা শিরশির করতে থাকে। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ভয় পান, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার রেইনকোট পরার মাধ্যমে তার মধ্যে সাহসের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এই পরিবর্তন তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, যার ফলস্বরূপ তার পা শিরশির করতে শুরু করে।

১৯। “এদিককার মানুষ চোখে খালি নৌকা দেখে, নৌকা ভরা অস্ত্র”-ব্যাখ্যা দাও।

উত্তর: এই উক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলারা সাহসী ভূমিকা পালন করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে হামলা চালাত। নুরুল হুদা গেরিলাদের নৌকা দিয়ে অস্ত্র বহনের দৃশ্য দেখে, যা তার মনে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।

২০। ‘রেইনকোট’ গল্পে রাস্তায় মিলিটারিরা গাড়ি থামায় কেন?

উত্তর: মিলিটারিরা সন্দেহভাজন মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করার উদ্দেশ্যে রাস্তায় গাড়ি থামায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি করত। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় সাধারণ যাত্রীদের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ত, তাই সন্দেহভাজন মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য মিলিটারিরা গাড়ি থামাত।

Related Posts

Leave a Comment