মানুষ কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন

কাজী নজরুল ইসলামের “মানুষ” কবিতায় সাম্য ও মানবিকতাবোধের এক গভীর দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। কবি সমাজের নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষদের কথা তুলে ধরেছেন। এই পোস্টে মানুষ কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন করে দিলাম।

মানুষ কবিতার ব্যাখ্যা

“গাহি সাম্যের গান— মানুষ চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”:
এখানে কবি সাম্যের গান গাওয়ার মাধ্যমে জানান দেন যে, প্রকৃত সত্য হলো মানুষই সবচেয়ে বড়। সমাজে প্রচলিত উচ্চ-নীচ, জাতি-বর্ণের ভেদাভেদ নিয়ে কবির কোনো আগ্রহ নেই, কারণ তার দৃষ্টিতে মানবসমাজের সব মানুষ সমান, মহৎ।

“নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি”:
এই লাইনগুলোয় নজরুল বোঝাতে চেয়েছেন যে, মানবতা কেবল একটি নির্দিষ্ট স্থান, কাল বা জাতির জন্য নয়। বিশ্বের প্রতিটি ঘর, প্রতিটি সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষ একইভাবে মানবতার সেবায় প্রার্থিত। এখানে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ নেই, সবার পরিচয় এক—মানুষ।

“‘পূজারী, দুয়ার খোলো, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!”
কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে এক ক্ষুধার্ত মানুষের কাতর আকুতি। সে পূজারিকে ডেকে বলছে, পূজা করার জন্য দরজা খোলো। এখানে “ক্ষুধার ঠাকুর” বলতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে ক্ষুধার্ত মানুষই প্রকৃত দেবতা, যাকে তুষ্ট করতে না পারলে দেবতার পূজাও অসম্পূর্ণ।

“স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়, দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয়!”:
এই অংশে পূজারী তার স্বপ্নে দেবতার প্রতিশ্রুতি দেখে ভজনালয়ের দরজা খুলে দেয়, এই আশায় যে, দেবতা তাকে রাজা বানাবেন। এখানে কবি ইঙ্গিত দেন ধর্মের ব্যবস্থাপনার কিছু লোক নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে দেবতার আরাধনা করে।

“জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ— ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনি তো সাত দিন!'”:
কবিতায় এক ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত পথিক দরজা খুলে খাবারের আকুতি জানাচ্ছে। তার গায়ের জীর্ণ-বস্ত্র, কণ্ঠ ক্ষীণ, এসবের মাধ্যমে কবি দরিদ্র, অপুষ্ট মানুষের চেহারার ছবি তুলে ধরেছেন। মানুষের এই তীব্র কষ্ট ও দুরবস্থাকে দেবতার দরবারে তুলে ধরতে চেয়েছেন নজরুল।

“সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারি ফিরিয়া চলে, তিমিররাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!”:
মন্দিরের দরজা বন্ধ হওয়ার পর ভুখারি কষ্ট নিয়ে ফিরে যায়। কবি এই দৃশ্যের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন ধর্মের নামে যেই নিষ্ঠুরতা, সেই অন্ধকার রাত্রির মধ্যে তার ক্ষুধার আগুনই তার পথকে আলোকিত করছে।

“ভুখারি ফুকারি’ কয়, ‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়।”
ক্ষুধার্ত পথিক আক্ষেপ করে বলে, যে মন্দির পূজারির, সেখানে প্রকৃত দেবতা নেই। আসল দেবতা যদি থাকত, তবে দরজা বন্ধ হয়ে যেত না। এই অংশে কবি মন্দিরের সংকীর্ণতা ও পূজারির স্বার্থপরতার সমালোচনা করেছেন।

“মসজিদে কাল শিরনি আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি”:
এ অংশে কবি এক মসজিদের মোল্লার স্বার্থপর মনোভাব তুলে ধরেছেন। মসজিদে প্রচুর খাবার বেঁচে আছে, যা দেখে মোল্লা আনন্দে হাসছে। কিন্তু যখন একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি খাবার চায়, তখন সে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।

“ভুখারি কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল- ‘তা হলে শালা সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা”:
এই অংশে, ভিখারি জানায় যে সে নামাজ পড়ে না, আর মোল্লা তাকে তাড়িয়ে দিয়ে মসজিদের দরজা বন্ধ করে দেয়। কবি এখানে ধর্মীয় ভণ্ডামির তীব্র নিন্দা করেছেন, যেখানে আচার পালন বড় হয়ে ওঠে মানবতার চেয়ে।

“চলিতে চলিতে বলে—‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি প্রভু”:
এখানে ভুখারি স্রষ্টার প্রতি তার অনুভূতি জানায়। সে ভাবছে, সে কখনো স্রষ্টাকে ডাকেনি, তবু স্রষ্টা তার অন্নের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মানুষ যেন স্রষ্টার নামে কেবল দরজা বন্ধই করে যাচ্ছে।

“কোথা চেঙ্গিস, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার”:
কবি এখানে ঐতিহাসিক চেঙ্গিস খান, গজনি সুলতান মাহমুদ ও কালাপাহাড়কে স্মরণ করেন, যারা অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছিলেন। তাদের মতোই তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত ভণ্ড ধর্মব্যবস্থা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানাচ্ছেন।

“তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!”
এই চরণে কবি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাদের প্রতি, যারা ধর্মের নামে নিজ স্বার্থসিদ্ধি করে। মসজিদ-মন্দিরের মিনারে উঠে যারা মানুষকে পরিতৃপ্তির জন্য খাদ্য না দিয়ে ফিরে পাঠায়, তাদের প্রতি কবির ঘৃণা এখানেই ফুটে উঠেছে।

এইভাবে “মানুষ” কবিতায় নজরুল মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি, আর সমাজে বিদ্যমান ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেছেন।

Related Posts

Leave a Comment