একুশের গল্প মূলভাব, বিষয়বস্তু ও বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর

জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ হৃদয়বিদারক একটি গল্প। এই গল্পটা শুধু একজন বন্ধুর মৃত্যু আর ফেরার গল্প না। এটা এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতীক। ভাষা আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছে, তারা শরীর নিয়ে না ফিরলেও, ইতিহাস হয়ে ফিরে আসে। এই পোস্টে একুশের গল্প মূলভাব, বিষয়বস্তু ও বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

একুশের গল্প মূলভাব

জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া এক তরুণ তপুকে ঘিরে লেখা। তপু ছিল খুবই হাসিখুশি, স্বপ্নবাজ এক ছেলে, যার সাথে লেখক ও রাহাত হোস্টেলে থাকতেন। তপু রেণু নামের এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল এবং তারা খুব ভালোবাসতো একে অপরকে। তিন বন্ধু একসাথে পড়াশোনা, আড্ডা আর ঘোরাঘুরি করে ভালো সময় কাটাত। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে ভাষার দাবিতে মিছিলে যোগ দিয়ে হাইকোর্ট মোড়ে গুলিতে মারা যায় তপু। তার কপালের ঠিক মাঝখানে গুলি লেগে সে শহীদ হয়। চার বছর পর একদিন হঠাৎ তপু যেন ফিরে আসে, কিন্তু সবাই ভয় পায়, কারণ সে আগের মতো নেই। পরে দেখা যায়, হোস্টেলের এক ছাত্রের কাছে থাকা মানুষের কঙ্কাল আসলে তপুরই। সেই খুলি ও হাড় দেখে বোঝা যায় যে এটি সেই তপুর, যার মাথায় গুলি লেগেছিল এবং বাঁ পা ছোট ছিল। বন্ধুরা বুঝতে পারে, তপু আর নেই, কিন্তু তার স্মৃতি ফিরে এসেছে। এই গল্প শুধু একটি মৃত্যুর গল্প না, বরং ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এক প্রতীক। তপুর আত্মা যেন জীবিত থেকেও সবার মাঝে ঘুরে বেড়ায়। এইভাবে গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা কখনো হারিয়ে যান না। তারা ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকেন।

একুশের গল্পের মূল বিষয়বস্তু

প্রধান চরিত্র:

  • তপু: গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ভাষা আন্দোলনের শহিদ। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, আদর্শবাদী তরুণ। বেঁচে থাকতে যেমন প্রেরণা ছিল, মৃত্যুর পরেও সে এক জীবন্ত স্মৃতি।
  • রাহাত: তপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অনুভূতিপ্রবণ, স্মৃতিবিলাসী, তপুর মৃত্যুর পরে প্রচণ্ড মানসিক দুঃখ বহন করে।
  • রেণু: তপুর স্ত্রী, যার সঙ্গে তপুর গভীর প্রেম ছিল, কিন্তু তপুর মৃত্যুর পর বাস্তব জীবনকে মেনে নিয়ে আবার বিবাহ করে।
  • ‘আমি’/উপস্থাপক: একেবারে কাছের বন্ধু, যার চোখ দিয়ে আমরা পুরো কাহিনি দেখি।

গল্পের কাহিনীঃ

চার বছর আগে হাইকোর্ট মোড়ে এক ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিলো তপু। সেই দিন থেকে কেউ কখনও কল্পনাও করেনি, সে আবার জীবিত ফিরবে। কিন্তু একদিন হঠাৎ সে যেন ফিরে আসে। ওকে দেখে সবাই চমকে যায়। আগের মতো হাসিখুশি নয়, একেবারে চুপচাপ, অচেনা আর থমথমে।

ওর চেহারা, চোখের দৃষ্টি—সব কিছুতেই একটা ভয় ধরানো ভাব। রাতে ঘুমাতে গেলেও মনে হয়, কেউ যেন তাকিয়ে আছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকালেই গা শিউরে ওঠে।

চার বছর আগে আমরা ছিলাম তিনজন—আমি, রাহাত, আর তপু। হোস্টেলে একসঙ্গে থাকতাম। পড়াশোনা করতাম, আড্ডা দিতাম, ঘুরতে যেতাম।
তপু ছিলো আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু ও-ই একমাত্র বিবাহিত। রেণু নামে একটা মিষ্টি, শান্ত স্বভাবের মেয়েকে বিয়ে করেছিল ও। ওর নিজের আত্মীয়ই ছিলো রেণু।

তপু খুব হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ছেলে ছিল। ওর গল্পের কোনো শেষ ছিল না। ওর মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকত। ও-ই আমাদের ঘুম থেকে জাগাত, নিজে চা বানাত, একসঙ্গে রাস্তায় ঘুরতে বের হতাম। রেণু মাঝেমধ্যে বাসা থেকে আমাদের জন্য ডালমুট ভেজে আনত, আর আমরা হাঁটতে হাঁটতে খেতাম।

তপুর একটা স্বপ্ন ছিল—ডাক্তার হয়ে গ্রামে একটা ডিসপেনসারি খুলবে, সাধারণ মানুষের সেবা করবে।

১৯৫২ সালের সেই বিশেষ দিনটি। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিন। সেদিন সকালে হোস্টেলের বাইরে একটা বিশাল মিছিল হচ্ছিলো। লোকজন হাতে প্ল্যাকার্ড, রক্তাক্ত জামা—সবার চোখে প্রতিশোধের আগুন।

তপু বললো, “চলো, মিছিলে যাই।” আমি আর রাহাত রাজি হয়ে গেলাম।

কিন্তু রেণু দৌড়ে এসে তপুকে আটকে দিলো। বারবার বললো, “চলো না, বাড়ি চলো।” কিন্তু তপু বললো, “আমি যেতে পারবো না। তুমি চলো না হলে।”
অবশেষে রেণু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

তপুর হাতে ছিলো একটা প্ল্যাকার্ড—“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” লেখা।

হাইকোর্ট মোড়ে পৌঁছানো মাত্র, হঠাৎ গুলি চললো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তপু মাটিতে পড়ে গেল। কপালের মাঝখানে গুলির গর্ত, আর সেখান থেকে রক্ত ঝরছে।

রাহাত আর আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর মিলিটারি এসে তপুর দেহ তুলে নিয়ে গেলো। আমরা কিছুই করতে পারিনি।

রেণু আর তপুর মা কেঁদেছিলেন ভীষণভাবে। তারপর সময় কেটে গেছে।
রেণু একসময় অন্য জায়গায় বিয়ে করেছে। তপুর মা আর বেঁচে নেই।
তপুর পুরোনো জিনিসপত্র, বই, বিছানা, স্যুটকেস সব নিয়ে গিয়েছিল রেণু—তবু তপুর স্মৃতি রয়ে গেছে আমাদের মাঝে।

আমরা মাঝেমধ্যে রাতে অনুভব করতাম, যেন কেউ আমাদের ঘাড়ে হাত রেখে বলছে—“উঠো, ঘুমিয়ো না”। মনে হতো তপু ফিরে এসেছে ছায়া হয়ে।

চার বছর পর হোস্টেলে নতুন এক ছেলে এলো। সে মেডিকেলের ছাত্র ছিল। একদিন সে মাথার খুলি (স্কাল) নিয়ে এনাটমি পড়ছিল। হঠাৎ বললো,
“এই স্কালের কপালের মাঝখানে গর্ত কেন?”

রাহাত ওটা নিয়ে দেখতে যায়। তারপর দেখে—ঠিক গুলির জায়গায় গর্ত।
তারপর সে তপুর বাঁ পায়ের হাড় খোঁজে—দেখে সেটা আসলেই ছোট, যেমন তপুর ছিল।

সব কিছু মিলিয়ে রাহাত অবাক হয়ে বলে—
“তপু”।

তপুর কঙ্কাল হোস্টেলের কোনো ছাত্র হয়তো সংগ্রহ করেছিলো মেডিকেলের জন্য। আজ এতদিন পর সেটাই আবার আমাদের সামনে চলে এসেছে—হাড়ের খুলি, গুলির চিহ্ন, সেই চেনা শরীরের গড়ন।

একুশের গল্পের বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর (MCQ)

১। ‘একুশের গল্প’ এর লেখক কে?
ক) হুমায়ূন আহমেদ
খ) জহির রায়হান
গ) সেলিনা হোসেন
ঘ) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
উত্তর: খ) জহির রায়হান


২। ‘একুশের গল্প’ ভাষা আন্দোলনের কোন ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা?
ক) ১৬ই ডিসেম্বর
খ) ২১শে ফেব্রুয়ারি
গ) ৭ই মার্চ
ঘ) ২৬শে মার্চ
উত্তর: খ) ২১শে ফেব্রুয়ারি


৩। তপু কার সঙ্গে বিবাহিত ছিল?
ক) রেশমা
খ) রাহেলা
গ) রেণু
ঘ) রুনু
উত্তর: গ) রেণু


৪। তপু কোথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়?
ক) আজিমপুরে
খ) হাইকোর্ট মোড়ে
গ) মেডিকেল কলেজের সামনে
ঘ) বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে
উত্তর: খ) হাইকোর্ট মোড়ে


৫। তপু ছিল কার কার বন্ধু?
ক) রাহাত ও নাজিম
খ) লেখক ও সানু
গ) লেখক ও রাহাত
ঘ) রেণু ও সানু
উত্তর: গ) লেখক ও রাহাত


৬। তপুর কী শারীরিক সমস্যা ছিল?
ক) ডান পা ছোট ছিল
খ) বাঁ চোখে দেখতে পেত না
গ) বাঁ পা ডান পায়ের চেয়ে ছোট ছিল
ঘ) হাঁটার সময় ব্যথা হতো
উত্তর: গ) বাঁ পা ডান পায়ের চেয়ে ছোট ছিল


৭। তপুর স্বপ্ন ছিল—
ক) বড় শিল্পপতি হওয়া
খ) বিদেশে চলে যাওয়া
গ) গ্রামে ডিসপেনসারি খোলা
ঘ) বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা
উত্তর: গ) গ্রামে ডিসপেনসারি খোলা


৮। তপু কী বিষয়ে পড়তো?
ক) রাষ্ট্রবিজ্ঞান
খ) ডাক্তারি
গ) আইন
ঘ) প্রকৌশল
উত্তর: খ) ডাক্তারি


৯। তপুর মা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর?
ক) নিরব ছিলেন
খ) রাগ করছিলেন
গ) গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলেন
ঘ) কিছু বলেননি
উত্তর: গ) গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলেন


১০। তপুর স্ত্রী রেণু পরে কী করেছিল?
ক) তপুর স্মৃতিচারণ করে
খ) বাড়ি ফিরে যায়
গ) অন্যত্র বিয়ে করে
ঘ) আত্মহত্যা করে
উত্তর: গ) অন্যত্র বিয়ে করে


১১। তপুর প্ল্যাকার্ডে কী লেখা ছিল?
ক) রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই
খ) বাংলা আমাদের অধিকার
গ) বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা
ঘ) জয় বাংলা
উত্তর: ক) রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই


১২। রেণু তপুকে কোথায় যেতে নিষেধ করেছিল?
ক) রাস্তায়
খ) মিছিলে
গ) হোস্টেলে
ঘ) কার্জন হলে
উত্তর: খ) মিছিলে


১৩। তপু মিছিলে যাওয়ার সময় রেণুর হাত—
ক) ধরে রাখে
খ) ছেড়ে দেয়
গ) কেটে দেয়
ঘ) কাঁদিয়ে তোলে
উত্তর: খ) ছেড়ে দেয়


১৪। তপুর মৃত্যুর দৃশ্য কোথায় দেখা যায়?
ক) গল্পের শুরুতে
খ) গল্পের মাঝখানে
গ) গল্পের শেষে
ঘ) গল্পজুড়ে
উত্তর: গ) গল্পের শেষে


১৫। রাহাত শেষদিকে কী আবিষ্কার করে?
ক) তপুর পুরনো ছবি
খ) তপুর লেখা ডায়েরি
গ) তপুর খুলি ও হাড়
ঘ) তপুর চিঠি
উত্তর: গ) তপুর খুলি ও হাড়


১৬। তপুর মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল—
ক) ডান কানে
খ) কপালের মাঝখানে
গ) মাথার পেছনে
ঘ) বাম চোখে
উত্তর: খ) কপালের মাঝখানে


১৭। তপুর বাঁ পায়ের হাড় ছিল—
ক) ১ ইঞ্চি ছোট
খ) ১.৫ ইঞ্চি ছোট
গ) ২ ইঞ্চি ছোট
ঘ) ৩ ইঞ্চি ছোট
উত্তর: গ) ২ ইঞ্চি ছোট


১৮। নতুন ছেলেটি কী বিষয়ে পড়ছিল?
ক) এনাটমি
খ) সমাজবিজ্ঞান
গ) রসায়ন
ঘ) পদার্থবিজ্ঞান
উত্তর: ক) এনাটমি


১৯। নতুন রুমমেটের ঝুড়িতে কী ছিল?
ক) পুরাতন বই
খ) হাড়গোড়ের সেট
গ) খাবার
ঘ) কাপড়
উত্তর: খ) হাড়গোড়ের সেট


২০। একুশের গল্পে তপু কেমন ছেলে ছিল?
ক) চুপচাপ
খ) মেজাজি
গ) হাসিখুশি ও গল্পপ্রিয়
ঘ) ভীতু
উত্তর: গ) হাসিখুশি ও গল্পপ্রিয়


২১। গল্পে লেখকের ভয় লাগার কারণ কী?
ক) তপুর বদলে যাওয়া চেহারা
খ) নতুন ছেলেটি তপু
গ) তপু স্বপ্নে আসে
ঘ) খুলি ও হাড়ের আবিষ্কার
উত্তর: ঘ) খুলি ও হাড়ের আবিষ্কার


২২। তপু গুলি খাওয়ার পর কী হয়?
ক) হাসপাতালে নেয়া হয়
খ) মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
গ) পালিয়ে যায়
ঘ) পুলিশ ধরে
উত্তর: খ) মাটিতে লুটিয়ে পড়ে


২৩। একুশের গল্পটি কোন ঘটনার মাধ্যমে শেষ হয়?
ক) রেণুর আত্মহত্যা
খ) তপুর মায়ের কান্না
গ) খুলি দেখে তপুর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া
ঘ) রাহাতের কান্না
উত্তর: গ) খুলি দেখে তপুর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া


২৪। একুশের গল্পটি কোন জাতীয় চেতনার প্রতীক?
ক) স্বাধীনতা যুদ্ধ
খ) ভাষা আন্দোলন
গ) শিক্ষা আন্দোলন
ঘ) অর্থনৈতিক আন্দোলন
উত্তর: খ) ভাষা আন্দোলন


২৫। একুশের গল্পটি পড়ে পাঠকের মনে কী অনুভব হয়?
ক) হাস্যরস
খ) দুঃখ ও গর্ব
গ) ভয় ও রাগ
ঘ) অবহেলা
উত্তর: খ) দুঃখ ও গর্ব


Related Posts

Leave a Comment