হুমায়ূন আহমেদের ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’ গল্পে আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য যে এসেছে, তা যেন একটা কাল্পনিক বা মায়াবী উপাদান যা নিশানাথবাবুর একাকীত্ব ও দুঃখের মাঝে আশা জাগায়। দৈত্যের সঙ্গে তার কথোপকথন তার মনকে শান্তি দেয়। এই পোস্টে আলাউদ্দিনের চেরাগ গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
আলাউদ্দিনের চেরাগ গল্পের মূলভাব
নিশানাথবাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার স্ত্রী আর মেয়ে মারা গেছে, তাই তিনি একা থাকেন। চোখে সমস্যা থাকায় ভালো দেখতে পারেন না। একদিন তার চটের পেরেক ঠিক করতে গিয়েই তিনি একটি পুরানো লম্বাটে চেরাগ পেয়ে থাকেন। চেরাগটি নাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া উঠে একটি দৈত্য হাজির হয়। দৈত্য নিজেকে আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য বলে পরিচয় দেয় এবং নিশানাথবাবুর সব কথা মানবে বলে বলে। নিশানাথবাবুকে দৈত্য একটি পরশপাথর দেয়, যা দিয়ে যে কোনো ধাতু সোনায় পরিণত করা যায়। কিন্তু নিশানাথবাবু এই শক্তি ব্যবহার করতে চান না, কারণ তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না বলে ভাবেন। তিনি দৈত্যকে ছোট ছোট কাজই করতে বলেন, যেমন মশারি টাঙানো বা চা দেওয়া। তার সরলতা দেখে দৈত্য অবাক হয়। পরে নিশানাথবাবু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যুর আগে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বলেন, তার ঘরে একটি বড় বালতি আছে, যা তিনি স্কুলকে দান করছেন। বালতিটি আসলে সোনার তৈরি ছিল, কিন্তু কেউ জানতো না। পরে বালতিটি স্কুলের বারান্দায় রাখা হয় এবং একদিন সেটি চুরি হয়ে যায়। এই গল্প থেকে বোঝা যায়, নিশানাথবাবু ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি ধন-সম্পদে আকৃষ্ট হননি। তার জীবনের সহজ সুখ আর শান্তিই তার কাছে সবথেকে বড় মূল্য।
আলাউদ্দিনের চেরাগ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
১। ক. দৈত্য নিশানাথবাবুকে অদ্ভুত মানুষ বলেছে কেন? বুঝিয়ে লেখ। | ৩ |
খ. দৈত্যকে কি দয়ালু চরিত্র বলা যায়? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দাও। | ৭ |
ক) উত্তরঃ দৈত্য নিশানাথবাবুকে অদ্ভুত মানুষ বলেছে কারণ তিনি অন্য সবাইয়ের মতো টাকা-পয়সা বা ক্ষমতার জন্য লোভ করেন না। সাধারণ মানুষের মতো দৈত্য পাওয়ার পর সোনার মতো ক্ষমতা পেয়ে তিনি অনেক ধনী হতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেটা চান না। তিনি শুধু ছোট ছোট কাজে দৈত্যকে ব্যবহার করেন, যেমন মশারি খাটানো বা চা বানানো। তার সরলতা এবং নির্লোভতা দেখে দৈত্য খুব অবাক হয়। সবাই পারলে সোনার জিনিস চায়, কিন্তু নিশানাথবাবু চায় না। এ কারণেই দৈত্য তাকে অদ্ভুত মনে করেছে। তার জীবনের প্রতি এক ধরনের শান্তি ও সাদাসিধে ভাব ছিল, যা দৈত্যর জন্য অস্বাভাবিক। তাই দৈত্য নিশানাথবাবুকে অদ্ভুত বলেছে।
খ) উত্তরঃ দৈত্যকে দয়ালু চরিত্র বলা যায় কারণ সে নিশানাথবাবুর সব কথা মানে এবং তার সাহায্য করতে চায়। অনেক সময় আমরা দেখি যে দৈত্য বা জাদুকরী প্রেতাত্মারা তাদের শক্তি দিয়ে মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এই দৈত্য আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য হিসেবে নিশানাথবাবুর সব আদেশ মন থেকে পালন করে। সে তাকে কোনোরকম কষ্ট দেয় না, বরং তার ছোট ছোট দরকারগুলো মেটিয়ে দেয়, যেমন মশারি খাটানো বা চা বানানো। দৈত্য নিজের ক্ষমতা দেখানোর বদলে শান্ত ও নম্র থাকে। নিশানাথবাবুর সহজ জীবন আর তার নির্লোভ মনোভাব দেখে দৈত্য বিস্মিত হয় এবং তার ভালো মনোভাবও প্রকাশ পায়। এ কারণে বলা যায়, দৈত্যটি শুধু শক্তিশালীই নয়, বরং দয়ালু ও শ্রদ্ধাশীল। সে নিশানাথবাবুর প্রতি সম্মান দেখায় এবং তার কথা ভালোভাবে শোনে। তাই দৈত্যকে দয়ালু চরিত্র বলা যায়, কারণ সে মানুষের প্রতি সাহায্য করতে ইচ্ছুক এবং তাদের শ্রদ্ধা করে।
২। ক. দৈত্য নিশানাথবাবুকে স্বেচ্ছায় পরশপাথর দিতে চেয়েছে কেন? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. নিশানাথবাবু বালতিটি স্কুলকে দিয়েছিলেন কেন? বালতিটির পরিণতি কী হয়েছিল এবং কেন হয়েছিল? | ৭ |
ক) উত্তরঃ দৈত্য নিশানাথবাবুকে পরশপাথর দিতে চেয়েছিল কারণ সে দেখেছিল নিশানাথবাবুর জীবন খুব কষ্টের এবং সে দরিদ্র। নিশানাথবাবু অনেক কষ্টসহিষ্ণু, আর্থিক সমস্যায় ভুগছেন, কিন্তু তবুও কোনও অভিযোগ করেন না। দৈত্য চেয়েছিল তার জীবন একটু ভালো করতে, তাই সে তাকে পরশপাথর দিল যাতে সে ধনসম্পদ পেতে পারে। দৈত্য বিশ্বাস করেছিল, এই পরশপাথর দিয়ে নিশানাথবাবুর জীবন সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু নিশানাথবাবু এই সুযোগটি ব্যবহার করেননি। তিনি মনে করতেন, তার বাকি জীবন খুব কম, তাই এত ধনসম্পদ তার জন্য দরকার নেই। তাই দৈত্য তাকে সাহায্য করার জন্য নিজ থেকেই এই অমূল্য জিনিসটি দিয়েছিল।
খ) উত্তরঃ নিশানাথবাবু বালতিটি স্কুলকে দিয়েছিলেন কারণ তিনি স্কুলের প্রতি গভীর ভালোবাসা রাখতেন। তিনি তার শিক্ষক জীবন অনেক বছর স্কুলে কাটিয়েছেন, তাই স্কুলকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। বালতিটি আসলে সোনার তৈরি ছিল, কিন্তু নিশানাথবাবু কাউকে এটা জানাতে চাননি। তিনি চাইতেন এই বালতি দিয়ে স্কুল কিছু কাজ করতে পারে বা তার মান বাড়ে। কিন্তু তিনি তার রোগে খুব দুর্বল হয়ে পড়ে যাওয়ায় এবং মারা যাওয়ার পর বালতিটি স্কুলে রাখা হয়েছিল। পরে সেটি স্কুলের বারান্দায় রাখা অবস্থায় চুরি হয়ে যায়। বালতিটি চুরি হওয়ার কারণ ছিল, অনেকেই জানত বালতিটি মূল্যবান হতে পারে, তাই কেউ বা কেউ এটি চুরি করতে পারে। এর ফলে স্কুল সেই মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলে। এই ঘটনা দুঃখজনক হলেও দেখায় যে, অনেক সময় মানুষ ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করলেও বাইরের পরিবেশ বা অন্যদের কারণে সব কিছু ভালোভাবে হয় না। নিশানাথবাবুর ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও বালতিটি শেষ পর্যন্ত স্কুলের কাজে আসতে পারেনি।
৩। ক. নিশানাথ বাবু পরশপাথর পেয়েও আগ্রহ দেখালেন না কেন? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. “মনুষ্যত্বের প্রবল শক্তি এ গল্পে দারিদ্র্যকে পরাজিত করেছে।”-নিশানাথ চরিত্র অবলম্বনে উক্তিটি বিশ্লেষণ কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ নিশানাথবাবু পরশপাথর পেয়ে আগ্রহ দেখালেন না কারণ তিনি জানতেন তার বয়স বেশি এবং বেশি দিন বাঁচার আশা খুব কম। তার চোখে ছানি পড়ায় ভালো দেখতে পারেন না, আর তার স্ত্রী ও মেয়ে মারা যাওয়ায় তার একাকীত্ব ছিল। তাই জীবনের মায়া বা ধন-সম্পদের প্রতি তার কোনও লোভ ছিল না। তিনি মনে করতেন, “আমার তো আর বেশি দিন বাঁচব না, এত সোনা দিয়ে আমি কী করব?” তার জন্য ধন-সম্পদ কোনো সুখ বা প্রয়োজন নিয়ে আসবে না। তিনি সাধারণ, সরল ও নির্লোভ ছিলেন, তাই তিনি দৈত্যের দেয়া শক্তিকে ব্যবহার করে নিজের জীবনে সুবিধা নিতে চাননি। তার মনোভাব ছিল কষ্ট সহ্য করলেও জীবনের শেষ দিনগুলো শান্তিপূর্ণ কাটাবেন।
খ) উত্তরঃ নিশানাথবাবু দারিদ্র্য ভোগ করেও তার মনুষ্যত্ব বজায় রেখেছেন। তিনি একজন সরল, নির্লোভ এবং সৎ মানুষ ছিলেন। তার চোখে ছানি পড়েছিল, স্ত্রী-মেয়ে মারা যাওয়ায় জীবনে অনেক কষ্ট ছিল। তবু সে কোনো সময় টাকা-পয়সার লোভে পড়েননি। দৈত্য তাকে পরশপাথর দিলেও সে তার সাহায্য নিয়ে বড় ধরণের ধনসম্পদ অর্জন করতে চায়নি। কারণ তার মনে হয়, তার বয়স বেশি এবং বেশি দিন বাঁচার আশা নেই। সে চেয়েছিল জীবন যতটা সম্ভব শান্তিপূর্ণ ও সাদামাটা হোক। এতে দেখা যায় তার মনুষ্যত্ব অর্থের চেয়ে অনেক বড়। দারিদ্র্য থাকলেও তার চরিত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার সহজ-সরল জীবন, অন্যের প্রতি সদয় মনোভাব এবং অহংকারের অভাব তার মনুষ্যত্বকে আরও উজ্জ্বল করেছে। এই গল্প আমাদের শেখায়, সত্যিকারের ধন-সম্পদ অর্থ নয়, বরং ভালোবাসা, ধৈর্য এবং সহানুভূতি। তাই নিশানাথবাবু দারিদ্র্যকে হারিয়েছেন তার মানবিক গুণের কাছে। তার চরিত্র থেকে বোঝা যায়, মানুষের আসল শক্তি তার চরিত্রে এবং মনুষ্যত্বে লুকিয়ে থাকে, যা কোনো ধন-সম্পদ দিয়ে অর্জিত হয় না। তিনি আমাদের জীবনের মূল্যবোধ শিখিয়েছেন। দারিদ্র্যের মাঝেও মনুষ্যত্ব থাকলে মানুষ বড় হতে পারে। এজন্য বলা যায়, নিশানাথবাবু তার মনুষ্যত্বের শক্তি দিয়ে দারিদ্র্যকে পরাজিত করেছেন।
আরও পড়ুনঃ সাত ভাই চম্পা গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর