হেমাপ্যাথি এ্যালাপ্যাথি গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

হাসান আজিজুল হকের ‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপ্যাথি’ গল্পটিতে গ্রাম্য পরিবেশের গল্প, যেখানে দুইজন ডাক্তার আছে। একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার অঘোর, আরেকজন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার তোরাপ। এই গল্পে তাদের দুইজনের ডাক্তারি চালানোর পদ্ধতি, রোগীদের চিকিৎসা করার ভঙ্গি, আর গ্রামের মানুষ কীভাবে তাদের দেখত, সবকিছু মজারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। নিচে হেমাপ্যাথি এ্যালাপ্যাথি গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

হেমাপ্যাথি এ্যালাপ্যাথি গল্পের মূলভাব

হাসান আজিজুল হকের ‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপ্যাথি’ গল্পটিতে একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার অঘোর ও একজন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার তোরাপকে ঘিরে গ্রামের মজার এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অঘোর ডাক্তার খুব কথাবার্তায় পটু, রোগীদের ভয় দেখিয়ে হাসিয়ে ওষুধ দেন। তিনি বলেন পেটের গোঁ গোঁ শব্দ আসলে পেটের ভেতর ব্যাঙ ডাকছে! তিনি এক ফোঁটা স্পিরিট আর সামান্য ওষুধ দিয়ে সেই ব্যাঙ তাড়ান। রোগীরা ওষুধের চেয়ে তার গল্পে বেশি সেরে ওঠে। কেউ কিছু দিলে তাতেই খুশি হয়ে যান তিনি। তার ওষুধে রোগ না সারলেও রোগীরা মন থেকে খুশি থাকে। অন্যদিকে তোরাপ ডাক্তার আসলে একজন চাষাভুষো লোক, তবে শরতের সময় ডাক্তারি করেন। তিনি ভয়ংকর বড়ি ও ইনজেকশন দেন, রোগীকে ভয় দেখিয়ে চিকিৎসা করেন। তার চিকিৎসা নিতে অনেকেই ভয় পায়, তবু যায় — কারণ তিনি জোরে জোরে বলে, “ম্যাগাক্রিন খাও, বিসিপি খাও!”। অনেক সময় তার ওষুধে কারও কারও অবস্থা আরও খারাপ হয়। তবুও তার ডাক্তারি চলে, কারণ গ্রামে ভয় আর বিশ্বাসে ডাক্তার চলে। গল্পটি মজা করে দেখিয়েছে কেমন করে ডাক্তার না হয়েও অনেকে গ্রামে চিকিৎসা করেন। এটি একটি ব্যঙ্গাত্মক ও রসাত্মক গল্প, যা গ্রামীণ বাস্তবতার প্রতিফলন।

হেমাপ্যাথি এ্যালাপ্যাথি গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

১। ক. অঘোর ডাক্তার চুপি চুপি জেলা শহরে গিয়েছিলেন কেন?
খ. ‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপ্যাথি’ গল্প অবলম্বনে গ্রামীণ ডাক্তারের চিকিৎসা পদ্ধতির বর্ণনা দাও।

ক) উত্তরঃ অঘোর ডাক্তার চুপি চুপি জেলা শহরে গিয়েছিলেন নিজের অসুখের চিকিৎসা করাতে। তিনি অনেক দিন ধরে নিজেই নিজের চিকিৎসা করছিলেন, কিন্তু তাতে কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করলেও, নিজের অসুখ নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন। তিনি চাইছিলেন, বড় কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। কিন্তু তিনি নিজে তো গ্রামে ডাক্তার হিসেবে পরিচিত, তাই লোকলজ্জায় কাউকে কিছু বলেননি। গোপনে শহরে গিয়ে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে যান। শহরের সেই ডাক্তার তার চিকিৎসা পদ্ধতি দেখে হাসেন। তিনি বলেন, অঘোর ডাক্তার যে ওষুধ নিচ্ছেন, তাতে কোনো কাজ হবে না। কারণ তিনি না বুঝেই বিভিন্ন ওষুধ নিজের ওপর প্রয়োগ করছিলেন। এই অভিজ্ঞতায় অঘোর ডাক্তার বুঝতে পারেন, চিকিৎসা করা অত সহজ নয়। এই কারণে তিনি পরে নিজে চিকিৎসা দেওয়া বন্ধ করে দেন।

খ) উত্তরঃ ‘হেমাপ্যাথি, এ্যালাপ্যাথি’ গল্পে দুই ধরনের গ্রামীণ ডাক্তারের মজার ও ব্যঙ্গাত্মক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অঘোর ডাক্তার ও তোরাপ ডাক্তার। অঘোর একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। তিনি রোগী দেখার সময় গল্প বলেন, হাসান, ভয় দেখান—এইসব দিয়েই রোগ সারানোর চেষ্টা করেন। রোগী যদি বলেন পেট গোঁ গোঁ করছে, তিনি বলেন “পেটের মধ্যে ব্যাঙ ডাকে!” তারপর এক ফোঁটা স্পিরিট ও সামান্য হোমিও ওষুধ দিয়ে ব্যাঙ তাড়ান। তার ওষুধে রোগ না সারলেও রোগী হাসতে হাসতে ভালো বোধ করে। তিনি বিনিময়ে কিছু না চাইলেও কেউ যদি একটা ডিম বা কলা দেয়, তাতেই তিনি খুশি। অর্থের চেয়ে মানুষের ভালোবাসা তার কাছে বড়।অন্যদিকে তোরাপ একজন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হলেও আসলে তিনি একজন চাষাভুষো মানুষ। তবে শরতের সময় তিনি ডাক্তার বনে যান। রোগীদের ভয় ধরিয়ে বড় বড় ইনজেকশন, ট্যাবলেট দেন—যেমন “ম্যাগাক্রিন খাও, বিসিপি খাও!” রোগীকে না বুঝিয়ে জোর করে ওষুধ দেন। তার চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেক সময় রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবুও লোকজন যায়, কারণ তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসা করেন। এই দুই ডাক্তার মিলেই গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক বাস্তব ও মজার রূপ দেখিয়েছে গল্পটি। তাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক না হলেও গ্রামে ‘বিশ্বাস আর ভয়’-এর ওপর ভিত্তি করে ডাক্তারি চলে।

২। ক. ম্যালেরিয়া জ্বরকে বাঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কেন?
খ. এ্যালোপ্যাথ ডাক্তার তোরাপের ম্যালেরিয়া চিকিৎসা কেমন ছিল?

ক) উত্তরঃ গল্পে ম্যালেরিয়া জ্বরকে বাঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, কারণ এই জ্বর খুবই ভয়ংকর। যাকে ম্যালেরিয়া হয়, সে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। ঠিক যেমন বাঘ আক্রমণ করলে মানুষ আতঙ্কে কাঁপে, তেমনই ম্যালেরিয়া হলে শরীর কাঁপে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষজন ভাবেন, বুঝি শরীরের ভেতরে একটা বাঘ ঢুকে পড়েছে। এই তুলনা করে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, ম্যালেরিয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে কতটা ভয় কাজ করে। এছাড়া, জ্বর আসার ধরনটাও হঠাৎ বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো। গ্রামীণ মানুষের চোখে বাঘ আর ম্যালেরিয়া — দুটোই আতঙ্কের নাম। তাই তারা ম্যালেরিয়াকে ‘জ্বরের বাঘ’ বলে। লেখক এই তুলনার মাধ্যমে মজার ছলে গ্রামীণ মানুষের মানসিকতা তুলে ধরেছেন। এতে করে গল্পটি হয়েছে হাস্যরসপূর্ণ এবং ব্যঙ্গাত্মক।

খ) উত্তরঃ গল্পে তোরাপ একজন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে পরিচিত হলেও আসলে তিনি একজন চাষাভুষো মানুষ। কিন্তু শরতের সময় যখন গ্রামে ম্যালেরিয়া জ্বর ছড়ায়, তখন তিনি ডাক্তার সেজে বসেন। তোরাপের চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই ভয় ধরানো ধরনের। তিনি রোগীদের সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলেন। তার মুখের মুখস্ত কথা— “ম্যাগাক্রিন খাও, বিসিপি খাও!” — এসব বলে তিনি জোর করে ওষুধ খাওয়ান। রোগীদের না বুঝিয়েই তারা কোন রোগে আক্রান্ত এবং কী ওষুধ খাচ্ছে তা বলে দেন। তোরাপের চিকিৎসায় বড় বড় ক্যাপসুল, ইনজেকশন আর প্রচুর ওষুধ থাকে। তার ইনজেকশন দেওয়ার ভয়েই অনেকে তার কাছে যেতে চায় না, তবু বাধ্য হয়ে যায়। কখনো কখনো তার দেওয়া ওষুধে রোগ সারার বদলে আরও বাড়ে, এমনকি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তোরাপের চিকিৎসা মূলত ভয় আর জোরের ওপর দাঁড়িয়ে। মানুষ তাকে বিশ্বাস করে না, তবু ভয় পেয়ে চিকিৎসা নেয়। কারণ গ্রামে ভালো চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। তার ডাক্তারির পেছনে নেই কোনো সঠিক জ্ঞান বা ডিগ্রি, আছে শুধু সাহস আর কিছু ওষুধের নাম। লেখক এই চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকার অশিক্ষিত বা ভুয়া ডাক্তারদের অবস্থা মজার ছলে ফুটিয়ে তুলেছেন।

৩। ক. কোন কোন সময় গ্রামে, রোগের প্রকোপ বেশি ছিল? ব্যাখ্যা কর।
খ. হোমিওপ্যাথ ডাক্তার অঘোর ও এ্যালোপ্যাথ ডাস্তার তোরাপের চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনামূলক আলোচনা কর।

ক) উত্তরঃ গল্পে বলা হয়েছে, শরৎকালে গ্রামে ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হতো। কারণ, এই সময়ে চারদিকে পানি জমে থাকত, যা মশা জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করত। এই মশাগুলোর মাধ্যমে ম্যালেরিয়া ছড়াত। গ্রামের মানুষদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, নালার পাশে বসবাস এবং মশা প্রতিরোধে সচেতনতার ঘাটতি ছিল। ফলে শরৎ এলেই ম্যালেরিয়া গ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ত। এতে অনেকেই আক্রান্ত হতো এবং দারিদ্র্যের কারণে সঠিক চিকিৎসাও পেত না। ফলে রোগের প্রকোপ আরও বাড়ত। তাই গল্পে শরৎকালকে রোগ ছড়ানোর ভয়াবহ সময় হিসেবে দেখানো হয়েছে।

খ) উত্তরঃ অঘোর ও তোরাপ — দুজনেই গ্রামীণ ডাক্তার হলেও তাঁদের চিকিৎসার ধরন ছিল একেবারে ভিন্ন। অঘোর একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। তিনি রোগীকে ভয় না দিয়ে বরং হাস্যরসের মাধ্যমে চিকিৎসা করতেন। ছোট ছোট মিষ্টি ওষুধের ফোঁটা ও মজা করে রোগ ব্যাখ্যা করে রোগীকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতেন। তিনি বলেন, “পেটের ব্যাঙ ডাকছে”— এই ধরনের কথা বলে রোগীকে হাসাতেন এবং সামান্য ওষুধ দিতেন।

অন্যদিকে, তোরাপ একজন অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার হলেও বাস্তবে তার কোনো ডাক্তারি জ্ঞান নেই। তিনি রোগীকে ভয় দেখিয়ে বড় বড় ওষুধ ও ইনজেকশন দেন। রোগী কিছু না বুঝলেও তাকে জোর করে বলেন “ম্যাগাক্রিন খাও, বিসিপি খাও!” তার ওষুধে অনেক সময় রোগ ভালো না হয়ে আরও খারাপ হয়। অঘোরের ওষুধে রোগ না সারলেও রোগীরা মানসিক শান্তি পেত। তিনি রোগীকে আপনজনের মতো দেখতেন। আর তোরাপের চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগী ভয় পেত, কিন্তু রোগ নিরাময়ের আশা করত।। দুজনেই গ্রামের মানুষদের উপরে নির্ভর করে, কিন্তু একজন ভালোবাসা দিয়ে আরেকজন ভয় দেখিয়ে। লেখক ব্যঙ্গের মাধ্যমে এই দুই ধরনের গ্রামীণ চিকিৎসার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন।

আরও পড়ুনঃ নয়া পত্তন গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

Related Posts

Leave a Comment