সেইদিন এই মাঠ’ কবিতাটির মূল ভাব মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী হলেও প্রকৃতি চিরকাল প্রাণময় থাকে। মাঠে খেয়া নৌকা চলে, চালতাফুলে পড়ে শিশির, লক্ষ্মীপেঁচার গান বেজে ওঠে এই সবকিছু মানুষের মৃত্যুর প্রভাব থেকে মুক্ত। এই পোস্টে সেইদিন এই মাঠ কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা সহজ ভাষায় লিখে দিলাম।
Table of Contents
সেইদিন এই মাঠ কবিতার মূলভাব
কবিতায় কবি বলছেন, মানুষের জীবন অস্থায়ী, প্রত্যেককে একদিন চলে যেতে হয়। কিন্তু প্রকৃতি চিরস্থায়ী, তার সৌন্দর্য, রঙ, গন্ধ ও চঞ্চলতা কখনও শেষ হয় না। মাঠে থাকা সবুজ ঘাস, শিশিরে ভেজা চালতাফুল, নদীর জল, নদীর তীরে খেয়া নৌকা, সবকিছু মানুষের মৃত্যুর মধ্যেও বাঁচে। প্রকৃতির মধ্যেই মানুষের স্বপ্ন ও আশা বাঁচতে থাকে। শিশিরের জল ফুলের সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে, এবং এর গন্ধ মানুষকে দীর্ঘকাল আনন্দ দেয়। লক্ষ্মীপেঁচা তার গান গায়, যা প্রকৃতির অন্তর্নিহিত জীবনের মধুরতা প্রকাশ করে। পৃথিবীর নানা সভ্যতা ধ্বংস হলেও, প্রকৃতির সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ থাকে। এশিরিয়া বা ব্যাবিলনের সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু প্রকৃতির রূপ ও রস বেঁচে আছে। কবি বলছেন, মানুষের মৃত্যু হলেও পৃথিবীর সৌন্দর্য, প্রকৃতির রূপ ও মানুষের স্বপ্ন কখনো মরে না। এই কবিতায় জীবনানন্দ প্রকৃতির চিরস্থায়ী সৌন্দর্য ও মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনের মধ্যে একটি সুক্ষ্ম সম্পর্ক তুলে ধরেছেন। মৃত্যুর মধ্যেও জীবন অব্যাহত থাকে, কারণ প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষের মনে চিরকাল জেগে থাকে। কবি আমাদের শিখাচ্ছেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে মৃত্যু কোনো বাধা নয়। প্রকৃতির রহস্যময় রূপ, শিশিরে ভেজা ফুল, নদী, বাতাস ও গান সবই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের প্রয়াণ হলেও পৃথিবীর সৌন্দর্য, প্রকৃতির রঙ ও স্বপ্নের ধারা অব্যাহত থাকে। কবিতার মাধ্যমে তিনি জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে এই চিরন্তন সম্পর্ককে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
সারসংক্ষেপেঃ কবি বলছেন: মানুষ চলে গেলেও পৃথিবী, প্রকৃতি এবং তার গল্প চিরকাল বেঁচে থাকে। সভ্যতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিন্তু প্রকৃতির রূপ, রস, সৌন্দর্য এবং জীবনধারার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে। প্রকৃতির মধ্য দিয়ে মানুষের স্বপ্ন ও গল্প চিরকাল চলতে থাকে।
সেইদিন এই মাঠ কবিতার ব্যাখ্যা
সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি-
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন-
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে।
কবিতার এই লাইনে কবি জীবনের ক্ষণস্থায়ীতা এবং প্রকৃতির চিরস্থায়ীত্ব একসাথে তুলে ধরেছেন। কবির বিদায়ের দিন, যখন মাঠ নীরব হয়ে যাবে না। তখন মানুষ আর সেখানে খেলাধুলা, আনন্দ বা প্রফুল্লতা আগের মতই থাকবে। মাঠের সেই প্রাণবন্ততা, চঞ্চলতা স্তব্ধ হয়ে যাবে না।
পরের লাইনে, “এই নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন” কবি বলছেন, নদী তখনও থাকবে, তার জলচরে নক্ষত্রের আলো প্রতিফলিত হবে, এবং প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য মানুষের চোখে নতুনভাবে স্বপ্নের মতো উদ্ভাসিত হবে। নদী তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যে থাকবে, কিন্তু কবি হয়তো আর তা দেখতে পারবে না।
“সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে” এখানে কবি মানব জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের ক্ষণস্থায়ীত্ব উল্লেখ করেছেন। মানুষ চলে গেলে তার স্বপ্ন, তার আশা হয়তো আর পূর্ণ হবে না। কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে, নদী, মাঠ, ফুল, শিশির সবকিছু যুগে যুগে বেঁচে থাকবে, যা যেন মানুষের স্বপ্নের একটি অদৃশ্য আকার।
আমি চলে যাব বলে
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে?
এই লাইনে কবি মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে প্রকৃতির চিরস্থায়ী সৌন্দর্যের সম্পর্ক তুলে ধরছেন। “আমি চলে যাব বলে” এখানে কবি স্বীকার করছেন যে, একদিন তিনি আর থাকবেন না, তাঁর জীবন শেষ হবে। কিন্তু তার বিদায় মানে কি প্রকৃতির সৌন্দর্য, তার রহস্যময়তা বন্ধ হয়ে যাবে?
“চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে” কবির প্রশ্ন হল, আমি চলে গেলে কি শিশিরের জল আর ফুলের সঙ্গে খেলবে না? কি সেই ভিজা ফুলের সৌন্দর্য আর মানুষের চোখে আনন্দ সৃষ্টি করবে না? এখানে তিনি প্রকৃতির স্থায়ীত্বের ওপর জোর দিচ্ছেন। মানুষ চলে যায়, জীবন শেষ হয়, কিন্তু প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চিরকাল বেঁচে থাকে।
“নরম গন্ধের ঢেউয়ে”—শিশিরে ভেজা ফুলের সৌন্দর্য শুধু চোখে নয়, গন্ধে এবং বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই গন্ধ মানুষের মনের মধ্যে আনন্দ, স্বপ্ন ও প্রশান্তি সৃষ্টি করে। কবি ভাবছেন, যদিও সে চলে যাবে, প্রকৃতির এই সৌন্দর্য এবং মাধুর্য চিরকাল মানুষের অনুভূতিতে বেঁচে থাকবে।
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
“লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?” এখানে কবি ভাবছেন, যে ভালোবাসা, মমত্ব এবং প্রীতি প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান, তা কি অব্যাহত থাকবে? লক্ষ্মীপেঁচা তার সঙ্গী লক্ষ্মীটির জন্য গান গায়, ঠিক তেমনি প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং তার মধ্য দিয়ে জীবনের আনন্দ, প্রেম ও মমত্ব চিরস্থায়ী।।
“সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!” কবির এখানে অতীতের স্বপ্নময় সময়ের কথা মনে পড়ছে। মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা এবং সোনার মতো মূল্যবান আশা পৃথিবীতে কতটা বাস্তব হবে, তা অনিশ্চিত। তবে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে এই স্বপ্নের অনুরণন বা ছোঁয়া চিরকাল বেঁচে থাকে। মানুষ চলে গেলে, তার স্বপ্ন বা সাধ হয়তো পূর্ণ হবে না, কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং তার ছোঁয়া মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে জীবন্ত থাকে।
চারিদিকে শান্ত বাতি ভিজে গন্ধ মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
“চারিদিকে শান্ত বাতি ভিজে গন্ধ মৃদু কলরব” এখানে বোঝানো হয়েছে, চারপাশে একটি শান্তি, নীরবতা এবং মৃদু আনন্দের আবহ বিরাজ করছে। বাতাসে, মাঠে এবং নদীর তীরে যেন শান্ত আলো, শিশিরের কোমলতা এবং ফুলের নরম গন্ধ মিশে গেছে।
“খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে” এখানে নদীর জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। খেয়া নৌকা নদীর ধারে এসে থেমে গেছে, যেন প্রকৃতি ও মানুষের কাজকর্মের মধ্যকার সংযোগ বোঝাচ্ছে। মানুষের জীবন অস্থায়ী হলেও, নদী, নৌকা, চর, বাতাস, ফুল সবকিছু চিরকাল জীবন্ত থাকে। প্রকৃতির এই ধারাবাহিকতা মানুষের জীবন ও স্বপ্নের সঙ্গে মিলেমিশে চিরকাল বাঁচে।
পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;
এশিরিয়া ধুলো আজ বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
এই লাইনে কবি মানুষের ইতিহাস ও সভ্যতার ক্ষণস্থায়ীতা এবং প্রকৃতির চিরস্থায়ী সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। “পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল” এখানে কবি বলতে চাচ্ছেন, মানুষের কর্মকাণ্ড, গল্প, স্বপ্ন ও সংগ্রামের প্রভাব কিছু সময়ের জন্য হলেও স্মৃতিতে এবং প্রকৃতির মধ্যে বেঁচে থাকে। যদিও মানুষ চলে যায়, তার জীবনের কাহিনি, অনুভূতি ও সৃষ্টিশীলতা পৃথিবীতে একটি ছাপ রেখে যায়।
“এশিরিয়া ধুলো আজ বেবিলন ছাই হয়ে আছে” এখানে অতীতের মহান সভ্যতা যেমন এশিরিয়া বা ব্যাবিলন, এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে তা দেখানো হয়েছে। মানুষ কত বড় সভ্যতা গড়লেও সময়ের সাথে তা বিলীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য, নদী, মাঠ, ফুল, বাতাস সবকিছু ধ্বংস বা মৃত্যু দ্বারা বিনষ্ট হয় না। প্রকৃতি চিরকাল প্রাণময় থাকে।
আরও পড়ুনঃ যাব আমি তোমার দেশে কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা