কোকিল গল্পটি একটি রূপকথার। এটি লিখেছেন ডেনমার্কের হ্যান্স অ্যান্ডারসন। অনুবাদ করেছেন বুদ্ধদেব বসু। এই পোস্টে কোকিল গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর- ৭ম শ্রেণির আনন্দপাঠ লিখে দিলাম।
Table of Contents
কোকিল গল্পের মূলভাব
গল্পটি একটি রাজা এবং তার রাজ্যের এক বিশেষ পাখি কোকিল সম্পর্কে। চীন দেশের রাজা, যিনি তাঁর রাজ্যের প্রাসাদ ও বাগানের গর্বে সজীব, সেখানে অমলিন ফুলের সাজানো বাগান। প্রতিটি ফুলের গলায় রূপোর ঘণ্টা বাঁধা, যা দিয়ে বাগানের সৌন্দর্য আরও বাড়ে। বাগানে হাঁটলেই, ঘণ্টার সুরে মানুষের মন মুগ্ধ হয়ে যায়।
একদিন, রাজার কাছে শুনা যায় যে তাঁর রাজ্যে একটি কোকিল পাখি রয়েছে, যার গান এতই সুন্দর যে, মানুষ দূরদূরান্ত থেকে তার গান শুনতে আসে। রাজা জানতে পারে, কোকিলের গান শুনে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যায়। সে গানের যাদুতে জেলে থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সকলেই প্রশংসা করে ফিরে যায়। তারা কোকিলের গল্প করে, আর পণ্ডিতরা তার গান নিয়ে পুস্তক লেখে। কিন্তু রাজা অবাক হয়ে যান যখন জানতে পারেন, তাঁর প্রাসাদে কোকিল নেই। তিনি তাঁর প্রধান অমাত্যকে ডাকেন এবং জানান, তিনি চান কোকিল যেন সন্ধ্যায় রাজসভায় গান গায়। যদি কোকিল না আসে, তাহলে তার সভাসদদের শাস্তি হবে। প্রধান অমাত্য ভেবে বলেন, তারা কোকিলের নামই শোনেনি। এরপর, রান্নাঘরের এক ছোট মেয়ে বলে, সে প্রতিদিন কোকিলের গান শুনে। তারা সকলেই বনটিতে যায় যেখানে কোকিল গান গায়। তারা কোকিলকে খুঁজে পায় এবং রাজসভায় গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
সন্ধ্যায় রাজসভায় কোকিল এসে গান গায় এবং তার গানের মাধুর্যে রাজা মুগ্ধ হন। রাজা কোকিলকে পুরস্কার দিতে চান, কিন্তু কোকিল জানায়, রাজার চোখের অশ্রু তাকে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কিন্তু একদিন রাজা একটি কলের কোকিল পান। সেই পাখি নিখুঁত গান গায়, যা রাজাকে আরও মুগ্ধ করে। রাজা খুব খুশি হন, কিন্তু আসল কোকিল একদিন পালিয়ে যায় এবং রাজা আবার তাকে অনুভব করেন। রাজা অসুস্থ হয়ে পড়লে আসল কোকিল ফিরে এসে গান গায়। তার গান রাজাকে সুস্থ করে তোলে। রাজা উপলব্ধি করেন, আসল শিল্প কখনোই কৃত্রিম কিছু দ্বারা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়।
গল্পটি আমাদের শেখায়, জীবনে সত্যিকারের শিল্পের গুরুত্ব কতটা। কোকিলের গান যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য কেবল সত্যিকার অনুভূতিতে পাওয়া যায়। এইভাবে, গল্পটি হৃদয়ে স্থান করে নেয়, শিল্পের আসল মানে বোঝাতে।
কোকিল গল্পের মূলভাব সংক্ষেপে
গল্পটি চীন দেশের এক রাজা এবং তার প্রিয় কোকিল পাখি নিয়ে। রাজা তাঁর অসাধারণ প্রাসাদ ও বাগানের গর্ব করেন, যেখানে কোকিলের গান শুনতে মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আসে। রাজা কোকিলের প্রশংসা শোনার পর তাকে রাজসভায় গান গাইতে ডাকেন। কিন্তু কোকিল প্রথমে পাওয়া যায় না। অবশেষে, একটি রান্নাঘরের মেয়ে কোকিলের গান শোনায় এবং তারা তাকে খুঁজে পায়। কোকিল রাজসভায় এসে তার মধুর গান গায়, যা রাজাকে মুগ্ধ করে। রাজা তাকে পুরস্কার দিতে চান, কিন্তু কোকিল জানায়, রাজার চোখের অশ্রু তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। পরে রাজা একটি কলের কোকিল পায়, যা নিখুঁত গান গায়। তবে আসল কোকিল একদিন পালিয়ে যায়। যখন রাজা অসুস্থ হয়ে পড়েন, আসল কোকিল ফিরে এসে তার জন্য গান গায় এবং রাজাকে সুস্থ করে তোলে। গল্পটি শেখায়, জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য কেবল সত্যিকার শিল্পে পাওয়া যায়।
কোকিল গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১। ক. কোকিল’ গল্পের প্রধান অমাত্যকে কেমন মানুষ বলে মনে কর? ব্যাখ্যা কর ৷ | ৩ |
খ. আসল কোকিল ও নকল কোকিলের বিষয়ে তোমার মনোভাব কী? মতামত ব্যক্ত কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ ‘কোকিল’ গল্পে প্রধান অমাত্য ছিলেন সম্রাটের খুব ঘনিষ্ঠ ও উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী। তিনি ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক, অহংকারী ও একটু কটাক্ষভরা স্বভাবের মানুষ। তাঁর অধীনস্ত কেউ কথা বললে তিনি শুধু ‘পি’ বলে উত্তর দিতেন, যার কোনো অর্থই হয় না। এতে বোঝা যায় তিনি ক্ষমতার গর্বে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতেন না। রাজা যখন কোকিল সম্পর্কে জানতে চাইলেন, তখন তিনিও কিছু জানতেন না, কারণ রাজসভা বা প্রাসাদের বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। তবু রাজদণ্ডের ভয়ে কোকিল খুঁজতে ছুটে বেড়ালেন। কোকিলকে প্রথম দেখেই তিনি ঠাট্টা করে বলেছিলেন—“এ আবার একটা পাখি নাকি!” এতে বোঝা যায়, তিনি প্রকৃত সৌন্দর্য ও অনুভূতির মূল্য বোঝেন না। তাঁর মধ্যে হৃদয়ের গভীরতা ছিল না, বরং শুধু চাকরি ও দায়িত্ব পালনে আগ্রহী ছিলেন।
খ) উত্তরঃ আসল কোকিল আর নকল কোকিলের মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমার মনে হয়, আসল কোকিল জীবন্ত, অনুভূতিপূর্ণ এবং হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক সঙ্গীতশিল্পী। তার গান প্রকৃতির কথা বলে, মনকে শান্ত করে এবং মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করে। সে গান গায় নিজের ইচ্ছেমতো, মনের টানে, তাই তার সুরে থাকে প্রাণ ও সত্যতা। অন্যদিকে, নকল কোকিল একটি যন্ত্রমাত্র। তার গান গৎবাঁধা, অনুভূতিশূন্য এবং কেবল চোখে ভালো লাগে, কিন্তু মনে দাগ কাটে না।
আসল কোকিল মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা সম্রাটকে গান শুনিয়ে বাঁচিয়ে তোলে, অথচ যন্ত্রপাখি দম ছাড়া কিছুই করতে পারে না। আমার মতে, যন্ত্র বা প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, তাতে জীবনের আবেগ থাকে না। আসল কোকিল যেমন দয়ালু, বিনয়ী ও নিঃস্বার্থ, তেমনই সে প্রকৃত শিল্পের প্রতীক। সে কোনো পুরস্কার চায় না, বরং মানুষের ভালোবাসাকেই সে সবচেয়ে বড় পুরস্কার মনে করে।
আসল কোকিল মানুষের ভালো-মন্দ, দুঃখ-কষ্টের খবর জানে, সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বাস্তব জীবনকে দেখে। তাই আমি মনে করি, জীবনের আসল মূল্যবোধকে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের আসল কোকিলের মতো হৃদয়বান শিল্পীকে ভালোবাসা উচিত। মেকি জিনিস কখনোই সত্যিকারের আনন্দ দিতে পারে না। তাই আমার মন বলে—আসল কোকিলই সত্যিকারের সুন্দর, সত্যিকারের মূল্যবান।
প্রশ্ন ২। ক. “কী পুরষ্কার চাস তুই বল”- এই কথাটি কে, কাকে বলেছে? কী কারণে পুরস্কার দিতে চেয়েছে? | ৩ |
খ. “যন্ত্রের চাকচিক্য কখনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিকল্প হয় না”-‘কোকিল’ গল্পে কীভাবে এ সত্য প্রকাশিত হয়েছে? বিশ্লেষণ কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ “কী পুরস্কার চাস তুই বল”—এই কথাটি চীন দেশের সম্রাট বলেছিলেন সত্যিকারের কোকিলকে। যখন সম্রাট মৃত্যুশয্যায় ছিলেন, তখন আসল কোকিল জানালার ধারে বসে মধুর গান গেয়ে সম্রাটকে সুস্থ করে তোলে। তার গান শুনে সম্রাটের শরীরে প্রাণ ফিরে আসে এবং মৃত্যুও দূরে সরে যায়। এই অসাধারণ দয়া ও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ভালোবাসার জন্য সম্রাট কোকিলকে খুব কৃতজ্ঞতা জানান এবং তাকে পুরস্কার দিতে চান। তাই তিনি বলেছিলেন, “তুই কী পুরস্কার চাস বল।” এতে বোঝা যায়, রাজা উপলব্ধি করেছিলেন, যান্ত্রিক কোকিল নয়—এই সত্যিকারের কোকিলই তাঁর প্রাণরক্ষাকারী এবং প্রকৃত বন্ধু। এ কারণেই তিনি তাকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন।
খ) উত্তরঃ হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্দেরসেনের ‘কোকিল’ গল্পে এই সত্যটি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। গল্পে দেখা যায়, সত্যিকারের কোকিল প্রাকৃতিকভাবে গান গায়, যার সুর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সে জেলের মন ভরে দেয়, সম্রাটের চোখে জল এনে দেয় এবং শেষমেশ মৃত্যুর মুখ থেকে সম্রাটকে উদ্ধার করে। অন্যদিকে, জাপান থেকে আসা কলের কোকিল দেখতে ঝলমলে, হীরেমুক্তো জড়ানো, কিন্তু তার গান গৎবাঁধা, একঘেয়ে ও প্রাণহীন। প্রথমদিকে সবাই সেই নকল পাখিকে নিয়ে মেতে ওঠে, তাকে প্রাসাদে রেখে দেয়, আর আসল কোকিলটি রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যখন আসল বিপদ আসে—যখন সম্রাট মৃত্যুশয্যায়—তখন কলের কোকিল আর কোনো কাজে আসে না, কারণ সে দম ছাড়া গাইতেই পারে না। অথচ তখনই ফিরে আসে সেই উপেক্ষিত, সত্যিকারের কোকিল, যে নিজের খেয়ালে গান গেয়ে রাজাকে বাঁচিয়ে তোলে।
এই গল্পে বোঝানো হয়েছে, যন্ত্রের বাহ্যিক চাকচিক্য যতই হোক না কেন, তার মধ্যে প্রাণ নেই, আবেগ নেই, হৃদয় নেই। আর প্রকৃত সৌন্দর্য ঠিক সেটাই—যা মন ছুঁয়ে যায়, হৃদয় স্পর্শ করে। যন্ত্র কিছু সময়ের জন্য আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি স্থায়ী শান্তি ও ভালোবাসা দিতে পারে। তাই বলা যায়, যন্ত্র কখনো প্রকৃতির বিকল্প হতে পারে না।
প্রশ্ন ৩। ক. সত্যিকারের কোকিল আর কলের কোকিলের মধ্যে মিল-অমিল উল্লেখ কর। | ৩ |
খ. ‘কোকিল’ গল্পের মূলকথা ও বিষয়বস্তু তোমার নিজের ভাষায় বিশ্লেষণ কর | ৭ |
ক) উত্তরঃ সত্যিকারের কোকিল আর কলের কোকিলের মধ্যে কিছু মিল ও অমিল আছে। উভয়েই গান গায় এবং মানুষকে আনন্দ দেয়—এটাই তাদের মিল। তবে তাদের মধ্যে মূল অমিল হলো—সত্যিকারের কোকিল প্রাণী, সে প্রকৃতির সন্তান, আর কলের কোকিল যন্ত্র, তাকে তৈরি করেছে মানুষ। আসল কোকিল নিজের ইচ্ছায় ডাকে, তার ডাক প্রাণভরা, সজীব ও মন ছুঁয়ে যায়। অন্যদিকে, কলের কোকিল নির্দিষ্ট সময়ে একই সুরে ডাকে, তার ডাক যান্ত্রিক ও প্রাণহীন। প্রকৃত কোকিলের গানে আবেগ ও স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে, কিন্তু কলের কোকিলের গানে থাকে না প্রকৃত আবেগ। কাজেই সত্যিকারের কোকিল প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক, আর কলের কোকিল কেবলমাত্র যান্ত্রিক অনুকরণ।
খ) উত্তরঃ উপরে লেখা আছে।
আরও পড়ুনঃ কোকিল গল্পের প্রশ্ন উত্তর ও বহুনির্বাচনি প্রশ্ন (MCQ) – ৮ম শ্রেণির বাংলা