শাহ মুহম্মদ সগীরের বন্দনা কবিতাটি মাতা-পিতা, গুরু ও সমাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক গভীর ভক্তিমূলক রচনা। এটি বাংলার মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ধারার অংশ, যেখানে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ঋণ স্বীকার করা হয়েছে। এই পোস্টে বন্দনা কবিতার জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর লিকখে দিলাম।
Table of Contents
বন্দনা কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
১। ‘বন্দনা’ কবিতাটি কার লেখা?
উত্তর: শাহ মুহম্মদ সগীরের।
২। কবিতাটি কোন কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে?
উত্তর: ইউসুফ জোলেখা কাব্য থেকে।
৩। ‘বন্দনা’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: স্তুতি বা প্রশংসা।
৪। শাহ মুহম্মদ সগীর কে ছিলেন?
উত্তর: তিনি একজন প্রাচীন মুসলিম কবি।
৫। শাহ মুহম্মদ সগীর কোন সময়ের কবি ছিলেন?
উত্তর: আনুমানিক ১৪-১৫ শতকের।
৬। মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম কে বলে বিবেচিত?
উত্তর: শাহ মুহম্মদ সগীর।
৭। শাহ মুহম্মদ সগীর কোন কাব্য রচনা করেন?
উত্তর: ইউসুফ জোলেখা।
৮। ইউসুফ জোলেখা কাব্য কোন সময় রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়?
উত্তর: পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে।
৯। শাহ মুহম্মদ সগীর কোন সুলতানের রাজত্বকালে কাব্য রচনা করেন?
উত্তর: গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে।
১০। ‘মহামতি গ্যেছ’ নামে কাকে বোঝানো হয়েছে বলে মনে করা হয়?
উত্তর: গিয়াসউদ্দীন আজম শাহকে।
১১। শাহ মুহম্মদ সগীর কোন অঞ্চলের অধিবাসী বলে মনে করা হয়?
উত্তর: চট্টগ্রামের।
১২। শাহ মুহম্মদ সগীর কাব্যে কী ভাষা ব্যবহার করেছেন?
উত্তর: দেশি ভাষা।
১৩। ইউসুফ জোলেখা কাব্য কোন ধরনের উপাখ্যান হিসেবে গড়ে উঠেছে?
উত্তর: মানবিক প্রেমোপাখ্যান।
১৪। ‘বন্দনা’ কবিতাটিতে কাদের বন্দনা করা হয়েছে?
উত্তর: মা-বাবা ও শিক্ষক
১৫। গুরুজনদের প্রতি কেমন আচরণ করতে বলা হয়েছে?
উত্তর: বিনয়ী ও কৃতজ্ঞ হতে
১৬। ‘নেহায়’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: স্নেহে।
১৭। ‘বন্দনা’ কবিতার মাধ্যমে কী শিক্ষা দেওয়া হয়েছে?
উত্তর: গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা
১৮। গুরুজনদের অবজ্ঞা করলে কী হয়?
উত্তর: পাপ বৃদ্ধি পায়
১৯। ‘আহ্মার’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: আমার।
২০। শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর কী থাকা উচিত?
উত্তর: শ্রদ্ধা
২১। কবিতায় বাবা-মাকে কীসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে?
উত্তর: দেবতার
২২। ‘ছাবাল’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: সন্তান বা ছেলে।
২৩। গুরুজনদের সম্মান করলে কী পাওয়া যায়?
উত্তর: জ্ঞান ও সাফল্য
২৪। কবিতায় মাতা-পিতাকে কীসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে?
উত্তর: আশীর্বাদের
২৫। গুরুজনদের সম্মান করলে কী বৃদ্ধি পায়?
উত্তর: সামাজিক মর্যাদা
২৬। ‘গোঙাও’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: গুজরান করে বা অতিবাহিত করে।
২৭। গুরুজনদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলে কী হয়?
উত্তর: সুখ ও শান্তি আসে
২৮। কবিতায় গুরুজনদের প্রতি কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে?
উত্তর: তাঁদের সম্মান করতে
২৯। গুরুজনদের অবজ্ঞা করলে কী হারাতে হয়?
উত্তর: সম্মান ও সুখ
৩০। ‘পুরবাসী’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: নগরবাসী।
৩১। কবিতায় শিক্ষকের তুলনা করা হয়েছে কাদের সাথে?
উত্তর: দ্বিতীয় পিতা
৩২। কবির মতে, শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি কী অর্জন করে?
উত্তর: জ্ঞান ও প্রশংসা
৩৩। কবিতায় গুরুজনদের প্রতি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে?
উত্তর: বিনয়ের মাধ্যমে
৩৪। গুরুজনদের সম্মান করলে কী পাওয়া যায়?
উত্তর: আশীর্বাদ
৩৫। ‘বসুধায়’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: পৃথিবীতে।
৩৫। গুরুজনদের অবহেলা করলে কী হয়?
উত্তর: দুর্ভাগ্য নেমে আসে
৩৬। কবি ‘বন্দনা’ কবিতায় প্রথমে কাদের প্রণাম করেছেন?
উত্তর: মা-বাবাকে।
৩৭। ‘সপুটে’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: করজোড়ে।
৩৮। “পিপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত”—এই লাইনটির অর্থ কী?
উত্তর: মা সন্তানকে অত্যন্ত যত্নে রাখতেন, পিপড়ার ভয়েও মাটিতে নামাতেন না।
৩৯। কবি নিজেকে কীভাবে বর্ণনা করেছেন?
উত্তর: দুর্বল শিশু (“অশক্য আছিলু মুই দুর্বল ছাবাল”)।
৪০। ‘মনোরথ’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ইচ্ছা বা অভিলাষ।
৪১। “না খাই খাওয়াএ পিতা”—এই কথার অর্থ কী?
উত্তর: পিতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়াতেন।
৪২। কবি গুরুকে কী বলে সম্বোধন করেছেন?
উত্তর: “ওস্তাদ” ও “দোসর-জনম দাতা” (দ্বিতীয় জন্মদাতা)।
৪৩। কবি কাদের ‘পুরবাসী’ বলেছেন?
উত্তর: পূর্বপুরুষ বা সম্প্রদায়ের মানুষ।
৪৪। ‘হস্তে’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: হতে বা থেকে।
৪৫। “ইষ্ট মিত্র আদি জথ সভাসদগণ”—এখানে ‘ইষ্ট মিত্র’ কাদের বলা হয়েছে?
উত্তর: ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের।
৪৬। কবি নিজেকে কী হিসেবে উল্লেখ করেছেন?
উত্তর: পাপী ও হীন।
৪৭। “আহ্মা” শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: আমি (আধুনিক বাংলায় ‘আমি’)।
৪৮। “মনোরথ গতি” বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: মনের ইচ্ছা পূরণ হওয়া।
৪৯। কবিতাটি কোন ছন্দে রচিত?
উত্তর: মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
৫০। “সপুটে প্রণাম” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: আন্তরিকভাবে বা ভক্তিভরে প্রণাম জানানো।
৫১। কবিতায় ‘সভাসদগণ’ বলতে কাদের ইঙ্গিত করা হয়েছে?
উত্তর: সমাজের বিদ্বান বা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ।
৫২। “ধড় বিশাল” এর অর্থ কী?
উত্তর: শারীরিক বিকাশ বা বড় হওয়া।
৫৩। “জথ পৌরজন” শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: যেমন পুরনো বা পরিচিত লোকজন।
৫৪। “বহুল ভকতি” বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: অগাধ ভক্তি বা শ্রদ্ধা।
৫৫। কবির মতে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক কে?
উত্তর: মা।
৫৬। ‘মুই’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: আমি।
৫৭। শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাব্য মূলত কোন ধরনের কাব্য?
উত্তর: ধর্মীয় পটভূমিতে রচিত প্রেমোপাখ্যান।
বন্দনা কবিতার অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
১। কবি কেন প্রথমে আল্লাহকে বন্দনা করার পরই মা-বাবাকে প্রণাম করেছেন?
উত্তর: কবি শাহ মুহম্মদ সগীর ইসলামী রীতি অনুসারে প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করেছেন, কারণ ইসলামে আল্লাহকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়। এরপরেই তিনি মা-বাবাকে প্রণাম করেছেন, কারণ ইসলামে মা-বাবার মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বারবার মা-বাবার সেবা ও সম্মান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কবি এখানে ধর্মীয় রীতির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। মা-বাবা সন্তানের প্রথম শিক্ষক এবং তাদের ত্যাগের কথা স্মরণ করেই কবি এই বন্দনা করেছেন।
২। “পিঁপড়ার ভয়েও মা সন্তানকে মাটিতে রাখতেন না” – ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: এই লাইনটির মাধ্যমে কবি মায়ের অসীম স্নেহ ও মমতার কথা বর্ণনা করেছেন। একটি শিশু যখন খুব ছোট থাকে, তখন তার সবচেয়ে ছোট বিপদ যেমন একটি পিঁপড়ার কামড় থেকেও মা তাকে রক্ষা করেন। কবি বলতে চেয়েছেন যে মায়ের স্নেহ এতটাই গভীর যে তিনি সবসময় সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এই উদাহরণের মাধ্যমে কবি মধ্যযুগের গ্রামীণ জীবনের একটি সাধারণ কিন্তু হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন, যা আজও আমাদের মায়ের ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে সাহায্য করে।
৩। কবি কেন নিজের শৈশবকে ‘অশক্ত’ ও ‘দুর্বল বালক’ বলে বর্ণনা করেছেন?
উত্তর: কবি এখানে মানুষের জন্মগত দুর্বলতার কথা বলেছেন। প্রতিটি মানুষই শিশুকালে সম্পূর্ণরূপে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আমরা নিজেরা খেতে পারি না, হাঁটতে পারি না, এমনকি নিজেদের রক্ষাও করতে পারি না। কবি এই অবস্থাকে ‘অশক্ত’ ও ‘দুর্বল’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনার মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে আমরা যতই বড় হই না কেন, একসময় সবাই এইরকম অসহায় অবস্থায় ছিলাম। আমাদের এই দুর্বল অবস্থা থেকে বেড়ে উঠার পেছনে মা-বাবার অবদানকে কবি এভাবে সম্মান জানিয়েছেন।
৪। গুরুকে ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’ বলা হয়েছে কেন?
উত্তর: কবি গুরু বা শিক্ষককে ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’ বলেছেন কারণ মা-বাবা আমাদের শারীরিক জন্ম দিলেও, গুরু আমাদের আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জন্ম দেন। গুরুই আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখান, নৈতিকতা শিক্ষা দেন এবং সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। মধ্যযুগে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ। কবি এই কথার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে গুরু ছাড়া মানুষের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়, ঠিক যেমন মা-বাবা ছাড়া আমাদের শারীরিক জন্ম সম্ভব নয়।
৫। “পিতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান” – ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: এই লাইনটির মাধ্যমে কবি পিতার ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা বলেছেন। মধ্যযুগের সমাজে অনেক পরিবারই দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করত। এমন পরিস্থিতিতে পিতা পরিবারের জন্য অন্নের সংস্থান করতে গিয়ে নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়াতেন। কবি এখানে পিতার এই আত্মত্যাগের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। এটি শুধু অতীতের কথা নয়, আজও অনেক পিতা-মাতা সন্তানের জন্য এইরকম ত্যাগ স্বীকার করেন। কবি আমাদেরকে এই ত্যাগের মূল্য বুঝতে এবং পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে বলেছেন।
৬। কবি কেন সমাজ ও বন্ধুদের কথা উল্লেখ করেছেন?
উত্তর: কবি শুধু মা-বাবা ও গুরুর কথাই বলেননি, তিনি সমাজ (‘পুরবাসী’) এবং বন্ধুদের (‘ইষ্ট মিত্র’) কথাও উল্লেখ করেছেন। কারণ মানুষ শুধু পরিবার নিয়ে বাঁচে না, সমাজের সাথেও তার নিবিড় সম্পর্ক থাকে। আমাদের বন্ধুরা আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য শুধু পরিবারই নয়, সমাজ ও বন্ধুবান্ধবেরও প্রয়োজন। এটি মধ্যযুগের সেই সময়ের কথা বলে যখন সম্প্রদায়গত জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭। কবি কেন নিজেকে ‘হীন’ ও ‘পাপী’ বলেছেন?
উত্তর: কবি যখন নিজেকে ‘হীন’ (ক্ষুদ্র) ও ‘পাপী’ বলেন, তখন তিনি আসলে আল্লাহ ও গুরুজনের সামনে নিজের বিনয় প্রকাশ করছেন। মধ্যযুগের ধর্মীয় রচনায় এই ধরনের বিনয়পূর্ণ প্রকাশভঙ্গি খুব সাধারণ ছিল। কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষের অনেক দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা সবাই জীবনে অনেক ভুল করি। কবির এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তিনি আল্লাহ ও গুরুজনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং তাদের আশীর্বাদ কামনা করছেন।
৮। ‘মনোরথ গতি’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: ‘মনোরথ’ মানে মনের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা, আর ‘গতি’ মানে পূর্ণতা বা সফলতা। কবি এখানে প্রার্থনা করছেন যেন তার সব ভালো ইচ্ছা পূর্ণ হয়। বিশেষ করে তিনি তার কাব্য রচনায় সফলতা এবং আধ্যাত্মিক শান্তি কামনা করছেন। কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে মানুষের মনের ভালো ইচ্ছাগুলো যেন সফল হয়, সেজন্য তিনি আল্লাহ ও গুরুজনের আশীর্বাদ চাইছেন। এটি আমাদের সকলের জন্যই প্রার্থনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৯। ‘ধারকের কাহন’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: ‘ধারকের কাহন’ বলতে কবি পিতার সেই সব ত্যাগের কথা বলেছেন যা কখনোই শোধ করা সম্ভব নয়। যেমন টাকা-পয়সা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না এমন ঋণ। কবি বলতে চেয়েছেন যে পিতামাতার ভালোবাসা ও ত্যাগের কোনো মূল্য দিয়ে পরিশোধ করা যায় না। এটি একটি সুন্দর রূপক, যার মাধ্যমে কবি পিতামাতার প্রতি আমাদের চিরকৃতজ্ঞতার কথা বলেছেন। মধ্যযুগে এই ধরনের রূপকের ব্যবহার খুবই সাধারণ ছিল।
১০। কেন কবি প্রথমে পিতামাতার বন্দনা করেছেন?
উত্তর: কবি প্রথমেই পিতামাতার বন্দনা করেছেন কারণ তাঁরা সন্তানের জন্মদাতা এবং তার জীবনের প্রথম ও প্রধান অভিভাবক। প্রতিটি শিশুই পৃথিবীতে একেবারে অসহায় অবস্থায় জন্ম নেয়। তখন তার পিতামাতাই তাকে আগলে রাখেন, লালন-পালন করেন এবং ধীরে ধীরে বড় করে তোলেন। মা তার সন্তানকে এতটাই ভালোবাসেন যে পিঁপড়ার ভয়ে পর্যন্ত মাটিতে শুইয়ে রাখেন না। তাই কবি মনে করেন, পিতামাতার ঋণ কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি কবিতার শুরুতেই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
১১। কবি কেন শিক্ষকের বন্দনা করেছেন?
উত্তর: কবি শিক্ষকের বন্দনা করেছেন কারণ শিক্ষক একজন মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় আলোকিত করেন এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য করে তোলেন। একজন শিশু জন্মের পর পিতামাতার যত্নে বড় হয়, কিন্তু তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটে শিক্ষকের হাতে। শিক্ষকের কাছ থেকেই সে ভালো-মন্দের পার্থক্য শিখে, ন্যায়-অন্যায় বোঝে এবং উপযুক্ত মানুষ হয়ে ওঠে। কবি শিক্ষককে ‘দোসর জনমদাতা’ বা দ্বিতীয় জন্মদাতা বলেছেন, কারণ তিনি একজন ছাত্রের মন ও মেধার জগতে নতুন আলো এনে দেন। তাই শিক্ষককে যথাযথ সম্মান করা উচিত বলে কবি মনে করেন।
১২। পিতামাতা কিভাবে সন্তানের প্রতি দয়া ও স্নেহ প্রদর্শন করেন?
উত্তর: পিতামাতা সন্তানের প্রতি দয়া ও স্নেহ প্রদর্শন করেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। একটি শিশু জন্মের পর একেবারে দুর্বল ও অসহায় থাকে। তখন তার মা তাকে বুকের দুধ পান করিয়ে লালন করেন, সর্বদা সুরক্ষা দেন এবং সব কষ্ট সহ্য করেও সন্তানের সুখের কথা ভাবেন। কবি বলেছেন, মা এতটাই যত্নশীল যে তিনি সন্তানকে মাটিতে পর্যন্ত শুইয়ে রাখেন না, কারণ তাতে পিঁপড়া কামড়াতে পারে। পিতা কঠোর পরিশ্রম করেন, নিজের প্রয়োজনের কথা ভুলে গিয়ে সন্তানের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করেন। মা-বাবা নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে নিরলস পরিশ্রম করেন। এজন্য তাঁদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
১৩। কেন পিতামাতার ঋণ শোধ করা যায় না?
উত্তর: পিতামাতার ঋণ কোনোভাবেই শোধ করা সম্ভব নয় কারণ তাঁদের ত্যাগ ও ভালোবাসা সীমাহীন। মা-বাবা শুধু সন্তানকে জন্মই দেন না, বরং বড় করে তোলার জন্য নিজেদের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেন। তাঁরা সন্তানের জন্য না খেয়ে থাকেন, নিজের কষ্ট ভুলে যান, কিন্তু সন্তানের সামান্য অসুখ-বিসুখেও বিচলিত হয়ে পড়েন। একজন সন্তান যতই পিতামাতার সেবা করুক না কেন, তাঁদের ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের তুলনায় তা কিছুই নয়। তাই পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করা ছাড়া তাঁদের ঋণ শোধ করার আর কোনো উপায় নেই।
১৪। কিভাবে শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবন গঠনে ভূমিকা রাখেন?
উত্তর: শিক্ষক একজন ছাত্রের জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জ্ঞান, শিক্ষা ও নৈতিকতার আলো দিয়ে। তিনি ছাত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, তাকে ন্যায়বিচার, সততা ও পরোপকারের শিক্ষা দেন। একজন শিক্ষক শুধু বইয়ের জ্ঞান দেন না, তিনি একজন ছাত্রের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব গঠনে সাহায্য করেন। যদি একজন ছাত্র ভালো শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসে, তবে সে নৈতিকভাবে সৎ, জ্ঞানী ও কর্মঠ মানুষ হয়ে ওঠে। এজন্যই তিনি শিক্ষককে ‘দোসর জনমদাতা’ বলেছেন।
১৫। কবি কেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন?
উত্তর: কবি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন কারণ তাঁরা সমাজের উন্নতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সমাজে যেসব ব্যক্তিরা সৎ, জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ, তাঁরা সাধারণ মানুষকে ন্যায়বিচারের পথ দেখান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে সহায়তা করেন এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করেন। কবি মনে করেন, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান করলে সমাজ আরও উন্নত হবে এবং মানুষ পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
১৬। কিভাবে কবি তাঁর পাপমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন?
উত্তর: কবি তাঁর পাপমুক্তির জন্য অত্যন্ত বিনম্রভাবে প্রার্থনা করেছেন। তিনি নিজেকে ‘পাপী’ বলে স্বীকার করেছেন এবং সভাসদদের কাছে দোয়া চেয়েছেন। কবি মনে করেন, একজন মানুষ জীবনে অনেক ভুল করে, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পাপের ভাগী হয়। তাই সবার উচিত নিজের ভুল বুঝতে পারা এবং ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করা। কবি বিশ্বাস করেন, যদি তিনি গুরুজনদের আশীর্বাদ ও দোয়া পান, তবে তার পাপ ক্ষমা হতে পারে। এটি তাঁর বিনয়ী ও ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিচায়ক।
১৭। কবির বিনম্রভাবে সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার কারন কি?
উত্তর: কবি বিনম্রভাবে সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন কারণ তিনি মনে করেন, মানুষ কখনো একা বড় হতে পারে না। পরিবার, শিক্ষক, সমাজের অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সহায়তায় একজন মানুষ সফল হয়ে ওঠে। তাই তাঁদের সম্মান করা এবং তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনয়ী হওয়া এবং গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া মানুষের উন্নতির অন্যতম প্রধান গুণ। কবি মনে করেন, বিনম্রতা ও কৃতজ্ঞতা মানুষকে প্রকৃতভাবে মহৎ করে তোলে।
১৮। ‘বন্দনা’ কবিতায় মধ্যযুগীয় সমাজের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে”- ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ‘বন্দনা’ কবিতায় মধ্যযুগীয় সমাজের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে গুরুজন ও সমাজপতিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার মাধ্যমে। মধ্যযুগের সমাজে পিতামাতা, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি ও আনুগত্য দেখানো হতো। এই কবিতায় কবি পিতামাতাকে ঈশ্বরের পরে স্থান দিয়েছেন এবং শিক্ষকের অবদানকে দ্বিতীয় জন্মদানের সমতুল্য বলেছেন। এটি সেই সময়ের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে প্রকাশ করে, যেখানে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯। ‘বন্দনা’ কবিতাটি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধের উদাহরণ”- ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ‘বন্দনা’ কবিতাকে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয় কারণ এতে পিতামাতা, শিক্ষক ও সমাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও বিনম্র শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে। এই কবিতায় দেখানো হয়েছে যে, একজন মানুষ তার পিতামাতা, শিক্ষক ও সমাজের অবদানে গড়ে ওঠে। তাই তাঁদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞ থাকা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। কবি মনে করেন, বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল হলে মানুষ প্রকৃত সুখ ও সাফল্য লাভ করতে পারে। এই শিক্ষা আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।