কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি, যা কবির বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটায়। এই পোস্টে বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন -একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।
বিদ্রোহী কবিতার ব্যাখ্যা লাইন বাই লাইন
কবি কাজী নজরুল ইসলাম শক্তিশালী এবং চিত্তাকর্ষক ভাষায় তাঁর বিদ্রোহী সত্তার কথা বলেছেন। নিচে বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি লাইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
প্রথম স্তবক
বল বীর – বল উন্নত মম শির!
- কবি শুরুতেই তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং গর্বের সাথে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি এই চিৎকারে বলছেন, “আমি বীর,” যা তাঁর শক্তি ও সাহসকে তুলে ধরে।
শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
- তিনি বলেন, তাঁর মাথা সব সময় উঁচু, অন্যদের নিচু মাথার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন। শিখর হিমাদ্রির দিকে নতশির হচ্ছে, যেখানে অন্যরা আত্মসমর্পণ করছে।
আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
- কবি নিজেকে শক্তিশালী, অবিনাশী এবং নির্মম হিসেবে প্রকাশ করছেন। “চিরদুর্দম” শব্দটি দিয়ে তিনি তাঁর অটলতা বোঝাচ্ছেন।
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
- এখানে তিনি নিজেকে প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক শক্তির সাথে তুলনা করছেন, যেমন মহাপ্রলয় ও সাইক্লোন। “নটরাজ” বলতে তিনি সৃষ্টির ও ধ্বংসের শক্তির কথা বলছেন।
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
- কবি বলেন, তিনি ভয় এবং অভিশাপের প্রতীক, অর্থাৎ তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভয় প্রদর্শন করছেন।
আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
- তিনি দুর্বার অর্থাৎ অপ্রতিরোধ্য, যিনি সব কিছু ভেঙে ফেলতে পারেন।
দ্বিতীয় স্তবক
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
- কবি বলেছেন, তিনি নিয়ম ও শৃঙ্খলা মানেন না, বরং সেগুলোকে ভেঙে ফেলতে চান।
আমি মানি না কো কোন আইন,
- এখানে তিনি আরও স্পষ্টভাবে বলছেন, তিনি কোনো আইনকে মানছেন না।
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন।
- কবি নিজেকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করছেন, যিনি প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেন।
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
- তিনি প্রকৃতির শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন।
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
- কবি তার বিদ্রোহী সত্তার ঘোষণা করেন, বোঝাচ্ছেন যে তিনি বিশ্ব-সৃষ্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন।
তৃতীয় স্তবক
বল বীর – চির-উন্নত মম শির!
- এখানে তিনি আবার তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং গর্ব পুনর্ব্যক্ত করছেন।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান।
- তিনি জীবনের সমস্ত দিক এবং সৃষ্টির প্রতি সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
- এখানে তিনি উচ্চমানের শক্তি ও প্রতীকগুলোকে একত্রিত করছেন, যেমন সূর্য এবং চাঁদ।
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য;
- কবি শান্তির প্রতীক বাঁশির সাথে যুদ্ধের প্রতীক তূর্যকে মিলিত করছেন।
চতুর্থ স্তবক
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
- এখানে তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরছেন, যে সমস্ত নায়ক এবং বিদ্রোহীরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
- তিনি বলছেন, কাউকেই তিনি মাথা নত করবেন না।
পঞ্চম স্তবক
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
- কবি স্বশক্তি ও শক্তি প্রদানের জন্য নানা ধর্মীয় ও পৌরাণিক প্রতীক ব্যবহার করছেন।
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
- এখানে তিনি পৌরাণিক অস্ত্রের সাথে নিজেকে তুলনা করছেন, যা তাঁর শক্তি ও প্রতিশ্রুতিকে দৃঢ় করে।
ষষ্ঠ স্তবক
আমি ক্ষ্যাপা দুরবাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
- তিনি এখানেও নিজের বিদ্রোহী সত্তাকে প্রমাণ করছেন, যিনি আবেগের তীব্রতায় আচ্ছন্ন।
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
- তিনি বলেন, তাঁর বিদ্রোহ এমনই, যা সমস্ত পৃথিবীকে দাহিত করতে পারে।
বিদ্রোহী কবিতার লাইনের ব্যাখ্যা
সপ্তম স্তবক
আমি উন্মন মন উদাসীর,
- কবি এখানে মানবিক আবেগ ও চেতনার কথা বলছেন।
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
- এখানে তিনি দুর্বল মানুষের বেদনা ও কষ্ট প্রকাশ করছেন।
অষ্টম স্তবক
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
- কবি তাদের কথা বলছেন যারা সমাজে অবহেলিত, তাঁদের কষ্ট এবং বঞ্চনা তুলে ধরছেন।
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
- এখানে তিনি অবমাননার মুখে থাকা মানুষের ভেতরের যন্ত্রণা ও দহন প্রকাশ করছেন।
নবম স্তবক
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
- কবি আবার শক্তি ও পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন।
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
- তিনি কবি ও সুরকার হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাচ্ছেন।
দশম স্তবক
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
- এখানে তিনি জীবনের বিভিন্ন আবহাওয়া ও পরিস্থিতির সাথে নিজেকে সংযুক্ত করেছেন।
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
- কবি জীবনের প্রক্রিয়ার বিচিত্র রূপগুলো তুলে ধরছেন।
একাদশ স্তবক
আমি অফিয়াসের বাঁশরী,
- তিনি কবি হিসেবে নিজেকে দ্যুতিময় হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম ঘুম
- এখানে তিনি সামগ্রিক প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ধরছেন।
দ্বাদশ স্তবক
আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
- তিনি শক্তি ও ধ্বংসের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
- কবি বলেছেন, যখন তিনি বিদ্রোহে ওঠেন, তখন পৃথিবী কাঁপে।
ত্রয়োদশ স্তবক
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
- এখানে তিনি বলেন, তাঁর বিদ্রোহের শক্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
চতুর্দশ স্তবক
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
- এখানে তিনি কঠোরতা এবং শৃঙ্খলার কথা বলছেন।
পঞ্চদশ স্তবক
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি
- তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত অত্যাচারীরা থাকবে, ততক্ষণ তিনি ক্লান্ত হবেন না।
ষোলোতম স্তবক
আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না—
- কবি তাঁর শান্তির দিনটির স্বপ্ন দেখছেন, যখন অত্যাচার বন্ধ হবে।
শেষ স্তবক
আমি চির-বিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
- কবি আবারও নিজের বিদ্রোহী সত্তার ঘোষণা করছেন, বোঝাচ্ছেন যে তিনি চিরকাল বিদ্রোহী থেকে যাবেন।
Related Posts
- তাহারেই পড়ে মনে কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন (সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন)- একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- প্রতিদান কবিতার মূলভাব বা পাঠ পরিচিতি সহজ ভাষায়
- মাসি পিসি গল্পের অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর-একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- একটি তুলসী গাছের কাহিনী গল্পের মূল বিষয়বস্তু – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন -একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর -একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- বিলাসী গল্পের সারাংশ বা মূল বিষয়বস্তু – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- আমি কিংবদন্তির কথা বলছি অনুধাবন প্রশ্ন উত্তর -একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- তাহারেই পড়ে মনে কবিতার মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা