মুক্তি গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর- আনন্দপাঠ ৮ম শ্রেণি

‘মুক্তি’ গল্পটি অ্যালেক্স হ্যালির ‘Roots’ উপন্যাসের অনুপ্রেরণায় রচিত যার বাংলা অনুবাদে কুন্টা কিন্তে নামের আফ্রিকান যুবকের বন্দিত্ব, বিক্রি হওয়া এবং পালাবার তীব্র মানসিক লড়াইকে তুলে ধরা হয়েছে। এই পোস্টে ৮ম শ্রেণির আনন্দপাঠ বইয়ের মুক্তি গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

মুক্তি গল্পের মূলভাব (অ্যালেক্স হ্যালি)

অ্যালেক্স হ্যালির ‘মুক্তি’ গল্পে আফ্রিকার যুবক কুন্টা বন্দি হয়ে আমেরিকায় দাস হিসেবে বিক্রি হয়। সাদা মানুষরা তাকে ধরে এক নৌকায় করে এনে বাজারে তোলে। তাকে এবং আরও কিছু বন্দিকে কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় যেন পশুর হাটে তোলা হয়েছে। একে একে তাদের শরীর ছুঁয়ে, গঠন দেখে দাম হাঁকা হয়। কুন্টাকে সাড়ে আটশো ডলারে একজন কিনে নেয়। এরপর তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে গাড়িতে করে একটি সাদা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে সে দেখে সাদা মানুষের চাষাবাদ, বাড়িঘর, শিশু ও পশুপাখি। কিন্তু আশ্চর্যভাবে তার মতোই কিছু কালো মানুষ সাদা মানুষের সাহায্য করছে এবং কুন্টাকে বিদ্রূপ করছে। এদের আচরণে কুন্টা প্রচণ্ড ঘৃণা অনুভব করে। রাতে তাকে একটি খুঁটির সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, খাবার দেওয়া হলেও সে খায় না। কুন্টা পালাবার সুযোগ খোঁজে, কিন্তু কুকুর, আলো আর পাহারার জন্য ব্যর্থ হয়। পরদিন আবার গাড়িতে তোলা হয়। সে বুঝতে পারে নিজের জাতভাইয়েরাও তাকে সাহায্য করবে না। একসময় এক কালো গাড়িচালক তাকে রূঢ়ভাবে আচরণ করে। তখন কুন্টা তার গলা চেপে ধরে হত্যা করে পালিয়ে যায়। শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও সে দৌড়ায়, কারণ তার লক্ষ্য একটাই—মুক্তি। এই গল্পে দাসপ্রথার নিষ্ঠুরতা, স্বাধীনতার মূল্য এবং মানবিক মর্যাদার জন্য লড়াই ফুটে উঠেছে।

মুক্তি গল্পের বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন ১। ক. “তার প্রতি কুন্টার অনুনয়পূর্ণ চাহনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো।”- কার প্রতি? কেন? ব্যাখ্যা কর।
খ. ‘মুক্তি’ গল্পে দাস ব্যবস্থার যে নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বর্ণনা কর।

ক) উত্তরঃ উক্ত বাক্যে “তার প্রতি” বলতে বোঝানো হয়েছে সেই কালো লোকটিকে, যে কুন্টাকে শিকল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কুন্টা আশা করেছিল, যেহেতু লোকটি তার মতোই একজন কৃষ্ণাঙ্গ, তাই সে হয়তো তার দুঃখ বুঝবে এবং সহানুভূতি দেখাবে। কিন্তু বাস্তবে কুন্টার সেই আশা ব্যর্থ হয়। লোকটি একেবারে নির্লিপ্তভাবে, অমানবিকভাবে কুন্টাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। তার চোখে-মুখে কোনো দয়া বা সহানুভূতির চিহ্ন ছিল না। এতে বোঝা যায়, সাদা মানুষদের দ্বারা শোষিত হয়ে অনেক কালো মানুষও তাদের দাসত্ব মেনে নিয়ে নিজেদের স্বজাতির বিরুদ্ধেই কাজ করছিল। এই আচরণ কুন্টার মনে ক্ষোভ ও ঘৃণা জাগায়। সে বুঝতে পারে, এখানকার কালো লোকেরা তার মতো মুক্ত মানুষের মতো না, তারা পরাধীন হয়ে গেছে। এ কারণে কুন্টার অনুনয়ভরা দৃষ্টিও কোনো কাজে আসেনি।

খ) উত্তরঃ ‘মুক্তি’ গল্পে লেখক অ্যালেক্স হ্যালি দাসপ্রথার এক নির্মম ও হৃদয়বিদারক চিত্র তুলে ধরেছেন। কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে কুন্টা নামের একজন তরুণ আফ্রিকান, যাকে জোর করে বন্দি করে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। তাকে পশুর মতো বাজারে দাঁড় করিয়ে শরীর দেখে দাম হাঁকা হয়। মানুষ নয়, তাকে যেন পণ্য হিসেবে দেখা হয়। সাদা মানুষেরা কুন্টাকে কেনাবেচা করে এবং তার শরীর পরীক্ষা করে পছন্দ করে নেয়। শিকলে বাঁধা অবস্থায় কুন্টাকে গাড়িতে তোলা হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়। পথে সে দেখে কিছু কালো মানুষ, যারা সাদা মানুষের কাজ করে এবং নিজেদের স্বজাতিকে বিদ্রূপ করে। এটি দাসপ্রথার আরেক নিষ্ঠুর দিক—মানুষের মানসিক দাসত্ব। কুন্টার প্রতি কোনো সহানুভূতি না দেখিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার খাওয়া-ঘুম সবই নিয়ন্ত্রিত হয় শিকল দিয়ে। পালাতে চাইলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। কুন্টা গভীর ভয়, লজ্জা, অপমান আর ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে পড়ে। একসময় সে সুযোগ পেয়ে এক দাস-চালককে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এই পালানোর মধ্যেই তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়। পুরো গল্প জুড়ে বারবার বোঝানো হয়েছে, দাসেরা কেমন অমানবিক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতো। কুন্টার মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক যন্ত্রণা আমাদের দাসপ্রথার অমানবিকতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, আর দাসত্ব একটি ভয়ংকর অপরাধ।


প্রশ্ন ২। ক. “সে তার মুখ ফিরিয়ে নিল।”- কে? কেন? ব্যাখ্যা কর।
খ. “কুন্টার মধ্যে জাতিগত ও বর্ণগত নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার তীব্র বাসনা প্রকাশিত হয়েছে।” মন্তব্যটির সত্যতা যাচাই কর।

ক) উত্তরঃ “সে তার মুখ ফিরিয়ে নিল”—এখানে ‘সে’ বলতে বোঝানো হয়েছে কুন্টাকে। গল্পে দেখা যায়, গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায় কালো গাড়িচালক কুন্টাকে একটুকরো রুটি দিতে চেয়েছিল। তখন কুন্টার খুব খিদে থাকলেও সে রুটি নিতে অস্বীকার করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ, সে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ ছিল। নিজের মতো আরেকজন কালো মানুষও তাকে সাহায্য না করে সাদা মানুষের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে—এটা কুন্টা মেনে নিতে পারে না। তার মনে হয়, এই লোকটি নিজের জাত ভুলে শত্রুর হয়ে কাজ করছে। তাই কুন্টা প্রতিবাদের চিহ্ন স্বরূপ খাবার গ্রহণ করেনি। এতে তার আত্মসম্মানবোধ এবং স্বাধীনতার প্রতি তার দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ পায়। সে জানে, খাবার নিলে সে দুর্বলতা দেখাবে, আর সে দুর্বল হতে চায় না।

খ) উত্তরঃ “কুন্টার মধ্যে জাতিগত ও বর্ণগত নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার তীব্র বাসনা প্রকাশিত হয়েছে”—এই মন্তব্য পুরোপুরি সত্য। গল্পের শুরু থেকেই কুন্টাকে জোর করে বন্দি করে আমেরিকায় আনা হয়, যেখানে তাকে পশুর মতো বিক্রি করা হয়। সাদা মানুষদের অত্যাচার, অপমান এবং শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা—সবই তাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত দেয়। কুন্টা নিজের মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে খুব ভালোভাবে বোঝে। তাই সে প্রথম দিন থেকেই পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকে। শিকল দিয়ে বাঁধা থাকলেও তার মন এক মুহূর্তের জন্যও দাসত্ব মেনে নেয় না। এমনকি যখন তাকে খাবার দেওয়া হয়, তখনও সে প্রতিবাদ স্বরূপ মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে বারবার ভাবে, তাকে কেন বিক্রি করা হলো, কেন তার নিজের জাতভাইয়েরা তাকে সাহায্য করছে না। এসব প্রশ্ন তার মনে ক্ষোভ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কালো লোকগুলো যখন বিদ্রূপ করে, তখন সে আরও গভীর কষ্ট পায়। গল্পের শেষ দিকে সে সাহস করে এক দাসচালককে হত্যা করে পালিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে তার শরীর দুর্বল হলেও মানসিক শক্তি ছিল প্রবল। এই ঘটনাই প্রমাণ করে—কুন্টা কেবল শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলতে চায়। তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল অদম্য। ফলে এই মন্তব্য যে কুন্টার মধ্যে জাতিগত ও বর্ণগত নিপীড়ন থেকে মুক্তির তীব্র বাসনা ছিল, তা পুরোপুরি সত্য ও যথার্থ।


প্রশ্ন ৩। ক. চারদিকের লোকজন এগিয়ে এসে কুন্টার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছিল কীসের জন্য? বুঝিয়ে লেখ।
খ. “তরুণ কুন্টা তার বুদ্ধি, সাহস ও শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে।” উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

ক) উত্তরঃ চারদিকের লোকজন কুন্টার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করছিল, কারণ তারা তাকে একজন দাস হিসেবে কিনতে চাচ্ছিল। দাস কেনাবেচার বাজারে কুন্টার শরীর, স্বাস্থ্য, শক্তি এবং সক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছিল যেন সে কাজ করার উপযুক্ত কি না, তা বোঝা যায়। তারা তাকে মানুষ হিসেবে নয়, বরং একটি কাজের যন্ত্র বা পণ্য হিসেবে দেখছিল। তাই তার শরীরের মাংসপেশি, দাঁত, গঠন সবকিছু স্পর্শ করে দেখে দাম হাঁকছিল। এভাবে তাকে পণ্যর মতো ব্যবহার করা হয়েছিল। কুন্টার জন্য এটি ছিল অত্যন্ত অপমানজনক ও কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা। এতে বোঝা যায়, দাসপ্রথায় মানুষের প্রতি কতটা অমানবিক ব্যবহার করা হতো। কুন্টা একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল এই নির্লজ্জ আচরণে।

খ) উত্তরঃ “তরুণ কুন্টা তার বুদ্ধি, সাহস ও শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে”—এই উক্তিটি পুরো গল্পজুড়ে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। কুন্টা ছিল একজন স্বাধীন আফ্রিকান যুবক, যাকে জোর করে ধরে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। সাদা মানুষরা তাকে শিকলে বেঁধে, অপমান করে, পশুর মতো ব্যবহার করে। এত কিছুর পরেও কুন্টা ভেঙে পড়ে না। বরং সে সুযোগ খুঁজতে থাকে পালানোর, কারণ তার মনে ছিল তীব্র মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সে জানত, তাড়াহুড়া করলে ধরা পড়বে, তাই ধৈর্য ধরে সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। শেষ পর্যন্ত যখন এক কালো দাসচালক তাকে টানতে টানতে নামাতে আসে, তখন কুন্টা নিজের সাহসিকতা ও শারীরিক শক্তি দিয়ে তাকে আক্রমণ করে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে তার গলা চেপে ধরে এবং তাকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। তারপর কুন্টা শিকল থেকে মুক্ত হয়ে জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে থাকে। শরীর দুর্বল থাকলেও মনের জোর ছিল অটুট। সে জানত, এই ঝুঁকি তার জীবন নিতে পারে, তবুও সে দমে যায়নি। নিজের বুদ্ধি, ধৈর্য, সাহস ও শারীরিক ক্ষমতা দিয়েই সে দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে, কুন্টা শুধুই একজন সাধারণ বন্দি নয়, বরং একজন সংগ্রামী যুবক। তার শক্তি, সাহস ও মুক্তির ইচ্ছাই তাকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত করেছে। তাই এই উক্তিটি একদম সঠিক ও যথার্থ।


Related Posts

Leave a Comment