মারমা রূপকথা হলুদ টিয়া সাদা টিয়া মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

‘হলুদ টিয়া সাদা টিয়া’ মারমা রূপকথা গল্পটি মাউচিং–এর লেখা। এক জুমচাষি দম্পতির একমাত্র মেয়েকে তারা ধান পাহারা দিতে বলে জুমে চলে যায়। এই পোস্টে ষষ্ঠ শ্রেণির আনন্দপাঠের মারমা রূপকথা হলুদ টিয়া সাদা টিয়া মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

মারমা রূপকথা হলুদ টিয়া সাদা টিয়া মূলভাব

অনেক দিন আগের কথা, এক জুমচাষি দম্পতির একমাত্র মেয়ে ছিল। তারা প্রতিদিন সকালে জুমে চলে যেত আর মেয়েকে ঘরের কাজ ও ধান পাহারার দায়িত্ব দিয়ে যেত। মেয়েটি সততার সঙ্গে ধান পাহারা দিত, কিন্তু হঠাৎ একদিন সাদা ও হলুদ টিয়ারা এসে ধান খেয়ে ফেলে। মেয়েটি নিষেধ করলেও টিয়ারা বলে, “তোমার মা-বাবা বকলে আমাদের কাছে চলে এসো।” সন্ধ্যায় ধান না পেয়ে মা-বাবা মেয়েকে বকাঝকা করে। পরদিনও একই ঘটনা ঘটে এবং এবার তারা মেয়েকে মারধর করে ও শেষবারের মতো সাবধান করে। তৃতীয় দিনও ধান খেয়ে যায় টিয়ারা, আর মা-বাবা মেয়েটিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে টিয়াদের খুঁজতে বের হয়। পথে রাখাল, মেষপালক, অশ্বরক্ষক ও হস্তীরক্ষক তাকে সাহায্য করে, খাওয়ায়, পথ দেখায়। মেয়েটি সবাইকে সম্মান করে এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে চলে। শেষে সে এক সুবর্ণ অট্টালিকায় পৌঁছায়, যেখানে সাদা ও হলুদ টিয়ারা থাকে। টিয়ারা তাকে সাধারণ কাঠের সিঁড়ি, থালা ও বিছানা ব্যবহারে অনুমতি দেয়, এবং সাদর অভ্যর্থনা জানায়। মেয়েটি তার দুঃখের কথা জানালে টিয়ারা তাকে সাত কলস সোনা-রুপার মোহর, রক্ষী ও সুন্দর পোশাক দিয়ে বাড়ি পাঠায়। মা-বাবা ও পাড়ার লোকজন মেয়েটিকে দেখে চমকে যায়। এরপর এক লোভী পরিবার তাদের মেয়েকে টিয়াদের দেশে পাঠায় সোনা পাওয়ার আশায়। সে লোভে পড়ে সোনার সিঁড়ি, থালা, খাট ব্যবহার করে। টিয়ারা তাকে সাতটি কলস দেয় ও বলে বাড়ি গিয়ে মুখ না খুলতে। কিন্তু সে আত্মীয়স্বজন ডেকে কলস খুলে দেয়। কলস থেকে বিষধর সাপ বের হয়ে সবাইকে দংশন করে ও তাদের নিঃশেষ করে দেয়। এইভাবে বিনয়ী মেয়ে পুরস্কৃত হয়, আর লোভী মেয়ে ও তার পরিবার শাস্তি পায়।

মারমা রূপকথা হলুদ টিয়া সাদা টিয়া বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন ১। ক. দম্পতি কীভাবে তাদের দিন অতিবাহিত করত?
খ. জুমচাষি দম্পতির মেয়েটিকে টিয়াপাখিরা কীভাবে আপ্যায়ন করে তা বর্ণনা কর।

ক) উত্তরঃ জুমচাষি দম্পতি খুবই পরিশ্রমী ছিল। তারা প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠত। ঘুম থেকে উঠে রান্না-বান্না করে খেয়ে জুমচাষে বেরিয়ে পড়ত। মেয়েটিকে তারা ঘরে একা রেখে যেত। মেয়েটি ঘর পাহারা দিত এবং ঘরের কাজ করত। সন্ধ্যায় তারা চাষের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসত। তারপর আবার রাতের রান্না করত। সবাই একসঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। এভাবেই তাদের প্রতিদিনের জীবন চলত। তাদের জীবন ছিল শান্তিপূর্ণ এবং সহজ-সরল। নিয়মমাফিক কাজ করে তারা দিন কাটাত। তারা একে অপরকে সাহায্য করত ও ভালোবাসত।

খ) উত্তরঃ জুমচাষি দম্পতির মেয়েটি টিয়াপাখিদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। অনেক পথ পেরিয়ে অবশেষে সে টিয়াদের দেশে পৌঁছে যায়। সে দেখে সামনে এক সুবর্ণ অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে। টিয়ারা মেয়েটির পরিচয় ও কষ্টের কথা শুনে তাকে সাদরে গ্রহণ করে। তারা জিজ্ঞেস করে—সে কোন সিঁড়ি দিয়ে ঘরে উঠতে চায়—সোনার, রূপার না কাঠের। মেয়েটি বলে, তারা গরিব, সে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে অভ্যস্ত। তাই তাকে কাঠের সিঁড়ি দিয়েই উঠতে দেওয়া হয়। তারপর মেয়েটিকে গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরতে দেওয়া হয়। তাকে সোনার থালা, রূপার থালায় খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু সে সাধারণ থালায় খেতে চায়। মেয়েটি জীবনে এমন খাবার কখনও খায়নি, তাই সে খেয়ে খুবই তৃপ্ত হয়। রাতে ঘুমানোর সময় টিয়ারা জিজ্ঞেস করে—সে কোন খাটে ঘুমাবে—সোনার, রূপার, না মেঝেতে। মেয়েটি বলে, সে কখনও খাটে ঘুমায়নি, তাই মেঝেতে ঘুমাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। টিয়ারা তার ইচ্ছামতো মেঝেতে ঘুমাতে দেয়। পরদিন মেয়েটি তার দুঃখের কথা টিয়াদের জানায়। তারা মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর অনেক সোনা-রূপার মোহর, সুন্দর পোশাক আর কয়েকজন রক্ষী দিয়ে মেয়েটিকে বাড়ি পাঠায়। টিয়ারা তাকে ভালোবাসা ও সম্মান দিয়ে আপ্যায়ন করে।


প্রশ্ন ২। ক. জুমচাষি দম্পতি তাদের মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় কেন?
খ. ‘হলুদ টিয়া সাদা টিয়া’ গল্পে সৎ নির্লোভ মানুষের জীবনে শেষ পর্যন্ত শান্তি-স্বস্তি ফিরে পাওয়ার বিষয়টি কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।

ক) উত্তরঃ জুমচাষি দম্পতি প্রতিদিন ধান শুকাতে দিয়ে জুমে যেত। তারা মেয়েকে বলত ধান পাহারা দিতে। মেয়েটি সততার সঙ্গে ধান পাহারা দিলেও হঠাৎ একদিন কিছু সাদা ও হলুদ টিয়া এসে সব ধান খেয়ে ফেলে। সে টিয়াদের অনেক অনুরোধ করলেও তারা ধান খাওয়া বন্ধ করেনি। টিয়ারা বলেছিল, ‘তোমার মা-বাবা মারলে আমাদের কাছে চলে এসো।’ সন্ধ্যায় মা-বাবা ফিরে এসে ধান না পেয়ে মেয়েকে বকুনি দেয়। পরদিন একই ঘটনা ঘটলে তারা মেয়েকে মারধর করে এবং শেষবারের মতো সাবধান করে। তৃতীয় দিনও ধান খেয়ে যায় টিয়ারা। তখন মা-বাবা মেয়েটির কথা বিশ্বাস না করে ভাবে সে অলস আর দায়িত্বহীন। তাই তারা রাগ করে মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

খ) উত্তরঃ হলুদ টিয়া সাদা টিয়া’ গল্পে সৎ, বিনয়ী ও নির্লোভ মেয়েটির জীবনে শেষ পর্যন্ত শান্তি ও সুখ ফিরে আসার চমৎকার উদাহরণ দেখা যায়। গল্পের মেয়েটি খুবই সরল ও দায়িত্বশীল ছিল। সে ধান পাহারা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়, কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত নয়। টিয়ারা ধান খেয়ে নেয়, আর মা-বাবা না বুঝেই মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেয়। সে কাঁদতে কাঁদতে টিয়াদের খুঁজতে বের হয়, তবু কারও প্রতি কোনো রাগ পোষণ করে না। পথে যাদের সঙ্গে দেখা হয়, তাদের আতিথ্য গ্রহণ করে এবং সম্মান দেখায়। সে কখনো লোভ করে না, বরং নিজের গরিবি ও সরলতা স্বীকার করে নেয়। টিয়াদের দেশে পৌঁছে সে সোনার সিঁড়ি, থালা বা খাট না বেছে কাঠের সিঁড়ি, সাধারণ থালা আর মেঝেতে ঘুমানোকে বেছে নেয়। তার এই নির্লোভ ও নম্র আচরণ দেখে টিয়ারা খুব খুশি হয়। তারা মেয়েটিকে অনেক ধন-সম্পদ, ভালোবাসা ও সম্মান দিয়ে বাড়ি পাঠায়। এতে বোঝা যায়, যারা বিনয়ী, সত্ ও লোভহীন, তারা জীবনযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সফল হয়। গল্পটি শিক্ষা দেয়—সততা ও সরলতার ফল ভালো হয়।


প্রশ্ন ৩। ক. ‘হলুদ টিয়া সাদা টিয়া’ গল্পে মেয়েটি টিয়ার দেশের সম্মান পায় কীভাবে?
খ. ‘হলুদ টিয়া সাদা টিয়া’ গল্পে কীভাবে লোভী মানুষের নির্মম পরিণতি দেখানো হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।

ক) উত্তরঃ মেয়েটি খুব সৎ, নম্র ও বিনয়ী ছিল। সে ধান পাহারা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও মিথ্যে বলেনি। টিয়ারা ধান খেয়ে ফেললে মা-বাবা তাকে ভুল বুঝে তাড়িয়ে দেয়। সে কাঁদতে কাঁদতে টিয়াদের খুঁজতে বের হয়। পথে যারা তাকে সাহায্য করে, তাদের সে শ্রদ্ধা করে এবং তাদের আতিথ্য গ্রহণ করে। টিয়াদের দেশে পৌঁছে সে কাঠের সিঁড়ি, সাধারণ থালা ও মেঝেতে ঘুমানো বেছে নেয়। সে কখনো লোভ করেনি, নিজের গরিব জীবনের কথাই বলেছে। তার নম্র ব্যবহার টিয়াদের মন জয় করে। টিয়ারা তার দুঃখ শুনে তাকে ভালোবাসে ও সাদরে আপ্যায়ন করে। পরে তারা তাকে সুন্দর পোশাক, সোনা-রুপার মোহর ও রক্ষীসহ বাড়ি পাঠায়। মেয়েটির সততা ও বিনয়ের কারণেই সে টিয়ার দেশে সম্মান পায়।

খ) উত্তরঃ ‘গল্পে দ্বিতীয় মেয়েটি ছিল লোভী ও অহংকারী। সে টিয়ার দেশে গেলে সোনার সিঁড়ি, সোনার থালা ও সোনার খাট বেছে নেয়। সে নিজের ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বেশ অহংকার দেখায়। টিয়ারা তাকে সাতটি কলস দিয়ে দেয় এবং বলে বাড়ি ফিরে চট করে কলসের মুখ যেন না খোলে। কিন্তু মেয়েটি লোভের কারণে পরিবারের সবাইকে ডেকে এনে কলস খুলে দেয়। কলসের ভেতর থেকে বিষধর সাপ বের হয়ে সবাইকে দংশন করে। ফলে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নির্বংশ হয়ে যায়। এই ঘটনাটি লোভ ও অহংকারের ফলশ্রুতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। গল্পের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, লোভী মানুষের জীবন অশান্ত ও বিপদময় হয় এবং তাদের শেষ পরিণতি অনেক সময় ভয়াবহ হয়। লোভ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তাই লোভ ত্যাগ করা জরুরি। গল্পের এই অংশ থেকে পাঠকরা বুঝতে পারে, লোভী হওয়া জীবনের জন্য কত বড় বিপদ এবং এর ফলে মানুষ ও তার পরিবারের ভাগ্য ধ্বংস হতে পারে।


Related Posts

Leave a Comment