নয়া পত্তন গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

জহির রায়হানের ‘নয়া পত্তন’ গল্পে শনু পণ্ডিত একজন নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক—যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন যখন ভেঙে পড়ে, তখন তাঁর মতো একজন শিক্ষকের মন দৃঢ়তা ও ঐক্যই হলো এই গল্পের মূলভাব। এই পোস্টে নয়া পত্তন গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

নয়া পত্তন গল্পের মূলভাব

‘নয়া পত্তন’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শনু পণ্ডিত, যিনি গ্রামের ভাঙা স্কুলটি মেরামত করার আশায় শহরে সাহায্য চাইতে যান। কিন্তু সরকার ও জমিদার চৌধুরী তাঁকে সাহায্য না করে অপমান করে। তিনি হতাশ হয়ে ফিরে আসেন এবং ভাঙা স্কুলটি দেখে তাঁর চোখে ভেসে ওঠে পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি, যখন নিজের জমি বিক্রি করে স্কুলটি গড়েছিলেন। স্কুলের নাম দেওয়া হয়েছিল “জুলু চৌধুরীর স্কুল”, অথচ শ্রম ছিল শনু পণ্ডিতের। গ্রামে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন, সবাই লেখাপড়ার গুরুত্ব বোঝে না। কেউ কেউ বলে, লেখাপড়া না শিখেও তো চলে। তবে হাশমত, তোরাব আলী, তকু শেখরা এগিয়ে আসে স্কুল গড়ার কাজে। তারা বলে, আমরা ভিক্ষা চাইব না, নিজেরাই স্কুল গড়ব। গ্রামের মানুষ খুশি মনে বাঁশ, ছন, কাঠ দিয়ে সাহায্য করে। সবাই একসঙ্গে কাজ করে হাসতে হাসতে স্কুল গড়ে তোলে। কেউ কেউ মজা করে বলে, “এটা চৌধুরীর লাশ টানছি,” অর্থাৎ শোষকের প্রভাব মুছে দিচ্ছে। স্কুল তৈরি হলে তোরাব আলী গিয়ে পুরনো নামফলক খুলে ফেলে। কাঠকয়লা দিয়ে নতুন করে লেখে “শনু পণ্ডিতের ইস্কুল”। প্রথমে শনু পণ্ডিত লজ্জা পেলেও গ্রামবাসীরা বলে, এটা তাঁর প্রাপ্য।

নয়া পত্তন গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন

১। ক. “আশার মুখে ছাই!” উক্তিটিতে শনু পন্ডিতের কোন মনোভাব পেয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
খ. গ্রামে প্রথমবার স্কুল তৈরির ঘটনাটি বর্ণনা কর।

ক. উত্তরঃ “আশার মুখে ছাই!” এই উক্তিতে শনু পণ্ডিতের হতাশা ও দুঃখ ফুটে উঠে। তিনি আশাবাদী ছিলেন যে স্কুলটি ঠিক হবে, কিন্তু যখন তা হয়নি, তখন তার আশা ভেঙে যায়। সরকার ও জমিদারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে তিনি খুব কষ্ট পান। তার মনে হত যে শিক্ষার জন্য সবাইকে সাহায্য করবে, কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। এই কারণে তার মনে একটি বড় ধাক্কা লাগে। সেই আশা যেন ছাইয়ের মতো হয়ে গেছে, যা এখন আর আগুন জ্বালাতে পারে না। এই উক্তি তার জীবনের কঠিন বাস্তবতা এবং শিক্ষার প্রতি তার গভীর ইচ্ছার প্রতিফলন। শনু পণ্ডিতের মনোভাব থেকে বোঝা যায়, তিনি হতাশ হলেও হাল ছাড়েননি। তাই উক্তিটিতে তার আশা ও দুঃখ দুইটাই মিশে আছে।

খ. উত্তরঃ গ্রামে প্রথমবার স্কুল তৈরি করার ঘটনা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। শনু পণ্ডিত তরুণ বয়সে জমি বিক্রি করে সেই অনাবাদি জমিতে স্কুল তৈরির জন্য টাকা সংগ্রহ করেন। তখন গ্রামের অনেকেই লেখাপড়া জানত না, তাই স্কুল খুলে গ্রামের মানুষকে শিক্ষার আলো দিতে চান তিনি। জমিদার জুলু চৌধুরীর নাম নিয়ে স্কুলের নাম রাখা হয় “জুলু চৌধুরীর স্কুল,” যাতে তার অনুকূলে গ্রামের মানুষ সমর্থন দিতে পারে। আসলে স্কুল গড়ার মূল শ্রম ও ত্যাগ ছিল শনু পণ্ডিতের। স্কুল তৈরির সময় গ্রামের অনেক মানুষ সাহায্য করেন। কেউ বাঁশ দেয়, কেউ শ্রম দেয়, কেউ আর্থিক সাহায্য করে। স্কুল খুলে গ্রামের শিশুরা লেখাপড়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করে। তখন অনেকেই লেখাপড়ার মাধ্যমে নিজের জীবনের উন্নতি করার স্বপ্ন দেখেন। স্কুল গড়ার এই উদ্যোগ ছিল গ্রামের উন্নতির জন্য বড় একটি পদক্ষেপ। স্কুল তৈরির সময় বিভিন্ন বাধা আসলেও শনু পণ্ডিত ও গ্রামের মানুষ একসঙ্গে কাজ করে তা পার হয়।

২। ক. নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠায় গ্রামবাসীরা কীভাবে সহযোগিতা করে? ব্যাখ্যা কর।
খ. “সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।” ‘নয়া পত্তন’ গল্পের আলোকে আলোচনা কর।

ক. উত্তরঃ নতুন স্কুল তৈরি করতে গ্রামবাসীরা সবাই মিলে কাজ করে। কেউ টাকা দান করে, কেউ বাঁশ আর ছন দেয়। কেউ হাতে কাজ করতে সাহায্য করে। তারা কারও কাছে ভিক্ষা না চাইতেই নিজেদের স্কুল গড়ে তুলতে চায়। সবাই মিলে হাসতে হাসতে বলে, “এটা চৌধুরীর লাশ টানছি!” অর্থাৎ শোষকের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের ভাষা। বুড়ো হাশমত, তোরাব আলী, তকু শেখ সবাই একসাথে কাজ করে। তারা বিশ্বাস করে নিজেদের একতা ও পরিশ্রমে গ্রামে শিক্ষা ফিরিয়ে আনতে পারবে। শনু পণ্ডিতও বয়সের ভারে ক্লান্ত হলেও কাজে হাত লাগান। এই সহযোগিতা গ্রামের মানুষদের নতুন আশার আলো দেয়। এই ঐক্য তাদের শক্তি দেয় বাধা পার হতে। স্কুল তৈরি হয় সবাই মিলেমিশে কাজ করার কারণে।

খ. উত্তরঃ গল্প ‘নয়া পত্তন’-এ দেখানো হয়েছে যে, যখন স্কুল ভেঙে পড়ে, তখন শনু পণ্ডিত শহর থেকে সাহায্য চেয়েও প্রত্যাখ্যান পেয়ে হতাশ হন। গ্রামের মানুষ অনেকেই লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝত না, তারা বলত, ‘আমাদের বাপ-দাদাও তো অশিক্ষিত ছিল।’ কিন্তু কিছু মানুষ, যেমন বুড়ো হাশমত, তোরাব আলী, তকু শেখ, তারা বিশ্বাস করত গ্রামের জন্য স্কুল খুব জরুরি। তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, কারো কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়াই নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্কুল গড়ে তুলবে। গ্রামের সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করে। কেউ টাকা দেয়, কেউ বাঁশ দেয়, কেউ ছন দেয়, আবার কেউ শ্রম দেয়। তারা সবাই একসাথে কাজ করে, হাসতে হাসতে বলে, “এটা চৌধুরীর লাশ টানছি!” অর্থাৎ শোষকদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের ভাষা। এমন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় স্কুল দ্রুত তৈরি হয়। পরে তারা চৌধুরীর নামফলক নামিয়ে শনু পণ্ডিতের নাম দেয়। এভাবে গল্পটি আমাদের শেখায়, যদি সবাই একসাথে কাজ করে, তাহলে বড় বড় বাধাও পাড়িয়ে ফেলা সম্ভব। তাই গল্পটি বলে, একতার শক্তি দিয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।

৩। ক. শিক্ষা বিভাগের বড় অফিসারের কর্মকান্ড তুলে ধর।
খ. শনু পন্ডিত চরিত্রটিকে মূল্যায়ন কর।

ক. উত্তরঃ শিক্ষা বিভাগের বড় অফিসার শমসের খান ছিলেন একজন কর্তৃপক্ষের মানুষ, যিনি সাধারণ মানুষের প্রতি খুব অবজ্ঞাসূচক আচরণ করতেন। শনু পণ্ডিত যখন স্কুল পুনর্নির্মাণের জন্য সাহায্য চায়, তখন শমসের খান তাকে অপমান করে বলেন, “হোটেল আর ইংলিশ স্কুল বানাতেই আমাদের টাকা ফুরিয়েছে।” তার কথায় বোঝা যায়, তিনি সাধারণ গ্রামের মানুষের শিক্ষা নিয়ে কোনো আন্তরিকতা দেখাননি। তিনি কেবল নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন এবং জনগণের সমস্যাকে গুরুত্ব দেননি। এমন আচরণে তিনি গ্রামের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে হতাশ করেছেন। তার এসব কথায় শনু পণ্ডিত খুব আহত হয়।

খ. উত্তরঃ শনু পণ্ডিত একজন সত্যিকারের শিক্ষা প্রেমিক ও সাহসী মানুষ। তিনি নিজের জমি বিক্রি করে গ্রামের মানুষদের জন্য স্কুল বানিয়েছিলেন, যেখানে আগে কেউ লেখাপড়া জানত না। তিনি শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন। বয়স হয়েছে অনেক, শরীরও দুর্বল, কিন্তু গ্রামের জন্য তিনি কখনো থামেননি। যখন স্কুলটি ভেঙে পড়ে, তখনও তিনি সাহায্য চাইতে শহরে যান, কিন্তু সম্মান না পেয়ে মন খারাপ হয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিলে তারা নিজেদের এই নতুন করে স্কুল গড়ে তোলেন। শনু পণ্ডিতের এই ধৈর্য, সাহস ও পরিশ্রম গ্রামের মানুষের জন্য এক দৃষ্টান্ত। তিনি শোষক ও জমিদারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, এবং সাধারণ মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। তার মনোভাব ও কর্মে গ্রামের মানুষ নতুন করে আশা পায়। তিনি সত্যিই একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ, যিনি নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে সবাইকে শিক্ষিত করতে চান।

আরও পড়ুনঃ কাকতাড়ুয়া গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

Related Posts

Leave a Comment