রেইনকোট গল্পের মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্পটি একটি প্রতীকী গল্প। এ গল্পে ফুটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের অন্তরেও জেগে ওঠে, যারা দেশ ও জাতির প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করে। এই পোস্টে রেইনকোট গল্পের মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম।

রেইনকোট গল্পের মূলভাব সংক্ষেপে

“রেইনকোট” গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঢাকার পরিস্থিতিকে প্রতিফলিত করে। এখানে দেখা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মাঝে সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষকদের জীবনে আতঙ্ক কীভাবে বাসা বেঁধেছিল। গল্পের মূল চরিত্র নুরুল হুদা, একজন নিরপেক্ষ এবং ভীরু প্রকৃতির শিক্ষক, যিনি যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছিলেন। তিনি ভাবতেন নিরপেক্ষ থেকে হয়তো পরিস্থিতি সামলানো যাবে। কিন্তু এক গেরিলা আক্রমণের পর, তাকে সন্দেহ করে পাকিস্তান মিলিটারি ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মম নির্যাতন চালায়। গল্পে নুরুল হুদা তার শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর রেইনকোট পরে কলেজে যান। এই রেইনকোট তার মধ্যে দেশপ্রেম ও সাহসের সঞ্চার করে। যুদ্ধে না গিয়েও তিনি অনুভব করেন কেন তরুণরা যুদ্ধে যাচ্ছে এবং কেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তার বিবেক জাগ্রত হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার মনে আলোড়ন তোলে, এবং তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেন। এই প্রতীকী গল্পটি আমাদের দেখায় যে দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল রণাঙ্গনেই নয়, প্রতিটি বিবেকবান মানুষের অন্তরেও বিদ্যমান।

রেইনকোট গল্পের মূলভাব বড় করে

“রেইনকোট” গল্পটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি শক্তিশালী প্রতীকী গল্প। এতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকার যুদ্ধাবস্থা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচার, এবং সাধারণ মানুষের মাঝে চলমান আতঙ্কের চিত্র ফুটে উঠেছে। গল্পটির মূল চরিত্র নুরুল হুদা, একজন সাধারণ ও নিরীহ প্রকৃতির কলেজ শিক্ষক, যিনি যুদ্ধের চরম সময়ে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেও অবশেষে পাকিস্তানি বাহিনীর সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। এ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই একটি সাধারণ মানুষ কিভাবে চেতনায় মুক্তিযোদ্ধার সমান হয়ে উঠতে পারে।

গল্পটি শুরু হয় ঢাকার শহরের এক ভয়াবহ দিনের কাহিনী দিয়ে, যেখানে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা কলেজের সামনে আক্রমণ চালিয়ে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করে দেয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর রোষানলে পড়ে কলেজের শিক্ষকগণ। পরবর্তীতে, পাকিস্তানি মিলিটারিরা তদন্তের জন্য কয়েকজন শিক্ষককে ডেকে পাঠায়, যাদের মধ্যে নুরুল হুদাও একজন। নুরুল হুদা, যিনি বরাবরই নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিলেন, নিজের ভেতরে একটি দ্বন্দ্ব অনুভব করতে থাকেন। তিনি সবসময়েই শান্তিপ্রিয় এবং ভীতু প্রকৃতির মানুষ, তাই যুদ্ধের প্রতি তাঁর সরাসরি কোনো সায় ছিল না। কিন্তু এহেন পরিস্থিতিতেও তিনি শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত সময়ে কলেজে উপস্থিত হন।

গল্পে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এক রেইনকোটের উপর, যা নুরুল হুদা তাঁর শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। বৃষ্টির দিনে সেই রেইনকোট গায়ে দিয়ে তিনি কলেজে যান। এখানে রেইনকোটটি শুধুমাত্র একটি পরিধেয় বস্ত্র নয়, বরং এটি মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর সাহস এবং দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক। এটি গায়ে দিয়ে নুরুল হুদা নিজেকে আলাদাভাবে অনুভব করতে শুরু করেন; একটি অদ্ভুত উষ্ণতা এবং সাহস তাঁকে ঘিরে ধরে। গল্পে এই রেইনকোটের মাধ্যমে নুরুল হুদার মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটে, তা অত্যন্ত অর্থবহ। তিনি বুঝতে পারেন যে যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, বরং এটি তাঁকে এবং তাঁর আত্মপরিচয়কে নতুনভাবে চেনার সুযোগ এনে দিয়েছে।

কলেজে পৌঁছানোর পর পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং মারাত্মক নির্যাতন চালায়। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে কিছুই জানতেন না, শুধুমাত্র সন্দেহের কারণে তাঁকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালানো হয়। এই নির্যাতনের মাঝে নুরুল হুদার মনে বোধোদয় ঘটে এবং তিনি উপলব্ধি করেন কেন মুক্তিযুদ্ধ এতটা জরুরি ছিল, কেন দেশকে পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। তাঁর মনোবল তখনই দৃঢ় হয়, এবং তিনি অনুভব করেন যে দেশপ্রেম কেবল অস্ত্র হাতে যুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাঁর মনকে আলোড়িত করে এবং তাঁর আত্মার ভেতরে এক নতুন শক্তির জন্ম দেয়।

গল্পের শেষ অংশে, নির্যাতন সহ্য করার পর নুরুল হুদার মনে উপলব্ধি হয় যে, এই যন্ত্রণা নিছক ‘উৎপাত’ ছাড়া কিছুই নয়। তাঁর কাছে যুদ্ধের চেতনায় জেগে ওঠা দেশপ্রেমিকদের মতোই তিনি বোধ করেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবময় আত্মত্যাগের চেতনা শুধু রণাঙ্গনেই নয়, বরং প্রতিটি সুনাগরিকের অন্তরেও স্থান পায়। যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিয়েও তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছেন মনে এবং চেতনায়। এই অনুভূতির মধ্যে দিয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী চরিত্র হয়ে ওঠেন, যেখানে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হয়ে ওঠে এক অনন্য আত্মপরিচয়ের অধিকারী।

“রেইনকোট” গল্পটি কেবল মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নয়, বরং ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার প্রতীকী দিককেও তুলে ধরে। গল্পটি আমাদের দেখায় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রতিটি বিবেকবান নাগরিক, যিনি দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন, তাঁর অন্তরেও সেই চেতনা জেগে ওঠে। নুরুল হুদা হয়ে ওঠেন সেই চেতনার প্রতীক, যিনি শারীরিকভাবে যুদ্ধ না করেও মানসিকভাবে এক অভূতপূর্ব মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন।

Related Posts

Leave a Comment