ঐকতান কবিতার প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা

‘ঐকতান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের অপূর্ণতা, বিশ্বমানবতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা, এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগের অভাব নিয়ে গভীর আত্মসমালোচনা করেছেন। এই পোস্টে ঐকতান কবিতার প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।

ঐকতান কবিতার প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঐকতান’ কবিতার প্রতিটি চরণ কবির গভীর আত্মজিজ্ঞাসা এবং মানবিক বোধকে প্রকাশ করে। এখানে ঐকতান কবিতার প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১) “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।”

এই চরণে কবি বিশাল পৃথিবীর অসীমতা এবং নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করছেন। তিনি আক্ষেপ করছেন যে, পৃথিবীর অনেক কিছু তাঁর অজানা রয়ে গেছে। কবি অনুভব করছেন, যত বড় এই পৃথিবী, তার কত অল্পই তিনি জানতে পেরেছেন।

২) “দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-“

কবির চোখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, শহর, এবং রাজধানীগুলো অজানা থেকে গেছে। তিনি মনে করছেন, পৃথিবীর বহু শহর-রাজধানীর মানুষ ও তাদের জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ পাননি, যা তাঁর জন্য এক দুঃখজনক বিষয়।

৩) “মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,”

মানুষের অর্জন, প্রকৃতির বিশালতা, নদী, পর্বত, সাগর, এবং মরুভূমির মতো জায়গাগুলোর সৌন্দর্য ও কীর্তি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান সীমিত রয়ে গেছে। কবি মনে করছেন, এই সবকিছু অনুভব করা এবং সেগুলোর সান্নিধ্যে আসা তাঁর ভাগ্যে ঘটেনি।

৪) “কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;”

পৃথিবীতে আরও অনেক অজানা জীব এবং অপরিচিত বৃক্ষের কথা উল্লেখ করে কবি নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করছেন। কবি বিশাল পৃথিবীর বিশালতার সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করছেন।

৫) “মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।”

বিশ্বের বিশালতা থাকা সত্ত্বেও, কবির মন কেবলমাত্র একটি ছোট অংশেই আবদ্ধ থাকে। তিনি জীবনের প্রকৃত, বৈচিত্র্যময় দিকগুলোর বাইরে থেকেছেন এবং এতে তাঁর মন অসন্তুষ্ট।

৬) “সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে”

বিশ্বভ্রমণ করতে না পারার আক্ষেপে তিনি বিভিন্ন ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়েছেন। এভাবে তিনি নিজের মনকে নতুন দিগন্তের সঙ্গে পরিচিত করার চেষ্টা করেছেন।

৭) “জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।”

কবি নিজের সীমিত জ্ঞানকে পূর্ণ করতে চেয়েছেন বিভিন্ন বই ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। তিনি বিভিন্ন জ্ঞান ভিক্ষার মতো আহরণ করে নিজের মানসিক দীনতাকে দূর করার চেষ্টা করেছেন।

৮) “আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি, আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,”

কবি নিজেকে পৃথিবীর কবি হিসেবে ভাবেন, যাঁর কবিতার সুরে সারা বিশ্বের ধ্বনি ধরা পড়বে। তবে তিনি স্বীকার করছেন যে, অনেক ধ্বনি এবং ভাবনা তাঁর কবিতায় ধরা পড়েনি।

৯) “এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক – রয়ে গেছে ফাঁক।”

এখানে কবি তাঁর সৃষ্টিশীলতার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করছেন। তাঁর কবিতার সুরে সবকিছুর প্রতিধ্বনি ধরা দেয়নি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ অপূর্ণ রয়ে গেছে।

১০) “প্রকৃতির ঐকতানস্রোতে নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে;”

বিশ্বের প্রকৃতি ও জীবনপ্রবাহের মধ্যে অন্যান্য কবিরা বিভিন্ন দিক থেকে তাদের গান ও সুর ঢালেন। এটি একটি বৃহৎ সংগীতের মতো, যেখানে বিভিন্ন কণ্ঠ এবং সুর মিশ্রিত হয়।

১১) “তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্র যোগ-“

কবি বলছেন যে তিনি অন্যান্য কবিদের সঙ্গে কিছু যোগ পেয়েছেন, তবে এটি পুরোপুরি নয়। তিনি সবদিক থেকে সেই ঐকতানে প্রবেশ করতে পারেননি।

১২) “সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ,”

অন্যান্য কবিদের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার কারণে তিনি সেই সঙ্গ ও আনন্দের কিছু অংশ ভোগ করেছেন।

১৩) “পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার, বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার।”

কবি তাঁর জীবনযাপনের কারণে সর্বত্র প্রবেশ করতে পারেননি। তাঁর জীবনযাত্রার সীমাবদ্ধতাগুলি তাঁকে সেই বৃহত্তর সত্তার অংশ হতে বাধা দিয়েছে।

১৪) “চাষি খেতে চালাইছে হাল, তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-“

কবি এখানে শ্রমজীবী মানুষের কাজ এবং জীবনসংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। চাষি, তাঁতি, এবং জেলের মতো মানুষেরাই সমাজের প্রকৃত ভিত্তি, তবে কবি তাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হতে পারেননি।

১৫) “বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।”

এই সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের কর্ম ও পরিশ্রমের ওপর ভিত্তি করেই গোটা সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তারাই সংসারের চলমানতার মূল চালক।

১৬) “সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।”

কবি এখানে নিজেকে সমাজের উচ্চস্থান থেকে পৃথিবীকে সংকীর্ণ জানালা দিয়ে দেখার কথা বলছেন। এতে তিনি বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং তাঁর উপলব্ধি খণ্ডিত ও সীমিত ছিল।

১৭) “জীবনে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।”

কবি বলছেন, যদি শিল্পী জীবনের সাথে জীবনের যোগ তৈরি করতে না পারেন, তাহলে তাঁর সৃষ্টিশীলতা কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয় এবং তা ব্যর্থ হয়। বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ না থাকলে সৃষ্টিকর্ম প্রাণহীন হয়ে ওঠে।

১৮) “তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা আমার সুরের অপূর্ণতা।”

কবি স্বীকার করছেন যে, তাঁর সুর এবং কবিতা পূর্ণতা পায়নি। তাঁর সৃষ্টিতে জীবনের সব দিক প্রতিফলিত হয়নি বলে তিনি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সেটি তিনি মেনে নিচ্ছেন।

১৯) “আমার কবিতা, জানি আমি, গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।”

কবি তাঁর কবিতার বিচিত্র পথে অগ্রসর হওয়ার কথা বলছেন, তবে তিনি স্বীকার করছেন যে তাঁর কবিতা জীবনের সব স্তরে পৌঁছাতে পারেনি।

২০) “কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন, কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,”

এই চরণে কবি সেই সত্যিকারের কবির কথা বলছেন, যিনি শ্রমজীবী মানুষের জীবনের অংশীদার হতে পারেন এবং কর্ম ও কথায় তাদের সাথে সত্যিকারের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

২১) “সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।”

কবি সেই কবির প্রতীক্ষা করছেন, যাঁর কণ্ঠ থেকে শ্রমজীবী মানুষের বাণী শুনতে পাওয়া যাবে।

২২) “এসো কবি অখ্যাতজনের নির্বাক মনের।”

কবি সেই মহৎ কবির আহ্বান করছেন, যিনি অখ্যাত মানুষের নিরব বেদনা এবং অনুভূতিগুলি প্রকাশ করতে সক্ষম হবেন।

২৩) “মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার – প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার।”

কবি আশা করছেন যে সেই কবি মনের গভীর বেদনা তুলে ধরে এক গানহীন দেশের বুকে নতুন করে প্রাণের সুর ছড়িয়ে দেবেন।

২৪) “সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায় একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায় -“

কবি সাহিত্যিক ঐকতানে শ্রমজীবী মানুষের মতো সাধারণ মানুষের গান, যন্ত্র, এবং সুরকেও সম্মান দিতে আহ্বান জানাচ্ছেন। সেই সাধারণ মানুষ, যাদের গানের সুর একতারার মতো সাদামাটা, কিন্তু গভীর, তাদেরও সম্মান পাওয়া উচিত।

২৫) “ওগো গুণী, কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।”

কবি সেই গুণী মানুষদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন, যারা শ্রমজীবী, নিঃশব্দ এবং সমাজের উপেক্ষিত মানুষের কণ্ঠস্বরকে শুনতে পাবেন।

Related Posts

Leave a Comment