অভাগীর স্বর্গ গল্পের বিষয়বস্তু বা মূলভাব সহজ ভাষায় – নবম-দশম শ্রেণির বাংলা

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটিতে অভাগী চরিত্রটি তার জীবনজুড়ে দুঃখ ও কষ্টের মধ্যেও ছেলের প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং ছেলের মায়ের প্রতি যত্ন, ভালোবাসার মাধ্যমে গল্পের মানবিক দিকটি প্রকাশিত হয়েছে।। এই পোস্টে অভাগীর স্বর্গ গল্পের বিষয়বস্তু বা মূলভাব সহজ ভাষায় – নবম-দশম শ্রেণির বাংলা লিখে দিলাম। বড় মূলভাবটি পড়লে ভালভাবে বুঝতে পারবেন।

অভাগীর স্বর্গ গল্পের চরিত্র

অভাগী (কাঙালীর মা): গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। একটি দুঃখী ও সংগ্রামী নারী, যার নামই তার জীবনের প্রতিচ্ছবি।

কাঙালী: অভাগীর ছেলে, ১৪-১৫ বছরের একটি বালক, মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও যত্নশীল।

ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়: গ্রামের একজন ধনী ও বয়স্ক ব্যবসায়ী, যিনি তার স্ত্রীর মৃত্যুর সময় শোকগ্রস্ত।

ঠাকুরদাসের স্ত্রী: যিনি গল্পের শুরুতে মারা যান এবং শ্মশানে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

রসিক দুলে (অভাগীর স্বামী): অভাগীর স্বামী, যিনি অভাগী ও তাদের সন্তানকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন।

অভাগীর স্বর্গ গল্পের বিষয়বস্তু সহজ ভাষায় লেখা

গল্পের শুরুতে, গ্রামে এক বড় ঘটনা ঘটে। ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়, গ্রামের একজন ধনী ব্যবসায়ী, তার স্ত্রীকে হারান। গ্রামে তার স্ত্রী ছিলেন অনেক সম্মানিত নারী, এবং তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সবাই উপস্থিত হয়। অভাগীও এই মহিলার দুঃখজনক মৃত্যুতে শ্মশানে যায়। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সে এই বিশাল আয়োজন দেখে, যেখানে গ্রামের সমস্ত মানুষ উপস্থিত। মহিলার দেহ সযত্নে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান গভীর ভাবেই পালন করা হচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখে অভাগীর মন গভীরভাবে আন্দোলিত হয়। সে ভাবে, যদি তার মরণও এমন হতো! কেউ কি তার জন্য এত ভালোভাবে শেষকৃত্য করবে? সে তো এমনই অভাগী, যার জীবনে সব কিছু অভাব আর কষ্টে ভরা। মায়ের মতো যত্ন পায়নি, স্বামীর ভালোবাসা পায়নি, ছেলেকে নিজের সংগ্রামে বড় করে তুলেছে—কিন্তু তার নিজের জন্য এমন কোনো আয়োজন হবে কি? শ্মশানের সেই আভিজাত্যপূর্ণ দৃশ্য দেখে, অভাগীর মনে তার নিজের জীবন নিয়ে প্রশ্ন আসে।

অভাগীর জন্মের সময় থেকেই তার জীবনের কপালে দুঃখ যেন লেখা ছিল। বাবা-মা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন “অভাগী,” কারণ দারিদ্র্য আর কষ্টে ভরা জীবন তাকে অন্য কিছু দেওয়ার মতো সুযোগ দেয়নি। ছোটবেলায় মা মারা যায়, আর তার বাবা ছিলেন একজন গরীব মৎস্যজীবী। অভাগীর শৈশব কষ্টে কেটেছে, কিন্তু সে কখনো তার ভাগ্যের সাথে লড়াই ছেড়ে দেয়নি।

কিছুটা বড় হতে না হতেই অভাগীর বিয়ে হয় রসিক দুলে নামে এক মৎস্যজীবীর সঙ্গে। অভাগীর মনে আশা ছিল, বিয়ের পর তার জীবন হয়তো একটু সুখের মুখ দেখবে। কিন্তু বিয়ের পরের কয়েক বছরেই রসিক তাকে এবং তাদের একমাত্র সন্তান কাঙালীকে ফেলে অজানার পথে পাড়ি জমায়। রসিকের চলে যাওয়ার পর, অভাগীর জীবন আবারো শূন্য হয়ে পড়ে। সে ছোট্ট কাঙালীকে কোলে নিয়ে গ্রামে পড়ে রইল, আর মনের সব শক্তি দিয়ে ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা করতে লাগল। জীবনের দুঃখ-কষ্ট তাকে আরও দৃঢ় করে তোলে, তবে মনের ভেতর এক গভীর শূন্যতা তাকে ঘিরে রাখে।

কাঙালী তখন ছিল ১৪-১৫ বছরের একটি ছেলে। মা অভাগীর সব দুঃখ-কষ্টের মাঝে সে ছিল একমাত্র সান্ত্বনা। কাঙালী মায়ের প্রতি খুব যত্নশীল ছিল। মাকে কখনো কোনো অভাব বুঝতে দিত না। তারা দু’জন মিলে একে অপরকে ভালোবাসা আর মমতায় বেঁধে রেখেছিল। এই মা-ছেলের জীবনে খুব বেশি কিছু ছিল না, কিন্তু তারা একে অপরকে পেয়ে যেন সব দুঃখ ভুলে যেত।

শ্মশানের সেই ঘটনার কিছুদিন পর, অভাগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার দুর্বল শরীর আর দীর্ঘদিনের ক্লান্তি তাকে কাবু করে ফেলে। কাঙালী মায়ের প্রতি গভীর যত্ন নিতে শুরু করে। ছোট্ট কাঙালী, যে মাকে কখনো কোনো দুঃখ দিতে চায়নি, এখন নিজের হাতে মায়ের সেবা করতে থাকে। অভাগী প্রায়ই ছেলেকে নিজের জীবনের গল্প শোনায়, কীভাবে সে ছোটবেলা থেকে সংগ্রাম করেছে, এবং কীভাবে সে ছেলেকে মানুষ করেছে।

কাঙালী মায়ের কাছ থেকে শোনে যে, মা তার মৃত্যুর পর চায় সে যেন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিজের হাতে সম্পন্ন করে। অভাগী তার ছেলের হাতেই শেষ বিদায় নিতে চায়, যেন তার আত্মা শান্তি পায়। কাঙালী এই কথায় খুবই কষ্ট পায়, কিন্তু সে মায়ের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানায়।

অভাগীর শারীরিক অবস্থা যখন আরও খারাপ হতে থাকে, তখন কাঙালী মায়ের পুরানো কথাগুলো মনে করে, যেখানে মা তার বাবার কথা বলেছিল। কাঙালী একদিন মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে রসিককে খুঁজতে বের হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে তার বাবাকে খুঁজে পায়। রসিক দুলে, যে অনেক বছর আগে তাদের ফেলে চলে গিয়েছিল, এখন আর তেমন শক্তিশালী নেই। বয়সের ভারে সে নুয়ে পড়েছে, কিন্তু কাঙালীর চোখে তার প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছিল না। সে মায়ের ইচ্ছাপূরণের জন্যই বাবাকে ফিরিয়ে আনে।

কিন্তু রসিকের ফিরে আসার সময় হয়তো আর ছিল না। অভাগীর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো এসে পড়ে। কাঙালী মায়ের পাশে বসে থাকে, তার হাতে হাত রেখে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। অভাগী তার জীবনের সব সংগ্রাম, সব ব্যথা ভুলে গিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তার এই ছেলে।

শেষ পর্যন্ত, অভাগী মৃত্যুবরণ করে। কাঙালী মায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে। সে মায়ের মৃতদেহকে শ্মশানে নিয়ে যায় এবং তার নিজ হাতে মায়ের চিতায় আগুন দেয়। তার মনে হয়, এটাই তার মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রার্থনা ছিল, এবং মায়ের আত্মা এবার শান্তি পাবে।

অভাগীর স্বর্গ গল্পের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে

গল্পের শুরুতে, ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী মারা গেলে গ্রামের সবাই তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য শ্মশানে জড়ো হয়। অভাগীও সেখানে যায়, দূরে দাঁড়িয়ে সমস্ত অনুষ্ঠান দেখে। তার চোখের সামনে ঠাকুরদাসের স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জমকালো আয়োজন দেখে অভাগীর মনে হয়, সে যেন কোনো ভাগ্যবতী নারী, এবং তার মতো মরণ যদি তার নিজের কপালে থাকত! কাঙালীর মা শ্মশানে দাঁড়িয়ে সেই মৃত মহিলাকে দেখে, তার চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। অভাগী নিজে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার ছেলে কাঙালী তার যত্ন নিতে থাকে। মা-ছেলের মধ্যে খুব মধুর সম্পর্ক, এবং কাঙালী মায়ের প্রতি অনেক যত্নশীল। অভাগী ছেলেকে গল্প শোনায়, নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলে, এমনকি তার মৃত্যুর পর কি হবে, সে সম্পর্কেও চিন্তা করে। সে চায় তার ছেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করবে এবং নিজের হাতে তাকে আগুন দেবে, যেন সে সগ্যে (স্বর্গে) যেতে পারে।

অভাগীর জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে ভরা। তাকে ছোটবেলায় মা-বাবা “অভাগী” নামে ডাকতে শুরু করে, এবং সে নামই যেন তার জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। অভাগীর মা মারা যায় তার ছোটবেলায়, আর তার বাবা ছিল একজন গরীব মাছধরা লোক। অভাগী বড় হতে না হতেই বিয়ে হয় রসিক দুলে নামে এক ব্যক্তির সাথে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে অভাগী ও তাদের একমাত্র ছেলে কাঙালীকে ফেলে চলে যায়। কাঙালীকে নিয়ে অভাগী গ্রামে পড়ে থাকে এবং নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছেলেকে মানুষ করতে থাকে।

অবশেষে, কাঙালী মায়ের কথা শুনে তার বাবাকে খুঁজে নিয়ে আসে, কিন্তু ততক্ষণে অভাগীর জীবন প্রায় শেষ। মা আর ছেলের এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়। অভাগীর দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবন, তার আশা, আর কাঙালীর প্রতি তার ভালোবাসা গল্পের প্রধান প্রতিপাদ্য।

Related Posts

Leave a Comment