আমি কোনো আগন্তুক নই কবিতার ব্যাখ্যা প্রতিটি লাইনের

আহসান হাবীবের “আমি কোনো আগন্তুক নই” কবিতায় কবি জন্মভূমির সঙ্গে তাঁর অটুট সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। এখানে গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রা এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধন প্রকাশিত হয়েছে। এই পোস্টে আমি কোনো আগন্তুক নই কবিতার ব্যাখ্যা প্রতিটি লাইনের ও মূলভাব লিখে দিলাম।

আমি কোনো আগন্তুক নই কবিতার ব্যাখ্যা

“আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই”

কবি আসমানের তারাদের এবং জমিনের ফুলকে সাক্ষী করে তুলেছেন। এই শব্দচয়ন দিয়ে কবি বোঝাতে চান যে তাঁর সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক গভীর এবং দৃঢ়। তারারা, ফুল, সবাই তাঁর পরিচিত।

“নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী”

বাঁশবাগান, জোনাকি, জারুল এবং জামরুল গাছের কথাও কবি উল্লেখ করেছেন। এরা সবাই কবির জীবনের অংশ এবং তাঁর এই দেশপ্রেমে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবির এই স্বদেশপ্রেমের অনুভূতির সঙ্গে প্রকৃতির একাত্মতা প্রকাশ পায়।

“পুবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের ডালে স্থির দৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে”

কবি পুবের পুকুর এবং ডুমুর গাছের শাখায় বসে থাকা মাছরাঙার প্রসঙ্গ টানেন। এই মাছরাঙা কবিকে চিনে, বোঝাতে চান তিনি কোনো নতুন আগন্তুক নন; তাঁর সঙ্গে এই জীবজগতের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে।

“আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশি পথিক নই আমি কোনো আগন্তুক নই।”

কবি ঘোষণা করছেন যে তিনি বিদেশি নয়, বরং এই ভূমিরই একজন। তিনি এখানে নতুন কেউ নন বরং তাঁর শিকড় এই মাটির গভীরে প্রোথিত।

“আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর”

তিনি আবারও উল্লেখ করেন যে, তিনি এখানে নবাগত নন, বরং এখানে থাকেন এবং তাঁর জীবনযাপনের সঙ্গে এখানকার পরিবেশ ও প্রকৃতি একীভূত।

“এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা
সারা দেশে।”

কবি এখানে বলেন যে, তাঁর এই এক জায়গায় থাকাই যেন পুরো দেশে ছড়িয়ে থাকার সমান। এভাবে তাঁর অন্তরের সঙ্গে মাটির সংযোগকে শক্তিশালী করে তোলেন।

“আমি কোনো আগন্তুক ন‍ই। এই
খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের”

কবি আবারও জানান যে তিনি আগন্তুক নন এবং রোদ, বাতাস, মেঘ, ক্লান্ত বিকেলের মতো প্রকৃতির অংশ হয়ে রয়েছেন।

“পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।”

পাখিরাও কবিকে জানে এবং তারা কবিকে অপরিচিত মনে করে না। এতে বোঝা যায় যে কবি প্রকৃতির সঙ্গে একটি অন্তর্নিহিত সংযোগ অনুভব করেন।

“কার্তিকের ধানের মঞ্জরি সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার”

কার্তিক মাসের ধান, চিরোল পাতার প্রতিটি ঝরনা কবির সঙ্গে সাক্ষী হয়ে রয়েছে, যা কবির সঙ্গে বাংলার কৃষি, প্রকৃতি ও ঋতুচক্রের যোগসূত্রকে তুলে ধরেছে।

“টলমল শিশির – সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া”

শীতের শিশির, জ্যোৎস্না ঢাকা নিশিন্দার ছায়া—এগুলো কবির সঙ্গে থাকা আবেগের অংশ। কবি প্রকৃতির এই সাধারণ সৌন্দর্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান।

“অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার”

এখানে কবি উল্লেখ করেন গ্রামীণ চরিত্র কদম আলীকে, যার অকাল বার্ধক্য এবং ক্লান্ত চোখ কবিকে পরিচিত। কবি এই মানুষের ক্লান্তি ও সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে আত্মস্থ করে নেন।

“আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা-র
শূন্য খাঁ খাঁ রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি।”

কবি এখানকার প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের সদস্য এবং তাদের দৈনন্দিন সংগ্রামকে চেনেন। জমিলার মা’র রান্নাঘরের শূন্য থালাও তাঁর কাছে পরিচিত।

“সে আমাকে চেনে ।
হাত রাখো বৈঠায় লাঙলে, দেখো”

কবি ঘোষণা করছেন যে, গ্রামবাসী তাঁকে জানে। বৈঠা বা লাঙলের সঙ্গে তাঁর হাতের যোগসাজশও তিনি তুলে ধরেছেন।

“আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।”

কবির শরীরে গ্রামের মাটির গন্ধ মিশে রয়েছে। তাঁর সঙ্গে এই মাটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে যা তাঁকে ঐ মাটিরই অংশ বানিয়ে রেখেছে।

“আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।
দুপাশে ধানের খেত”

কবি আবারও তাঁর দেশপ্রেম ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটান এবং জানান যে তিনি আগন্তুক নন। ধানের খেত তাঁর চেনা।

“সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক ।”

কবি তাঁর অস্তিত্বকে সরু পথে এবং নদীর কিনারায় অনুভব করেন। তিনি যেন এই পথেই এক ছোট্ট অবোধ বালকের মতো মুগ্ধ হয়ে থাকেন। কবি জানিয়ে দিতে চান যে তাঁর এই অনুভূতি প্রকৃতির সঙ্গে তার আজন্মের বন্ধনকেই প্রকাশ করে।

আমি কোনো আগন্তুক নই কবিতার মূলভাব

আহসান হাবীবের “আমি কোনো আগন্তুক নই” কবিতায় কবি তাঁর জন্মভূমির প্রতি গভীর সম্পর্ক এবং মমত্ববোধকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে প্রকাশ করেছেন। কবিতায় তিনি গ্রামীণ জীবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সেখানকার মানুষের সঙ্গে তাঁর অন্তর্নিহিত সম্পর্কের কথা বলেছেন। কবিতার বিভিন্ন স্তবকে কবি প্রকৃতির নানা উপাদান, যেমন ধানক্ষেত, নদীর তীর, গ্রামের ঝোপঝাড় ও জীবজন্তু—এসবের কথা বলেছেন। এগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামের সৌন্দর্য ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। যখন তিনি বলেন, “আমি কোনো আগন্তুক নই,” তখন তিনি দৃঢ়ভাবে বুঝিয়ে দেন যে, তিনি এই জায়গারই মানুষ; আকাশ, নদী, পুকুর, পাখি, ফুল—সব তাঁকে চিনে। গ্রামের মানুষের প্রসঙ্গেও কবি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কদম আলী ও জাদিলার মা’র মতো চরিত্রদের উল্লেখ করে তিনি বোঝান যে, এরা তাঁর নিকটজন, তাঁর সঙ্গী। তাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন, যেন তিনি তাঁদের দুঃখ-কষ্টেরও ভাগীদার। এই কবিতার মাধ্যমে কবি তাঁর জন্মভূমির সঙ্গে একটি অদৃশ্য সেতু স্থাপন করেছেন। জন্মভূমি যে কেবল একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং এটি এমন এক অনুভূতি যা তাঁর অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, তা তিনি প্রকাশ করেছেন।

Related Posts

Leave a Comment