বোশেখ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর

আল মাহমুদের “বোশেখ” প্রশ্নবোধক কবিতা যা বাংলা নববর্ষের সময় বসন্তের তীব্র বাতাসকে (কালবোশেখের ঝড়) সামাজিক অবিচার এবং প্রকৃতির নির্মমতার জন্য রূপক হিসেবে ব্যবহার করে, একই সাথে ন্যায়বিচারের ধ্বংস এবং পুনর্জন্মের আহ্বান জানায়। এই পোস্টে বোশেখ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

বোশেখ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন

১। ‘বোশেখ’ কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত?
উত্তর: পাখির কাছে ফুলের কাছে।

২। আল মাহমুদের জন্ম কোথায়?
উত্তর: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে।

৩। আল মাহমুদের জন্ম সাল কত?
উত্তর: ১৯৩৬ সাল।

৪। আল মাহমুদের প্রকৃত নাম কী?
উত্তর: মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।

৫। আল মাহমুদ কোন পেশার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন?
উত্তর: সাংবাদিকতা।

৬। আল মাহমুদ কোন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন?
উত্তর: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

৭। শিল্পকলা একাডেমিতে কোন পদে আল মাহমুদ অবসর গ্রহণ করেন?
উত্তর: পরিচালক পদে।

৮। স্বাধীনতার পর আল মাহমুদ কোন পত্রিকার সম্পাদক হন?
উত্তর: দৈনিক গণকণ্ঠ।

৯। আল মাহমুদের শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থের নাম কী?
উত্তর: পাখির কাছে ফুলের কাছে।

১০। আল মাহমুদের মৃত্যু কবে হয়?
উত্তর: ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি।

১১। ‘বোশেখ’ কবিতার প্রথম লাইন কী?
উত্তর: “যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়”

১২। বুনোহাঁসের ঝাঁক কীসে ভেঙে যায়?
উত্তর: বাতাসে

১৩। জেটের পাখা কী অবস্থায় পড়ে?
উত্তর: দুমড়ে যায়

১৪। নদীর পানি কোথায় উঠে যায়?
উত্তর: শূন্যে

১৫। টেলিগ্রাফের থাম কীভাবে পড়ে?
উত্তর: নুইয়ে পড়ে

১৬। কবি বাতাসকে কী বলে সম্বোধন করেছেন?
উত্তর: “মহাপ্রতাপশালী”

১৭। কবি বাতাসকে কী অনুরোধ করেছেন?
উত্তর: থামার অনুরোধ (“তিষ্ঠ হাওয়া”)

১৮। গরিব মাঝির কী ছিঁড়ে যায়?
উত্তর: পালের দড়ি

১৯। চাষির কী গুঁড়িয়ে যায়?
উত্তর: ভিটে

২০। টুনটুনি পাখির কী ছিঁড়ে যায়?
উত্তর: বেগুন পাতার বাসা

২১। দুঃখী মায়ের কী উল্টে যায়?
উত্তর: ভাতের হাঁড়ি

২২। কবি বাতাসকে কী জিজ্ঞাসা করেছেন?
উত্তর: “তোমার কী আনন্দ?”

২৩। বাবুই পাখির কী উড়ে যায়?
উত্তর: ঘর

২৪। রামায়ণে কার কথা আছে?
উত্তর: হনুমানের

২৫। হনুমানের পিতা কে?
উত্তর: বাতাস (পবনদেব)

২৬। মেঘদূত কে রচনা করেছেন?
উত্তর: কালিদাস

২৭। মেঘের সাথী কে?
উত্তর: বাতাস

২৮। কবি বাতাসকে কী বলেছেন?
উত্তর: “তুমিই নাকি সেই দয়ালু মেঘের সাথী?”

২৯। গরিব চাষির কী উড়ে যায়?
উত্তর: ঘরের খুঁটি

৩০। রাজা সোলেমানের বাহন কে?
উত্তর: বাতাস

৩০। সোলেমানের তলোয়ার কী করত?
উত্তর: অত্যাচারীর মাথা কাটত

৩১। রবীন্দ্রনাথকে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: “কবিদের এক মহান রাজা”

৩২। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে দাঁড়িয়েছিলেন?
উত্তর: করজোড়ে

৩৩। কবি কী ধ্বংস করতে বলেছেন?
উত্তর: বিভেদকারী পরগাছাদের

৩৪। পরগাছারা কী করে?
উত্তর: পরের শ্রমে দালান গড়ে

৩৫। কবিতায় কোন পাখির নাম এসেছে?
উত্তর: বুনোহাঁস, টুনটুনি, বাবুই

৩৬। “ভাতের হাঁড়ি” কীসের প্রতীক?
উত্তর: দরিদ্র মানুষের জীবন সংগ্রামের

৩৭। “প্রাসাদ” কীসের প্রতীক?
উত্তর: শোষকের সম্পদের

৩৮। ‘বোশেখ’ কবিতায় কোন ঋতুর কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: বৈশাখ (গ্রীষ্মকাল)

৩৯। কোন বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়?
উত্তর: বোশেখের ঝড়ে।

৪০। ঝড়ের প্রভাবে জেটের পাখার কী হয়?
উত্তর: দুমড়ে শেষে আছাড় খায়।

৪১। বোশেখের বাতাস নদীর পানির কী করে?
উত্তর: শূন্যে তুলে ছড়িয়ে দেয়।

৪২। বোশেখের বাতাস টেলিগ্রাফের খুঁটির কী করে?
উত্তর: নুইয়ে দেয়।

৪৩। কবি বাতাসের কাছে কী মিনতি করেন?
উত্তর: তিনি বাতাসকে স্থির থাকতে অনুরোধ করেন।

৪৪। বোশেখের বাতাস মাঝির কী ক্ষতি করে?
উত্তর: মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে দেয়।

৪৫। চাষির কী ক্ষতি হয় বোশেখের ঝড়ে?
উত্তর: তার ভিটে গুঁড়িয়ে যায়।

৪৬। টুনটুনি পাখির কী ক্ষতি হয় ঝড়ে?
উত্তর: তাদের বাসা ছিঁড়ে যায়।

৪৭। বোশেখের ঝড়ে দুঃখী মায়ের কী ক্ষতি হয়?
উত্তর: তার ভাতের হাঁড়ি উল্টে পড়ে যায়।

৪৮। কবি বোশেখের বাতাসকে কোন দেবতার পিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন?
উত্তর: হনুমানের পিতা।

৪৯। মহাবীর হনুমান কার চরিত্র?
উত্তর: রামায়ণের।

৫০। রামায়ণ কী ধরনের সাহিত্যকর্ম?
উত্তর: মহাকাব্য।

৫১। রামায়ণ কে রচনা করেন?
উত্তর: বাল্মীকি।

৫২। পৃথিবীর চারটি জাত মহাকাব্যের একটি কী?
উত্তর: রামায়ণ।

৫৩। কালিদাসের কোন গ্রন্থে এই বাতাসের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: ‘মেঘদূত’ কাব্যে।

৫৪। কালিদাস কে ছিলেন?
উত্তর: সংস্কৃত ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি।

৫৫। ‘মেঘদূত’ কী ধরনের রচনা?
উত্তর: একটি কাব্য।

৫৬। ‘মেঘদূত’ কোন ভাষায় রচিত?
উত্তর: সংস্কৃত ভাষায়।

৫৭। বাংলায় ‘মেঘদূতম্’ কী নামে পরিচিত?
উত্তর: মেঘদূত।

৫৮। কবি বোশেখের বাতাসকে কী বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর: নিঠুর (নিষ্ঠুর) বাতাস।

৫৯। গরিব চাষির কী ক্ষতি হয় ঝড়ে?
উত্তর: তার ঘরের খুঁটি উড়ে যায়।

৬০। কবি বোশেখের বাতাসের সুবিচার নিয়ে কী বলেন?
উত্তর: এটি গরিবের ক্ষতি করলেও ধনী ঠকবাজদের ক্ষতি করে না।

৬১। সোলেমানের তলোয়ার কী করত?
উত্তর: অত্যাচারীর মাথা কাটত এবং অহংকারীদের গুঁড়িয়ে দিত।

৬২। কবি বোশেখের বাতাসের কোন গুণ চান?
উত্তর: অন্যায় ও বৈষম্যের ধ্বংস সাধন।

৬৩। রবীন্দ্রনাথ কী জন্য বোশেখের বাতাসের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন?
উত্তর: পুরানো ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস ধ্বংসের জন্য।

৬৪। কবি ঝড়কে কী করতে বলেন?
উত্তর: বিভেদ সৃষ্টিকারীদের ধ্বংস করতে।

৬৫। ঝড়ের আঘাতে কোন শ্রেণির মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
উত্তর: গরিব ও শ্রমজীবী মানুষ।

৬৬। কবি বাতাসকে কোন ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে তুলনা করেছেন?
উত্তর: রাজা সোলেমানের বাহনের সাথে।

৬৭। বুনোহাঁস কী?
উত্তর: যে হাঁস গৃহপালিত নয়, বনে থাকে।

৬৮। জেট কী ধরনের যান?
উত্তর: দ্রুতগতিসম্পন্ন উড়োজাহাজ।

৬৯। টেলিগ্রাফ কী?
উত্তর: সংকেতের সাহায্যে দূরে বক্তব্য প্রেরণের জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র।

৭০। টেলিগ্রাফ যন্ত্রটি কোন সালে উদ্ভাবিত হয়?
উত্তর: ১৮৩৭ সালে।

৭১। টেলিগ্রাফ কোন শক্তির সাহায্যে পরিচালিত হত?
উত্তর: বিদ্যুতের সাহায্যে।

৭২। বর্তমানে টেলিগ্রাফ কি ব্যবহৃত হয়?
উত্তর: না, এখন আর এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার হয় না।

৭৩। ‘তিষ্ঠ’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: স্থির হও।

৭৪। রাজা সোলেমান কে ছিলেন?
উত্তর: ডেভিডের পুত্র এবং ইসরাইলের তৃতীয় রাজা।

৭৫। রাজা সোলেমান কেমন শাসক ছিলেন?
উত্তর: তিনি বীর ও দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন।

৭৬। ‘অদরকারি’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: যার প্রয়োজন নেই।

বোশেখ কবিতার অনুধাবনমূলক প্রশ্ন

১। কবি কেন বোশেখের বাতাসকে মহাপ্রতাপশালী বলেছেন?

উত্তর: বোশেখের বাতাসকে কবি মহাপ্রতাপশালী বলেছেন, কারণ এটি প্রচণ্ড শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক। এর তীব্রতায় আকাশে উড়তে থাকা বুনোহাঁসের ঝাঁক ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এমনকি আধুনিক জেট বিমানও এই বাতাসের সামনে টিকতে পারে না এবং অনেক সময় আছড়ে পড়ে। নদীর পানিকে এটি শূন্যে তুলে ছড়িয়ে দেয়, যা তার ভয়ংকর ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। বাতাসের প্রবল দাপটে টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলো পর্যন্ত নুইয়ে পড়ে, যা মানুষের গড়ে তোলা অবকাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।এই ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ দেখেই কবি বোশেখের বাতাসকে মহাপ্রতাপশালী বলে উল্লেখ করেছেন।


২। কবি বোশেখের বাতাসকে অত্যাচারী মনে করেন কেন ?

উত্তর: কবি বোশেখের বাতাসকে অত্যাচারী মনে করেন, কারণ এটি গরিব ও অসহায় মানুষের ক্ষতি করে, অথচ সমাজের ধনী ও ক্ষমতাশালীরা এর আঘাত থেকে বেঁচে যায়। দরিদ্র কৃষকের ঘরবাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ছোট্ট টুনটুনি পাখির বাসা পর্যন্ত এই ঝড়ে উড়ে যায়, যা প্রকৃতির সবচেয়ে নিরীহ প্রাণীদেরও রেহাই দেয় না। রান্না করা ভাতের হাঁড়ি উল্টে যায়। অথচ সমাজের ধনী ব্যক্তিরা, যারা অন্যদের শ্রম শোষণ করে প্রাসাদ তৈরি করেছে, তারা কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। প্রকৃতির এই বৈষম্যমূলক আচরণ কবিকে ব্যথিত করে। এসব কারণেই কবি বোশেখের বাতাসকে অত্যাচারী বলে মনে করেন।


৩। বোশেখের ঝড় কিভাবে প্রকৃতির উপর প্রভাব ফেলে?

উত্তর: বোশেখের ঝড় প্রকৃতির উপর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। প্রচণ্ড বাতাসের কারণে নদীর পানি প্রবল বেগে উঠে আসে এবং চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি গাছপালার শাখা-প্রশাখা ভেঙে দেয়, যার ফলে অনেক গাছ উপড়ে যায়। পাখির বাসাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে তারা আশ্রয় হারায়। ঝড়ের তাণ্ডবে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যায়, যা কৃষকদের জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়। নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠে এবং আশেপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে পড়ে। ছোট প্রাণীরা তাদের বাসস্থান হারিয়ে বিপদের মুখে পড়ে। অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রাণহানিও ঘটে, যা মানুষের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তোলে।


৪। কবি বৈশাখী ঝড়ের প্রতি অসন্তুষ্ট কেন?

উত্তর: কবি বৈশাখী ঝড়ের প্রতি অসন্তুষ্ট, কারণ এটি সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঝড়ের ফলে গরিব চাষির কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়ে, ফলে তারা গৃহহীন হয়ে যায়। মাঝির নৌকার পাল ছিঁড়ে যাওয়ায় সে জীবিকা হারায়। বাবুই পাখির মতো ছোট ও নিরীহ প্রাণীদের বাসা উড়ে যায়। দরিদ্র মা যখন সন্তানের জন্য খাবার রান্না করেন, সেই খাবার পর্যন্ত ঝড়ে নষ্ট হয়ে যায়। অথচ যারা সমাজের শোষক, যারা অন্যের পরিশ্রম শোষণ করে বড়লোক হয়েছে, তাদের প্রাসাদ অক্ষত থাকে। প্রকৃতির এই বৈষম্যমূলক আচরণ কবিকে ব্যথিত করে । তাই তিনি বৈশাখী ঝড়ের প্রতি অসন্তুষ্ট।


৫। বোশেখের ঝড় রামায়ণের চরিত্রদের সাথে কিভাবে মিলে?

উত্তর: কবি বোশেখের ঝড়ের সাথে রামায়ণের চরিত্রদের তুলনা করেছেন প্রতীকের মাধ্যমে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ঝড় যদি প্রকৃত শক্তিশালী হতো, তবে তা মহাবীর হনুমানের মতো হতো। রামায়ণে বীর হনুমান ছিলেন ন্যায় ও সাহসের প্রতীক। তিনি অসুরদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতেন। কিন্তু বোশেখের ঝড় কেবল দুর্বল ও দরিদ্রদের ক্ষতি করে। তিনি চান, ঝড় যেন হনুমানের মতো অন্যায় দমন করে এবং শোষিতদের রক্ষা করে। এইভাবে কবি রামায়ণের চরিত্রদের সাথে বোশেখের ঝড়ের তুলনা করেছেন।


৬। বোশেখ কবিতায় কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’-কেন উল্লেখ করেন?

উত্তর: কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এর প্রসঙ্গ এনেছেন, কারণ তিনি বোশেখের ঝড়কে ন্যায়পরায়ণ হওয়ার শিক্ষা দিতে চান। ‘মেঘদূত’ কাব্যে মেঘ ছিল প্রেম ও করুণার প্রতীক। এটি বিরহী যক্ষের দূত হিসেবে প্রেমবার্তা বহন করেছিল। কিন্তু বোশেখের ঝড় সেই করুণাময় মেঘের বিপরীত। এটি ধ্বংস আর তাণ্ডব ছাড়া কিছুই জানে না। ঝড় শুধু দরিদ্র ও নিরীহ প্রাণীদের ক্ষতি করে। কবি চান, প্রকৃতি যেন দয়ালু ও ন্যায়পরায়ণ হয়। তাই তিনি মেঘদূতের প্রসঙ্গ টেনে প্রকৃতির গুণ পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।


৭। বোশেখের ঝড় কিভাবে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে?

উত্তর: বোশেখের ঝড় মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত করে। গরিব মানুষের ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যায়, যার ফলে তারা গৃহহীন হয়ে পড়ে। চাষির ঘর ভেঙে ফেলা হয়। মাঝির নৌকার পালের দড়ি ছিঁড়ে ফেলা হয়। ঝড়ের তাণ্ডবের কারণে খেতে গিয়ে টুনটুনি পাখিদের বাসা উড়ে যায়, তাদের কোন নিরাপদ আশ্রয় থাকে না। এমনকি মায়ের রান্না করা খাবারও উল্টে ফেলে, যা তাদের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দেয়। ঘর-বাড়ি, কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা—সবই ঝড়ের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যা মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনে।


৮। “তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে নাতো।”ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: কবি ধনীদের প্রাসাদ অক্ষত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ যখন বোশেখের ঝড় পৃথিবীকে তছনছ করে দেয়, তখন দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল, ঘাটে গুঁড়িয়ে যায়। কিন্তু ধনীরা, যারা অন্যদের শ্রম শোষণ করে সম্পদ উপার্জন করেছে, তাদের প্রাসাদ ঠিক আগের মতো অক্ষত থাকে। কবি মনে করেন, প্রকৃতির এই ধ্বংসযজ্ঞ আসলে সমাজে বৈষম্যকে তুলে ধরে। কবি এই অসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং চান যে প্রকৃতির ধ্বংস যদি অবশ্যম্ভাবী হয়, তবে তা যেন শুধুমাত্র দুর্বলদের ক্ষতি না করে, বরং শোষকদেরও শাস্তি দেবে।


৯। কবি কিভাবে বোশেখের ঝড়কে সুবিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন?

উত্তর: কবি বোশেখের ঝড়কে সুবিচার করার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ তিনি চান প্রকৃতি যেন শুধু দরিদ্রদের ক্ষতি না করে। তিনি চান, ঝড় যেন শুধু শোষকদের শাস্তি দেয়, যারা অন্যের শ্রমে মস্ত দালান তৈরি করেছে, তাদের ধ্বংস করে। কবি মনে করেন, প্রকৃতির শক্তি যদি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তাকে গরিবের বিরুদ্ধে নয়, বরং সেইসব শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে, যারা সমাজে অন্যায়ভাবে সম্পদ জমিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের পিঠে চড়ে তাদের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কবি এভাবে প্রকৃতির শক্তিকে সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করতে চান।


১০। ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের”ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: কবি বোশেখকে বিভেদকারী শোষকদের বিরুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ তিনি দেখতে চান যে প্রকৃতি যেন শুধু গরিব ও অসহায় মানুষের উপর নিষ্ঠুরতা না চালায়। কবি মনে করেন, প্রকৃতির শক্তি যদি এমন ভয়ংকর হয়, তবে তা যেন অন্যায়ের শিকারদের বিরুদ্ধে কাজ করে। যারা মানুষকে শোষণ করে নিজেদের প্রাসাদ তৈরি করেছে, তাদের ধ্বংস করা উচিত। কবি চান, প্রকৃতির এই ধ্বংসাত্মক শক্তি যেন সমাজের এই শোষক শ্রেণির উপর নেমে আসে, যারা সাধারণ মানুষের পরিশ্রমকে শোষণ করে তাদের দুঃখ বাড়ায়।


১১। বোশেখ কবিতায় কেন বুনোহাঁস ও জেট প্লেনের কথা এসেছে?

উত্তর: কবি এখানে প্রকৃতির শক্তির সামনে সবকিছুর অসহায়ত্ব দেখাতে চেয়েছেন। বুনোহাঁস হলো প্রকৃতির মুক্ত পাখি, আর জেট প্লেন মানুষের তৈরি আধুনিক প্রযুক্তির প্রতীক। কবি দেখাতে চেয়েছেন, বৈশাখের ঝড় যখন আসে, তা প্রকৃতির প্রাণী এবং মানুষের প্রযুক্তি – কোনোটিকেই রেহাই দেয় না। এই দুটি বিপরীতধর্মী চিত্র একসাথে ব্যবহার করে কবি বুঝিয়েছেন যে ঝড়ের সামনে সবাই সমান। ধনী-গরিব, মানুষ-প্রাণী, পুরনো-আধুনিক – সবকিছুরই ধ্বংস হয়।


১২। ‘তিষ্ঠ হাওয়া’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে?

উত্তর: কবি এখানে ঝড়কে সরাসরি সম্বোধন করেছেন, যেন সেটি একজন ব্যক্তি। “তিষ্ঠ হাওয়া” বলার মাধ্যমে তিনি ঝড়কে থামার অনুরোধ জানাচ্ছেন, যেভাবে আমরা কাউকে থামতে বলি। এই পদ্ধতিতে কবি ঝড়কে একটি সচেতন সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যে মানুষের কথা বুঝতে পারে। এটি বাংলার লোকসাহিত্যের একটি প্রচলিত পদ্ধতি, যেখানে প্রকৃতির শক্তিগুলোকে মানুষের মতো করে কল্পনা করা হয়।


১৩। বোশেখ কবিতায় কেন রামায়ণ ও মেঘদূতের কথা উল্লেখ করেছেন?

উত্তর: কবি এখানে হিন্দু পুরাণের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন বিশেষ কারণে। রামায়ণে বর্ণিত হনুমান ছিলেন বায়ুদেবের পুত্র, অর্থাৎ ঝড়-বাতাসের দেবতার সন্তান। মেঘদূত কাব্যে মেঘকে বার্তাবাহক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে সেই একই ঝড় গরিব মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস করছে। এই বৈপরীত্য দেখিয়ে কবি বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, এখন প্রকৃতির শক্তিগুলোও শোষিত মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করছে।


১৪। বোশেখ কবিতা সামাজিক অবিচারের প্রতীক।—উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: কবি পুরো কবিতায় বৈশাখের ঝড়কে সমাজের অসমতা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে ঝড় সবসময় গরিব মানুষের ঘরবাড়ি, মাঝির নৌকা, ক্ষেতখামারই বেশি ক্ষতি করে। ধনী লোকের বড় বড় বাড়ি, অট্টালিকাগুলো সাধারণত ঝড়ে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এটি আসলে আমাদের সমাজেরই একটি চিত্র – যেখানে দুর্যোগ, সমস্যা সবসময় গরিব মানুষকেই বেশি আক্রান্ত করে। এটি কবির সমাজের প্রতি তীব্র সমালোচনা।


১৫। বোশেখ কবিতায় বৈশাখের ধ্বংসাত্মক দিকটিকেই বেশি ফুটে ওঠে।ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: বৈশাখ মাস সাধারণত বাঙালির কাছে নতুন বছরের সূচনা, উৎসবের সময়। কিন্তু কবি ইচ্ছা করে বৈশাখের ধ্বংসাত্মক দিকটি বেছে নিয়েছেন। এর কারণ হলো, তিনি সমাজের কঠিন বাস্তবতা দেখাতে চেয়েছেন। আমরা সবাই বৈশাখের উৎসব, মেলা, পহেলা বৈশাখের আনন্দ নিয়ে কথা বলি, কিন্তু এই মাসে যারা ঘরহারা হয়, ফসল হারায়, তাদের কথা কেউ বলে না। কবি সেই অবহেলিত সত্যকে সামনে এনেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, আমাদের সমাজে উৎসবের আড়ালে অনেক বেদনাও লুকিয়ে থাকে।


১৬। টুনটুনি পাখি ও গরিব মায়ের ভাতের হাঁড়ির চিত্র কবিতায় কিভাবে আবেগ সৃষ্টি করে?

উত্তর: কবি ইচ্ছা করে খুব সাধারণ, দৈনন্দিন জীবনের চিত্রগুলো বেছে নিয়েছেন। টুনটুনি পাখি আমাদের চারপাশেই দেখা যায়, ছোট্ট সুন্দর একটি পাখি। গরিব মায়ের ভাতের হাঁড়ি – এটি বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের পরিচিত দৃশ্য। এই সাধারণ চিত্রগুলো পাঠকের মনে সহজেই সাড়া জাগায়, কারণ এগুলো তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার অংশ। কবি জানেন যে, বড় বড় উদাহরণের চেয়ে এই ছোট ছোট বাস্তব জীবনের দৃশ্যগুলো মানুষের হৃদয় গভীরভাবে স্পর্শ করে।


১৭। রাজা সোলেমান ও রবীন্দ্রনাথের কথা কবিতায় কেন বলা হয়েছে?

উত্তর: রাজা সোলেমান ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতীক, তিনি প্রজাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতেন। রবীন্দ্রনাথ তিনি সমগ্র বাংলাদেশী সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।কবি যখন তাদের উল্লেখ করেন, তখন তিনি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। এটি পাঠককে বুঝতে সাহায্য করে যে, কবির বক্তব্য শুধু তার ব্যক্তিগত মতামত নয়, বরং ইতিহাস ও সংস্কৃতির সমর্থন আছে। এইভাবে কবি তার বিপ্লবী চিন্তাকে ঐতিহ্য ও ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত করেছেন।


১৮। ‘পরগাছা’ শব্দটি দিয়ে কাদের বোঝায়?ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ‘পরগাছা’ হলো সেই গাছ যা অন্য গাছের উপর জন্মে, তার খাদ্য শুষে নেয়, কিন্তু নিজে কিছু দেয় না। কবি এই সহজ-বোধগম্য উদাহরণ ব্যবহার করে শোষক শ্রেণীকে বোঝাতে চেয়েছেন। কবি জটিল তাত্ত্বিক ভাষা এড়িয়ে এমন সহজ উপমা ব্যবহার করেছেন, যাতে সাধারণ কৃষক, শ্রমিকরাও তার বক্তব্য বুঝতে পারে। ‘পরগাছা’ শব্দটি শ্রেণী শোষণের একটি স্পষ্ট এবং কার্যকর চিত্র তৈরি করে। এটি দেখায় যে, সমাজের কিছু লোক অন্যের শ্রমের উপর বেঁচে আছে, নিজেরা কোনো উৎপাদন করে না।


আরও পড়ুনঃ রানার কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর

Related Posts

Leave a Comment