আবুল কাসিম ফেরদৌসির ‘যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাপুত্র’ গল্পটি অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ও তীব্র আবেগের সঙ্গে লেখা। এই গল্পে সোহরাব এবং তাঁর পিতা মহাবীর রুস্তমের মধ্যকার যুদ্ধের করুণ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এই পোস্টে ৭ম শ্রেণির আনন্দপাঠের যুদ্ধক্ষেত্রে পিতা পুত্র মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
যুদ্ধক্ষেত্রে পিতা পুত্র মূলভাব
ফেরদৌসির লেখা মহাকাব্য ‘শাহনামা’ থেকে নেওয়া মূল ভাব নিয়ে এই গল্পটি তৈরি হয়েছে। ইরানের পাশের এক শান্তিপ্রিয় দেশ সামনগারের রাজকন্যা তহমিনাকে বিয়ে করেছিলেন মহাবীর রুস্তম। বিয়ের কিছুদিন পরেই রুস্তম আবার নিজের দেশ ইরানে ফিরে যান। এরপর তহমিনার ঘরে রুস্তমের এক ছেলে সন্তান জন্ম নেয়, যার নাম রাখা হয় সোহরাব। কিন্তু তহমিনা ভয় পান—যদি রুস্তম জানতে পারেন যে তাঁর একটি ছেলে হয়েছে, তাহলে তিনি ছেলেকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাবেন। এই ভয়ে তিনি রুস্তমকে ভুল খবর দেন যে, তাদের একটি কন্যাসন্তান হয়েছে।
সোহরাব নিজের পিতা মহাবীর রুস্তমকে খুঁজতে যুদ্ধের সাজ সাজিয়ে তুরান আর ইরানের যুদ্ধে যোগ দেয়। সে পিতাকে পেলে সব ক্রোধ ভুলে গিয়ে শান্তি পাবে ভেবেছিল। কিন্তু পিতাকে খুঁজতে গিয়ে সে জানতে পারে রুস্তম হয়তো জাবলুস্তানে চলে গেছেন এবং যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন না। তবুও সোহরাব বিশ্বাস রাখে যে সেই বীরই তার পিতা। দুইজন একে অপরকে চিনতে না পেরে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা শক্তি আর বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ চালায়। শেষ পর্যন্ত সোহরাব রুস্তমকে আহত করে কিন্তু পিতার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রেখেই যুদ্ধ থামায়। রুস্তমও শেষ পর্যন্ত নিজের পুত্রকে চিনে নেয়। কিন্তু তাদের যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে সোহরাব প্রাণ হারায়। মৃত্যুর আগে সে পিতাকে বলে, সে তার পিতা এবং তার সাথে মিথ্যা করবেন না। রুস্তম গভীর দুঃখ আর অনুশোচনায় ভুগে, নিজের ভুল বুঝতে পারে। সোহরাবের মৃত্যুর মাধ্যমে গল্পে পিতা-পুত্রের বিচ্ছেদ, যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা ও মানব সম্পর্কের মূল্য বোঝানো হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে পিতা পুত্র গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১। ক. রুস্তম নিজের আত্মপরিচয় গোপন রাখেন কেন? | ৩ |
খ. “এক করুণ ভুল বোঝাবুঝি জীবনে বয়ে আনতে পারে চরম মানবিক বিপর্যয়”- ব্যাখ্যা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ রুস্তম নিজের আত্মপরিচয় গোপন রেখেছিলেন কারণ, তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। তখন তিনি একা ভ্রমণ করছিলেন এবং সাধারণ একজন সৈনিকের মতোই আচরণ করছিলেন। তিনি জানতেন না যে, যাকে তিনি যুদ্ধের জন্য চ্যালেঞ্জ করেছেন, সে-ই তার নিজের ছেলে। রুস্তম মনে করেছিলেন, যদি নিজের পরিচয় জানান, তাহলে হয়তো যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে বা অন্যরকম কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এছাড়া যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী তিনি পরিচয় গোপন রাখাই শ্রেয় মনে করেছিলেন। রুস্তম ছিলেন একজন সম্মানিত যোদ্ধা, তাই তিনি ভাবলেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে পরিচয় না দিয়েই যুদ্ধ করা ভালো। আবার যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের নাম বললে অনেক সময় দুর্বলতা প্রকাশ পায়—এই ভাবনাও থাকতে পারে। এ ছাড়া রুস্তম মনে করতেন, তিনি যদি সাধারণ পরিচয়ে যুদ্ধ করেন, তাহলে তা হবে তাঁর সাহসিকতার প্রমাণ।
খ) উত্তরঃ সোহরাব একটি বীর চরিত্র। সে ছিল পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসা তুরান দেশের এক তরুণ ও সাহসী যোদ্ধা। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল অত্যন্ত বলবান ও নির্ভীক। তার শরীরে অসীম শক্তি ছিল, যা দেখে সবাই অবাক হতো। সোহরাবের মধ্যে ছিল এক ধরনের আত্মবিশ্বাস, যা তাকে বড় বড় যুদ্ধে অংশ নিতে সাহস জুগিয়েছিল। সে কখনও নিজের শক্তির অপব্যবহার করত না, বরং সততা ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করত।
সোহরাব ছিল অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ এবং নিজের দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধের মাঠে সে কখনো পিছিয়ে যেত না, বরং প্রতিপক্ষকে সম্মানের সঙ্গে মোকাবিলা করত। সে চেয়েছিল রুস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে প্রমাণ করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে জানত না, রুস্তমই তার বাবা।
তার চরিত্রে ছিল সরলতা ও আবেগ। যখন সে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে জানতে পারে রুস্তম তার পিতা, তখন সে ভীষণ কষ্ট পায় কিন্তু কোনো ঘৃণা প্রকাশ করে না। বরং সে বাবাকে ভালোবেসে ক্ষমা করে দেয় এবং চায় রুস্তম যেন তুরান সৈন্যদের কষ্ট না দেন। এই মানবিক গুণই সোহরাবকে একটি মহৎ চরিত্রে পরিণত করেছে। তার মৃত্যু কেবল একটি তরুণ বীরের পতন নয়, বরং এক করুণ ভুল বোঝাবুঝির প্রতীক।
প্রশ্ন ২। ক. ক. সোহরাব ইরানে গিয়েছিল কেন? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. ‘বাস্তবিকই মানুষ বড় অসহায় নিয়তির লীলার কাছে।’-‘যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাপুত্র’ গল্পের আলোকে আলোচনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ সোহরাব ইরানে গিয়েছিল নিজের বাবাকে খুঁজে বের করার আশায়। সে জানত না তার বাবা কে, তবে তার মনে বিশ্বাস ছিল যে তার বাবা ইরানে আছেন। তাই সত্য জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই সে যুদ্ধের অজুহাতে ইরানে গিয়েছিল। সে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়নি, বরং তার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের সেনাপতিদের সঙ্গে দেখা করা এবং তার বাবার খোঁজ নেওয়া। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে সে বুঝতেই পারেনি যে রুস্তমই তার পিতা। কেউ তাকে এই সত্য বলেনি। এমনকি রুস্তমও সত্য গোপন রেখেছিল। ফলে, অজান্তেই সে নিজের বাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায়। বাবাকে খোঁজার এই পথই তাকে নিজের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাই বলা যায়, সোহরাব ইরানে গিয়েছিল বাবাকে খুঁজতে, কিন্তু ভাগ্য তাকে এমন এক ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়, যেখানে সে নিজের পিতার হাতেই নিহত হয়।
খ) উত্তরঃ নুষ নিজের ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনা করতে চায়, কিন্তু সব সময় তা সম্ভব হয় না। অনেক সময় নিয়তি এমনভাবে ঘটনাকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়, যা মানুষের কল্পনারও বাইরে। ‘যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাপুত্র’ গল্পে রুস্তম ও সোহরাব—দুই বীর চরিত্র একে অপরের অস্তিত্ব না জেনেই মুখোমুখি হয়। রুস্তম জানতেন না সোহরাব তার নিজেরই পুত্র। আর সোহরাবও জানত না, যার সঙ্গে সে যুদ্ধ করছে, সে-ই তার জন্মদাতা পিতা। এই অজানা সম্পর্কের কারণেই ঘটে যায় এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।
রুস্তম ভুল করে নিজের ছেলেকে হত্যা করেন। আর যখন সত্যিটা জানেন, তখন আর কিছু করার থাকে না—সন্তান মারা গেছে। এটাই নিয়তির নির্মমতা। তারা যদি একে অপরের পরিচয় আগে জানতেন, তাহলে এই মর্মান্তিক পরিণতি হতো না। এই গল্প আমাদের বোঝায় যে, মানুষ নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অনেক সময় ভালো উদ্দেশ্য নিয়েও মানুষ এমন ভুল করে, যার পরিণতি হয় ভয়ংকর। নিয়তির খেলায় মানুষের সাহস, শক্তি, মেধা সবই বৃথা হয়ে যায়। তাই বলা হয়—মানুষ সত্যিই অসহায় নিয়তির লীলার কাছে।
প্রশ্ন ৩। ক. রুস্তম কীভাবে তাঁর জীবন রক্ষা করেন? | ৩ |
খ. ‘যুদ্ধক্ষেত্রে পিতাপুত্র’ গল্পের মূলভাব আলোচনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ রুস্তম নিজের ছেলেকে চিনতে না পেরে তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। প্রথমে সোহরাব রুস্তমকে মাটিতে ফেলে দেয়, কিন্তু রুস্তম কৌশলে বলে, ইরানে নিয়ম আছে, একদিনে দু’বার হত্যা করা যায় না—এ কথা বিশ্বাস করে সোহরাব তাকে ছেড়ে দেয়। এই সুযোগে রুস্তম শক্তি ফিরে পেয়ে পরদিন আবার যুদ্ধ করে এবং কৌশলে সোহরাবকে মারাত্মক আঘাত করে। এতে সোহরাব মৃত্যুশয্যায় পড়ে যায় এবং তখন সে নিজের পরিচয় দেয়। রুস্তম তখন জানতে পারেন, তিনি নিজের ছেলেকেই হত্যা করেছেন। এইভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে রুস্তম নিজের জীবন রক্ষা করেন, তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে গভীর অনুশোচনায় ভুগতে হয়।
খ) উত্তরঃ উপরে লেখা আছে।