প্রত্যুপকার গল্পের মূলভাব ও প্রমিত রূপ সহজ ভাষায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘প্রত্যুপকার’ গল্পে আলী ইবনে আব্বাস তার জীবনদাতার উপকার কখনো ভুলেননি এবং সুযোগ পেয়েই তা শোধ করলেন। এটি শিক্ষা দেয় যে “উপকারের প্রতিদান” করা মহৎ মানুষের লক্ষণ। এই পোস্টে প্রত্যুপকার গল্পের মূলভাব ও প্রমিত রূপ সহজ ভাষায় লিখে দিলাম।

প্রত্যুপকার গল্পের মূলভাব

আলী ইবনে আব্বাস ছিলেন খলিফা মামুনের ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি। একদিন খলিফা একটি বন্দীকে তাঁর হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। আলী বন্দীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, সে ডেমাস্কাস শহরের বাসিন্দা। এই নাম শুনেই আলীর মনে পড়ে বহু বছর আগে তিনি ডেমাস্কাসে বিপদের মুখে পড়লে এক অচেনা লোক তাঁকে আশ্রয় ও সাহায্য করেছিলেন। আশ্চর্যভাবে সেই বন্দীই ছিল সেই পুরনো উপকারি মানুষ। আলী তখন তাঁকে পালাতে বলেন, কিন্তু সে অস্বীকার করে। সে বলে, আমি যদি তোমার প্রাণ বাঁচাতে পেরে থাকি, তবে তোমার প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমি নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারি না। পরদিন আলী সব কথা খলিফাকে খুলে বলেন। খলিফা প্রথমে রেগে গেলেও পরে সত্যতা বুঝে বন্দীকে মুক্তি দেন। খলিফা তাকে সম্মান ও উপহার দিয়ে বিদায় জানান। এই গল্পে দেখা যায়, একজন মানুষ কখনো উপকার ভুলে না। সুযোগ পেলে সেই উপকারের প্রতিদান দিতে চায়। এটাই হলো ‘প্রত্যুপকার’। গল্পটি আমাদের শেখায়, ভালোবাসা, সহানুভূতি ও কৃতজ্ঞতাই সত্যিকারের মানবতা। যারা উপকার করে, তারা চিরকাল মনে থেকে যায়।

প্রত্যুপকার গল্পের প্রমিত রূপ

নিচে প্রত্যুপকার গল্প চলিত ভাষায় দেওয়া হলোঃ

গল্পটা শুরু হয় আলী ইবনে আব্বাস নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির স্মৃতিচারণ দিয়ে। তিনি ছিলেন খলিফা মামুনের প্রিয়পাত্র। একদিন বিকেলে তিনি খলিফার সঙ্গে বসে আছেন, এমন সময় এক বন্দীকে শিকল বাঁধা অবস্থায় খলিফার সামনে আনা হয়। খলিফা রেগে গিয়ে বলেন, “এই লোকটাকে তুমি তোমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখো। পরে আমার আদেশে তাকে ফেরত দেবে।”

আলী খুব ভয়ে ভয়ে লোকটাকে বাড়িতে নিয়ে যান, কারণ এই বন্দী পালিয়ে গেলে তো খোদ খলিফার রোষে পড়বেন!

কিছুক্ষণ পরে, তিনি বন্দীকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাড়ি কোথায়?”
লোকটি বললেন, “ডেমাস্কাসে (সিরিয়ার একটি শহর)। বড় মসজিদের কাছে আমার বাড়ি।”

এই কথা শুনে আলী আবেগে বলে ওঠেন, “ওই জায়গায় একসময় আমার প্রাণরক্ষা করেছিল এক অচেনা লোক। তাই ওই স্থান আমার খুব প্রিয়।”

লোকটি জানতে চায়, “তা কীভাবে?”
তখন আলী বলেন, অনেক বছর আগে তিনি ডেমাস্কাসে গিয়েছিলেন এক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। সেখানে দাঙ্গা শুরু হয়। জীবন বাঁচাতে তিনি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। লোকটি তাকে এক মাস নিরাপদে রেখে, শেষে একটি ঘোড়া, খাদ্যসামগ্রী, ভৃত্য ও টাকা দিয়ে বিদায় দেন। এতটা সাহায্য তিনি কোনোদিন ভুলতে পারেননি।

আলী আফসোস করে বলেন, “দুঃখ একটাই—আমি কোনোদিন সেই উপকারীর খোঁজ পাইনি। যদি কোনোদিন তার জন্য কিছু করতে পারতাম, তবে জীবন সার্থক মনে হতো।”

এই কথা শুনে বন্দী ব্যক্তি হঠাৎ বলে উঠলেন, “আপনি যার কথা বলছেন, সে আর কেউ না—এই আমি!”

আলী তখন চমকে উঠে তাঁকে চিনে ফেলেন। আবেগে আলিঙ্গন করে বলেন, “তোমার জন্য আমি প্রাণ দিতেও রাজি!”

লোকটি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাকে খলিফার কাছে দোষী বানানো হয়েছে। এখন আমি মারা যেতে পারি। আপনি শুধু আমার স্ত্রী-সন্তানদের কাছে খবরটা পৌঁছে দিন।”

আলী তখন বলেন, “না না, তুমি এখুনি পালাও। এটা নাও, স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে চলে যাও তোমার পরিবারে। খলিফার রাগ আমার গায়ে পড়ুক, তবু তোমার জীবন বাঁচুক।”

কিন্তু সেই ভদ্রলোক বলেন, “না, আমি তোমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য একদিন আমার জীবন বাজি রেখেছিলাম। আজ আমি নিজে বাঁচার জন্য তোমার মৃত্যু ঘটাতে পারি না। তুমি বরং চেষ্টা করো খলিফাকে বোঝাতে। সফল না হলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।”

পরদিন আলী খলিফার কাছে যান। খলিফা রেগে গিয়ে বলেন, “তুমি যদি তাকে ছেড়ে দিয়ে থাকো, তোমাকেও প্রাণে মেরে ফেলব।”
আলী তাঁকে সব খুলে বলেন—লোকটি কতটা দয়ালু, পরোপকারী, এবং ন্যায়বান। খলিফা সব শুনে চুপ হয়ে যান।

অবশেষে খলিফা বলেন, “সে যে এমন মহান, তা আমি জানতাম না। সে মুক্ত। তুমি তাকে নিয়ে এসো।”

আলী দৌড়ে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসেন। খলিফা তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দেন, মূল্যবান উপহার দেন, এবং ডেমাস্কাসে ফেরার জন্য অনেক টাকা-পয়সা ও চিঠি দিয়ে বিদায় জানান।

Related Posts

Leave a Comment