প্রতিদান কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর

প্রতিদান কবিতার মাধ্যমে কবি জসীমউদ্দীন আমাদের শিখিয়েছেন যে, ভালোবাসা এবং ক্ষমার শক্তি প্রতিশোধের চেয়ে অনেক বেশি গভীর এবং তা আমাদের জীবনকে প্রকৃত শান্তি ও পূর্ণতা এনে দেয়। যারা আমাদের কষ্ট দেয়, তাদেরও ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে জয় করা সম্ভব। এই পোস্টে প্রতিদান কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর লিখে দিলাম।

প্রতিদান কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন

১। “আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি” – বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
এই চরণটিতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যিনি তাঁর জীবনের স্থিরতা ও শান্তি নষ্ট করেছেন, তাঁর জন্য তিনি নতুনভাবে স্থিতি গড়ে তুলতে চান। এই ত্যাগের মাধ্যমে কবি ঘৃণার বদলে ভালোবাসা এবং প্রতিশোধের বদলে সহানুভূতি দেখানোর শিক্ষা দিয়েছেন। এতে তাঁর ক্ষমাশীল মনোভাব এবং পৃথিবীকে সুন্দর করার আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।

২। ‘প্রতিদান’ কবিতার মাধ্যমে কবি কী ধরনের সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন?
উত্তর: ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি এমন এক সমাজের কথা বলেছেন যেখানে প্রতিহিংসার কোনো স্থান নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষ একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করবে। হিংসা, বিদ্বেষ ও অনিষ্টের বদলে পরস্পরকে ক্ষমা করে নতুন করে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কবি মনে করেন, এভাবে একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। এ সমাজে পরার্থপরতা এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা হবে প্রধান নিয়ম।

৩। কবি কেন প্রতিশোধের পরিবর্তে উপকারের কথা বলেছেন?
উত্তর: কবি মনে করেন, প্রতিশোধ নেওয়া কেবল হিংসা ও বিদ্বেষকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রতিশোধ মানুষের মনকে আরও অশান্ত করে এবং সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই তিনি প্রতিশোধের বদলে উপকার করার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ উপকার ও ভালোবাসার মাধ্যমে অনিষ্টকারীকে সঠিক পথে আনা সম্ভব। এতে করে ব্যক্তিগত সুখের পাশাপাশি সমাজে শান্তি ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে দোষী ব্যক্তির মনও পরিবর্তিত হতে পারে।

৪। “আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর” – ব্যাখ্যা কর
এখানে কবি তাঁর গভীর মানবিক অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। যাঁরা তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তাঁদের তিনি নিজের করে নিতে চান। কবি এদের প্রতি ভালোবাসা এবং গ্রহণযোগ্যতা দেখাতে চান। সমাজে বিদ্বেষ বা হিংসার পরিবর্তে তিনি আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের পরিবেশ গড়ে তুলতে চান। তাই তিনি পরকে আপন করতে নিরন্তর চেষ্টা করে যান।

৫। “যে মোরে করিল পথের বিরাগী- পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি” – চরণটি ব্যাখ্যা কর
এই চরণে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, যিনি তাঁকে সমাজচ্যুত বা নিঃস্ব করে পথে বসিয়েছেন, সেই ব্যক্তির জন্যই তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। কবি প্রতিশোধের পথে না গিয়ে ভালোবাসা দিয়ে তাদের মন জয় করতে চান। শত্রুতার পরিবর্তে এই উদারতাই কবির প্রকৃত মানবিকতার পরিচয় বহন করে।

৬। ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি কীভাবে ভালোবাসার শক্তির কথা বলেছেন?
উত্তর: ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি বলেছেন, ভালোবাসা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি, যা হিংসা ও বিদ্বেষকে পরাজিত করতে পারে। কবি মনে করেন, বিদ্বেষের জবাবে বিদ্বেষ দিলে সমাজে শান্তি আসে না। বরং ভালোবাসা এবং ক্ষমা দিয়ে শত্রুকেও আপন করে নেওয়া যায়। তিনি অনিষ্টকারীকে ভালোবাসার মাধ্যমে বদলে দেওয়ার কথা বলেছেন। এই ইতিবাচক শক্তির মাধ্যমেই মানুষ সত্যিকারের সুখ এবং জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়।

৭। ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি কীভাবে নিজের ব্যথা প্রকাশ করেছেন?
উত্তর: ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি ব্যক্তিগত কষ্ট এবং ব্যথাকে খুব সংবেদনশীলভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, অন্যরা তাঁর প্রতি অনিষ্ট করেছে, তাঁকে কষ্ট দিয়েছে এবং পথের বিরাগী করেছে। তবুও তিনি তাদের জন্য কাঁদেন, নির্ঘুম রাত কাটান এবং তাদের ভালোবাসেন। কবি মনে করেন, তার নিজের ব্যথার চেয়ে বড় হলো অন্যের উপকার করা। এই ত্যাগ এবং ক্ষমার মাধ্যমে তিনি নিজেকে এক মানবিক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

৮। কবি কীভাবে অনিষ্টকারীর প্রতি সৌহার্দ্যের পরিচয় দিয়েছেন?
উত্তর: কবি অনিষ্টকারীর প্রতি সৌহার্দ্যের পরিচয় দিয়েছেন তাদের ক্ষতি না করে বরং তাদের উপকার করার মাধ্যমে। তিনি কটু কথার জবাবে মধুর ভাষা, আঘাতের জবাবে ভালোবাসা এবং শত্রুতার জবাবে দয়া প্রদর্শন করেছেন। কবি বিশ্বাস করেন, এর মাধ্যমে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে শান্তির পরিবেশ তৈরি হবে। অনিষ্টকারীকে ক্ষমা করার মাধ্যমে কবি তার মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

৯। “আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর” – এই চরণটি কি বোঝায়?
এই চরণে কবি বলতে চেয়েছেন যে, যেই ব্যক্তি তাঁর জীবনের সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তা নষ্ট করেছে, কবি তার জন্যই ভালোবাসা দিয়ে একটি নতুন আশ্রয় তৈরি করেন। কবি প্রতিশোধের পরিবর্তে ক্ষমা ও সহমর্মিতার পথে হাঁটেন। তিনি মনে করেন, ঘৃণা বা প্রতিহিংসা পৃথিবীকে সুন্দর করতে পারে না; বরং ভালোবাসা ও সহানুভূতির মাধ্যমে একে বাসযোগ্য করা যায়।

১০। “দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর” – কবি এখানে কী প্রকাশ করেছেন?
এই চরণে কবি জানিয়েছেন যে, যাঁরা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের জন্য তিনি দীর্ঘ রাত জেগে কাটান। নিজের কষ্ট ভুলে তাঁদের কল্যাণের কথা ভাবেন। কবির এই নিদ্রাহীন রাতের ত্যাগ প্রকৃত ভালোবাসা ও মানবিকতার নিদর্শন। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমার মাধ্যমে সমাজকে আরও সুন্দর করা যায়।

১১। “যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি” – এই লাইনটি কবির কোন গুণ প্রকাশ করে?
এই লাইনে কবি বোঝাতে চেয়েছেন, যাঁরা তাঁকে আঘাত দিয়েছেন, তাঁদের জন্যও তিনি কষ্ট পান এবং দুঃখ করেন। এটি কবির হৃদয়ের কোমলতা এবং অসীম সহানুভূতির প্রকাশ। তিনি শত্রুদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে তাদের জন্য মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করেন। এই মানবিক গুণই কবিকে অনন্য করে তোলে।

১২। “কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর” – এই লাইনের ব্যাখ্যা কী?
এই লাইনে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি জীবনে যত কষ্টই পান না কেন, তিনি তার বদলে ভালোবাসা ও সৌন্দর্য বিলিয়ে দেন। তিনি শত্রুতার জবাব প্রতিহিংসা দিয়ে না দিয়ে, বরং ক্ষমা ও সহানুভূতি দিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান। এটি তাঁর আত্মিক মহত্ত্ব ও পরার্থপরতার প্রকাশ।

১৩। ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবির ভালোবাসার ভাবনা কীভাবে ফুটে উঠেছে?
উত্তর: কবির ভালোবাসার ভাবনা ফুটে উঠেছে তার ক্ষমা এবং উদারতার মাধ্যমে। কবি বলেন, যারা তাঁর ক্ষতি করেছে, তাদের প্রতি তিনি বিদ্বেষ না রেখে ভালোবাসা প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ভালোবাসার মাধ্যমেই মানুষকে সত্যিকার অর্থে আপন করা সম্ভব। শত্রুতার জায়গায় তিনি সোহাগ ও দয়ার স্থান দিতে চান। এই ভাবনায় কবি পরার্থপরতার আদর্শ তুলে ধরেছেন এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন।

১৪। ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি কীভাবে নিজের ত্যাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন?
উত্তর: কবি ‘প্রতিদান’ কবিতায় নিজের ত্যাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন ক্ষতির বদলে উপকার করার মাধ্যমে। তিনি বলেছেন, অন্যরা তার ঘর ভেঙেছে, অথচ তিনি তাদের ঘর বাঁধেন। যারা তাকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের জন্য তিনি কাঁদেন এবং নির্ঘুম রাত কাটান। এমনকি বিষাক্ত কথার বদলে তিনি গান দেন। কবির এই ত্যাগের মানসিকতা তার উদারতা এবং পরার্থপরতার পরিচায়ক। এর মাধ্যমে তিনি মহৎ হৃদয় ও মানবিক মূল্যবোধের নিদর্শন রেখেছেন।

১৫। “যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ, আমি দেই তারে বুকভরা গান” – এই চারণটিতে কবে কি বোঝাতে চেয়েছেন?
এই লাইনে কবি বুঝিয়েছেন, যারা তাঁকে কটু কথা বা বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করেছে, তাদের প্রতি তিনি সৌন্দর্য, ভালোবাসা ও মধুরতা দিয়ে প্রতিদান দেন। কবির এই মনোভাব প্রতিহিংসার বিপরীতে ক্ষমা ও উদারতার আদর্শ তুলে ধরে। তিনি বিশ্বাস করেন, কল্যাণ ও ভালোবাসাই সব নেতিবাচকতাকে দূর করতে পারে।

১৬। কবি কীভাবে প্রতিকূলতার মধ্যেও ধৈর্য ধারণ করেন?
উত্তর: কবি প্রতিকূলতার মধ্যেও ধৈর্য ধারণ করেন ক্ষমা এবং ভালোবাসার মাধ্যমে। তিনি অনিষ্টের মোকাবিলায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হন না, বরং ধৈর্য ধরে ক্ষমা করেন এবং উপকার করেন। তাঁর বিশ্বাস, প্রতিকূলতাকে ধৈর্য এবং উদারতা দিয়ে মোকাবিলা করলে তা সমাজের মঙ্গলে রূপ নেবে। এর মাধ্যমে তিনি নিজের মনকে শান্ত রাখেন এবং অন্যদেরও সঠিক পথে চলার অনুপ্রেরণা দেন।

১৭। ‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি কীভাবে অনিষ্টকারীর মন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন?
উত্তর: কবি অনিষ্টকারীর মন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন ভালোবাসা এবং ক্ষমার মাধ্যমে। তিনি শত্রুতার বদলে দয়া, কটু কথার বদলে মধুরতা এবং আঘাতের বদলে উপকার প্রদর্শন করেন। কবি মনে করেন, ভালোবাসাই একমাত্র শক্তি যা হিংসাত্মক মনোভাবকে বদলাতে পারে। এই ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমে তিনি অনিষ্টকারীকে আপন করে নিতে চান এবং সমাজে শান্তি স্থাপন করতে চান।

১৮। কবি কেন মনে করেন ক্ষমাই প্রকৃত মানবতার চর্চা?
উত্তর: কবি মনে করেন, ক্ষমাই প্রকৃত মানবতার চর্চা কারণ ক্ষমা বিদ্বেষ দূর করে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিশোধ সমাজে নতুন নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, কিন্তু ক্ষমা মানুষের মনকে পরিশুদ্ধ করে। ক্ষমা মানুষকে মহৎ করে এবং ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে। কবির মতে, ক্ষমা মানুষকে সহনশীল এবং উদার হতে শেখায়, যা প্রকৃত মানবতার ভিত্তি।

১৯। “মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি” – এই লাইনে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
এই লাইনে কবি বলেছেন, যিনি তাঁর মনে গভীর দুঃখের ক্ষত তৈরি করেছেন, তাঁর জন্যই তিনি ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের ফুল নিয়ে আসেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি কবির অসীম উদারতা এবং ঘৃণার বদলে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার প্রকাশ করে। কবির এই মনোভাব সমাজকে সুস্থ ও মানবিক করতে সাহায্য করে।

২০। “যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী, আমি লয়ে করে তারি মুখখানি” – এই লাইনের ভাবার্থ কী?
এই লাইনে কবি বলেছেন, যাঁরা তাঁকে কঠোর ও কষ্টদায়ক কথা বলেছেন, তাঁদের মুখের কথাগুলো তিনি সহ্য করেন এবং তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন। এটি কবির ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা এবং ভালোবাসার নিদর্শন। তিনি বিশ্বাস করেন, ঘৃণার বদলে ভালোবাসা দিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়।

আরও পড়ুনঃ প্রতিদান কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও উত্তর

Related Posts

Leave a Comment