‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম এখানে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভাব ও কাজের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও বাস্তবে এ দুটি আলাদা জিনিস। শুধুমাত্র ভাব বা আবেগ দিয়ে কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়, যদি না তা বাস্তব কর্মে রূপ নেয়। এই পোস্টে ভাব ও কাজ প্রবন্ধের অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর লিখে দিলাম।
ভাব ও কাজ প্রবন্ধের অনুধাবন প্রশ্ন
১। ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধে ‘ভাব’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘ভাব’ বলতে মূলত আবেগ, অনুভূতি এবং আদর্শগত চেতনার কথা বোঝানো হয়েছে। এটি সুগন্ধহীন ফুলের মতো, যা কেবলমাত্র অনুপ্রেরণা জাগাতে পারে কিন্তু নিজে কোনো কার্যকর ফল দেয় না। কাজী নজরুল ইসলাম মনে করেন, শুধু ভাব থাকলে কোনো বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব নয়, তাকে কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করতে হবে।
২। ‘ভাব ও কাজ’ পরস্পরের মধ্যে কী সম্পর্ক?
উত্তর: ‘ভাব ও কাজ’ একে অপরের পরিপূরক হলেও তাদের পার্থক্য আছে। ভাব হলো উচ্ছ্বাস, অনুপ্রেরণা, আর কাজ হলো বাস্তব দুনিয়ায় সেই ভাবের রূপায়ণ। শুধুমাত্র ভাব থাকলে তা কর্পূরের মতো উড়ে যায়, আর শুধুমাত্র কাজ থাকলে তা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। সঠিক ফল পেতে হলে ভাবকে কাজে রূপ দিতে হবে।
৩। লেখক কীভাবে ‘ভাব’ ও ‘কাজ’-এর তুলনা করেছেন?
উত্তর: লেখক ‘ভাব’কে সুগন্ধহীন ফুল এবং ‘কাজ’কে সৌরভবিহীন ফুল হিসেবে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ, শুধুমাত্র ভাব থাকলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, আবার শুধু কাজ করলেও অনুপ্রেরণা থাকেনা। তাই কার্যকর পরিবর্তনের জন্য এই দুটিকে একসঙ্গে রাখতে হবে।
৪। কেবল ভাবপ্রবণ হলে কী সমস্যা হয়?
উত্তর: কেবল ভাবপ্রবণ হলে মানুষ সাময়িকভাবে উত্তেজিত হয়, কিন্তু পরে কাজের অভাবে সেই ভাবাবেগ কর্পূরের মতো মিলিয়ে যায়। এতে লোকজন হতাশ হয়ে পড়ে, ভবিষ্যতে আর কোনো কাজে অংশ নিতে চায় না। এভাবে সমাজের প্রকৃত অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
৫। লেখক কেন ‘ভাবের বাঁশি বাজানো’কে সতর্কতার সাথে দেখেছেন?
উত্তর: কারণ, শুধুমাত্র ভাবপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করা হলে, কার্যসিদ্ধি না হলে সেই উত্তেজনা ধীরে ধীরে মিইয়ে যায়। এতে মানুষ ভবিষ্যতে সত্যিকারের ডাক এলে সাড়া দিতেও দ্বিধা করে। তাই ভাবের সঠিক ব্যবহার জরুরি।
৬। ‘সোনার কাঠির ছোঁওয়া’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘সোনার কাঠির ছোঁওয়া’ বলতে লেখক এমন এক প্রেরণা বোঝাতে চেয়েছেন, যা মানুষকে জাগিয়ে তোলে। তবে এর জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে, নতুবা প্রেরণা ক্ষণস্থায়ী হয়ে যাবে এবং লোকজন হতাশ হবে।
৭। ভাব ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য কী করতে হবে?
উত্তর: লেখক বলেছেন, আগে থেকেই পরিকল্পনা করে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, তারপর ভাবের মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। না হলে মানুষ সাময়িক উত্তেজিত হলেও পরবর্তীতে হতাশ হয়ে পড়বে এবং আর কোনো উদ্যোগে অংশ নেবে না।
৮। ‘কুম্ভকর্ণের নিদ্রা’ রূপকের অর্থ কী?
উত্তর: কুম্ভকর্ণের নিদ্রা বলতে বোঝানো হয়েছে গভীর নিদ্রা বা চেতনার অভাব। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে, যদি অপ্রস্তুত অবস্থায় ভাবের উত্তেজনায় মানুষকে আন্দোলিত করা হয়, পরে তারা হতাশ হয়ে পড়বে এবং আর জাগানো যাবে না।
৯। আবেগপ্রবণ মানুষের কী সমস্যা হয়?
উত্তর: আবেগপ্রবণ মানুষ মুহূর্তের উত্তেজনায় কাজ শুরু করলেও টেকসই পরিকল্পনা ছাড়া তারা বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। এতে তাদের বিশ্বাস হারিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে আর কোনও পরিবর্তন আনতে পারে না।
১০। ‘সাপ লইয়া খেলা’ রূপকের অর্থ কী?
উত্তর: ‘সাপ লইয়া খেলা’ রূপকটি কাজী নজরুল ইসলাম একটি সতর্কীকরণের জন্য ব্যবহার করেছেন। তিনি বলছেন, যেমন সাপ নিয়ে খেললে বিপদ ঘটতে পারে, তেমনি আবেগ ও ভাবের অতিরিক্ত উত্সাহে কাজ শুরু করা বিপজ্জনক হতে পারে। যদি পরিকল্পনা বা সুস্থ বিচারবোধের অভাব থাকে, তাহলে সেই কাজ ফলপ্রসূ হবে না এবং বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
১১। ভুলভাবে ভাব জাগালে কী হয়?
উত্তর: লেখক বলেছেন, যদি অযথা বা ভুলভাবে ভাব জাগানো হয়, তাহলে মানুষ সে ভাবের মাধ্যমে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারে এবং তার পরিকল্পনা বা কাজ শুরুর আগেই সেটি ভেস্তে যাবে। যদি অনুপ্রেরণা বা আবেগের সাথে সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকে, তাহলে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিছুদিন পরেই মিইয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তা কার্যকরী হবে না।
১২। লেখক কেন তরুণদের হতাশা নিয়ে চিন্তিত?
উত্তর: লেখক তরুণদের উপর বেশি জোর দিয়েছেন, কারণ তরুণরা বেশিরভাগ সময় অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ এবং তারা ভাবের প্রবাহে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। যদি পরিকল্পনা বা বাস্তবতা বুঝে না কাজ করা হয়, তবে তরুণরা দ্রুত হতাশ হয়ে পড়ে, যা তাদের ভবিষ্যতে কোনো বৃহত্তর কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
১৩। লেখক ‘উন্মত্ত ষাঁড়’-এর উদাহরণ কেন দিয়েছেন?
উত্তর: লেখক ‘উন্মত্ত ষাঁড়’-এর উদাহরণ দিয়েছেন একটি প্রবৃত্তির বিপজ্জনকতা বোঝানোর জন্য। ষাঁড়টি যখন উন্মত্ত হয়, তখন তার কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে না, সে শুধু বিপদ সৃষ্টি করে। ঠিক তেমনি, যদি কোনো কাজে সঠিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য না থাকে, তবে সেটি বিশৃঙ্খলা এবং অকার্যকর ফলাফল হতে পারে।
১৪। লেখক কর্মীদের কী পরামর্শ দিয়েছেন?
উত্তর: লেখক কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন, যে কোনো কাজ শুরু করার আগে সতর্ক থাকতে হবে এবং পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। শুধু আবেগ ও ভাবের উপরে ভরসা করা ঠিক নয়, কারণ তার জন্য কর্মপ্রয়াস ফলপ্রসূ হবে না। সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং বাস্তব অবস্থান বিচার করে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
১৫। আবেগের ‘সুরা’ পান করার সময় কী করা উচিত?
উত্তর: আবেগের সুরা পান করা মানে হলো, অন্তর থেকে তীব্র আবেগ অনুভব করা, যা মানুষের কাজের প্রতি আগ্রহ এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। তবে লেখক বলেন, এই অবস্থায় মনের বিশুদ্ধতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানো উচিত নয়। যদি আবেগের সুরা পান করে মনে কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তবে সেটা কর্মের প্রতি অবিচার হতে পারে।
১৬। লেখক ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ কথাটি কেন বলেছেন?
উত্তর: লেখক ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ কথাটি ব্যবহার করেছেন এক ধরনের সমাজবীক্ষণ হিসেবে। যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী একাধিক অপ্রত্যাশিত কাজ করে, তখন তাদের উদ্দেশ্য আর স্পষ্ট থাকে না। যেমন দশটি বিপথে যাওয়া চক্রের মাঝে কোনো সত্য বা লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। এভাবে চতুর্দিকের অকার্যকর কাজ সমাজের জন্য বিপদজনক হতে পারে।
১৭। তরুণদের কীভাবে কাজ করা উচিত?
উত্তর: লেখক তরুণদের পরামর্শ দিয়েছেন, তারা যেন ভাব ও আবেগের পাশাপাশি বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সঠিক পরিকল্পনা করে কাজ করে। তরুণদের মধ্যে শক্তি ও উদ্যম রয়েছে। তরুণদের উচিত আগ্রহের সাথে যুক্ত কাজকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে তাদের কার্যক্রম জাতির জন্য উপকারী হয় এবং তারা নিজেরাও সফল হয়।
১৮। লেখক কীভাবে উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেন?
উত্তর: লেখক বলেছেন, উন্নতি সম্ভব যখন ভাব ও কাজ একসঙ্গে চলে। তিনি বলেন, শুধু ভাব কিংবা শুধু কাজ নয়, বরং ভাবকে কাজে রূপান্তরিত করলেই জাতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা, আবেগ ও চিন্তা-ভাবনা থাকতে হবে, তবে সেই ভাবকে সঠিক পরিকল্পনা ও কাজের মাধ্যমে কার্যকরীভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে।