শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’ আসলে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার কবিতা। একজন মানুষের জীবনে মা-বাবা, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ এরা কতটা মূল্যবান, সেই কথাটাই কবি আমাদের মনে করিয়ে দেন। এই পোস্টে বন্দনা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লিখে দিলাম।
Table of Contents
বন্দনা কবিতার মূলভাব
শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’ কবিতায় কবি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জীবনের শ্রদ্ধেয় মানুষদের কথা বলেছেন। তিনি প্রথমেই আল্লাহর পরে তাঁর মা-বাবাকে প্রণাম জানান। কারণ তাঁর জন্ম হয়েছে মা-বাবার দয়ার ফলেই। কবি বলেন, তিনি ছোটবেলায় এতটাই দুর্বল ছিলেন যে চলাফেরা পর্যন্ত করতে পারতেন না। তখন তাঁর মা তাঁকে বুকের মধ্যে আগলে রাখতেন, এমনকি পিঁপড়ে কামড়াবে বলে মাটিতেও রাখতেন না। মা-ই তাঁকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন। বাবা নিজের কষ্টে দিন কাটিয়ে, না খেয়ে খাইয়ে, না পরে পরিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন। কবি বুঝতে পেরেছেন, বাবা-মা কত কষ্ট করে সন্তানকে বড় করেন। এরপর কবি ওস্তাদ বা শিক্ষকের কথা বলেন, যিনি জ্ঞান দিয়ে কবিকে মানুষের মতো গড়ে তুলেছেন। তাই শিক্ষকও বাবার মতো সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তিনি শহরের সকল মানুষ, আত্মীয়, বন্ধুদের প্রতিও শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানান। কবি চান, সকলে তাঁর জন্য দোয়া করুন যেন তিনি সঠিক পথে চলতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা, তিনি যেন কবিতা রচনায় সফল হন। শেষে তিনি বলেন, তিনি একজন পাপী মানুষ হলেও সবার কাছে বিনয়ের সঙ্গে দোয়া প্রার্থনা করছেন। কবিতাটি থেকে বোঝা যায়, কৃতজ্ঞতা ও বিনয় মানুষের প্রধান গুণ।
বন্দনা কবিতার ব্যাখ্যা
“দ্বিতীয়ে প্রণাম করো মাও বাপ পাএ।”
এই পঙক্তিতে কবি বলছেন—আল্লাহর পরেই প্রণাম বা শ্রদ্ধা জানানো উচিত মা ও বাবাকে। মা-বাবা সন্তানকে জন্ম দেন, লালন-পালন করেন, কষ্ট সহ্য করে বড় করেন। তাই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো একজন সন্তানের পবিত্র কর্তব্য। কবির এই কথার মধ্যে আছে আমাদের পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক—পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা।
“যান দয়া হস্তে জন্ম হৈল বসুধায়।”
এখানে কবি বলছেন, মা-বাবার দয়ায় বা করুণায় এই পৃথিবীতে তাঁর জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছায় হলেও, মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের জন্মের জন্য মা-বাবার কাছে ঋণী। এই জন্মই আমাদের জীবনের শুরু, তাই জন্মদাতাদের ভুলে গেলে চলবে না।
“পিপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত।”
এই লাইনটি মায়ের ভালোবাসার অসীমতা বোঝায়। কবি বলছেন, মা এতটাই স্নেহময়ী ছিলেন যে সন্তানের গায়ে পিঁপড়া যেন না কামড়ায়, তাই তিনি সন্তানকে মাটিতে পর্যন্ত রাখতেন না। মা সবসময় বুকের কাছে আগলে রাখতেন। এটি এক মমতাময় ছবির মতো—যেখানে মা সন্তানের নিরাপত্তার জন্য সদা সতর্ক।
“কোল দিআ বুক দিআ জগতে বিদিত।”
মা সন্তানের যত্ন করেছেন নিজের কোল দিয়ে, বুক দিয়ে। এই মাতৃত্বের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পুরো পৃথিবীতে পরিচিত বা বিদিত। অর্থাৎ মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসা বিশ্বজনীন—সব সংস্কৃতিতে তা মহান হিসেবে স্বীকৃত।
“অশক্য আছিলু মুই দুর্বল ছাবাল।”
এই পঙক্তিতে কবি নিজের শৈশবের দুর্বলতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, তিনি তখন একেবারেই অক্ষম ও দুর্বল একটি শিশু ছিলেন—নিজের কোনো কাজ নিজে করতে পারতেন না। এটি মানব জীবনের শৈশবের বাস্তব চিত্র।
“তান দয়া হস্তে হৈল এ ধড় বিশাল।”
মা-বাবার দয়ায়, ভালোবাসায় এবং স্নেহময় যত্নে সেই দুর্বল শিশুটি আজ শক্তিশালী, বড় মানুষ হয়েছে। তাই কবি বোঝাতে চেয়েছেন, একজন মানুষের বেড়ে ওঠার পেছনে পিতামাতার অবদান কতখানি গভীর।
“না খাই খাওয়াএ পিতা না পরি পরাএ।”
এই লাইনে বাবা সম্পর্কে বলা হয়েছে। কবি জানাচ্ছেন, তাঁর বাবা নিজে না খেয়ে ছেলেকে খাইয়ে দিয়েছেন, নিজে না পরে ছেলেকে কাপড় পরিয়েছেন। এভাবেই এক পিতার আত্মত্যাগের ছবি তুলে ধরেছেন কবি।
“কত দুক্ষে একে একে বছর গোঞাএ।”
পিতা-মাতা কষ্ট করে, দুঃখ সহ্য করে একের পর এক বছর পার করেছেন সন্তানকে বড় করার জন্য। তারা নিজেরা শান্তিতে না থেকেও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জীবন কাটিয়েছেন। এই কথাগুলো আমাদের কৃতজ্ঞ হতে শেখায়।
“পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন।”
পিতা তাঁর জীবনের সেরা সময়—তার যৌবন ও শক্তি—সবই সন্তানের পেছনে ব্যয় করেছেন। এটি বাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পরিচয়, যা সন্তানরা অনেক সময় বুঝেও বুঝতে চায় না।
“কনে বা সুধিব তান ধারক কাহন।”
এখানে কবি আফসোস করে বলছেন—এই বাবা-মায়ের এই ত্যাগের ঋণ কে শোধ করতে পারে? কখনো কি কেউ ভাবেও এই ঋণের কথা? কেউ কি তাঁদের এই ‘ধার’ বা ঋণের মূল্য দিতে পারে? না, সেটা অসম্ভব।
“ওস্তাদে প্রণাম করোঁ পিতা হস্তে বাড়।”
শিক্ষক বা ওস্তাদকেও কবি প্রণাম জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, শিক্ষক পিতার মতোই সম্মানিত। কেননা শিক্ষক আমাদের অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে জ্ঞান দিয়ে জীবন গড়ে তোলেন।
“দোসর-জনম দিলা তিহ সে আহ্মার।”
এই পঙক্তিতে কবি বলেন, যেমন মা-বাবা তাঁকে দেহ দিয়েছেন, তেমনি শিক্ষক তাঁকে জ্ঞান দিয়ে নতুন জীবন দিয়েছেন। তাই শিক্ষক হচ্ছেন দ্বিতীয় জনক বা ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’।
“আহ্মা পুরবাসী আছ জথ পৌরজন।”
এখানে কবি তাঁর নগরের মানুষ, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত সকলজনের উদ্দেশ্যে বলছেন—তোমরা আমার পাশেই আছো, আমি তোমাদের ভালোবাসি, সম্মান করি।
“ইষ্ট মিত্র আদি জথ সভাসদগণ।”
কবি তাঁর বন্ধু, আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী, এবং সব কাছের মানুষদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাচ্ছেন। সবাইকে সম্মান জানানোই তাঁর বিনয়ী মনোভাব প্রকাশ করে।
“তান সভান পদে মোহার বহুল ভকতি।”
এই লাইনটিতে কবি জানাচ্ছেন, তিনি সবার পদে বা পায়ে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। তাঁর মনের গভীর থেকে তিনি সবাইকে সম্মান করতে চান।
“সপুটে প্রণাম মোহার মনোরথ গতি ॥”
কবি হাত জোড় করে সবাইকে প্রণাম করছেন এবং বলছেন—এই শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যেই তাঁর মনের ইচ্ছা বা মনোরথ পূরণ হবে। তাঁর উদ্দেশ্য সৎ, তাই তিনি প্রার্থনা করছেন।
মুহম্মদ সগীর হীন বহোঁ পাপ ভার।”
কবি নিজেকে খুব সাধারণ ও পাপী মানুষ মনে করেন। তিনি বিনম্রভাবে স্বীকার করছেন—তিনি ত্রুটিমুক্ত নন, তাই সবার দোয়া তাঁর দরকার।
“সভানক পদে দোয়া মাগোঁ বার বার॥”
শেষ লাইনে কবি আবারও সবার কাছে বারবার দোয়া চেয়েছেন। যেন তাঁর কাব্য রচনায় সাফল্য আসে এবং তিনি ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ