ফিলিস্তিনের চিঠি গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর

‘ফিলিস্তিনের চিঠি’ গল্পটি শুধু বন্ধুর কাছে লেখা চিঠি নয়, বরং একটি দেশের আত্মজিজ্ঞাসার দলিল। লেখকের সিদ্ধান্ত—দেশ না ছেড়ে থেকে যাওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে এক বিপ্লবী আত্মত্যাগ ও জাতিগত দায়বদ্ধতা। এই পোস্টে ৮ম শ্রেণির আনন্দপাঠের ফিলিস্তিনের চিঠি গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

ফিলিস্তিনের চিঠি গল্পের মূলভাব

‘ফিলিস্তিনের চিঠি’ গল্পটি একজন ফিলিস্তিনি যুবকের মনের দ্বন্দ্ব ও স্বদেশপ্রেমের কাহিনি। গল্পটি লেখা হয়েছে চিঠির আকারে, যার প্রাপক লেখকের বন্ধু মুস্তাফা। মুস্তাফা উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে চলে গেছে এবং লেখককেও প্রবাসে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। লেখক প্রথমে কুয়েতে যান এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান। কিন্তু তার মনের মধ্যে সবসময় একটি অস্বস্তি কাজ করে। সে ভাবে, সবাই যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন সে কেন যাবেনা? কেন যাবেনা তার জন্মভূমি ছেড়ে? লেখক জানত, তার পরিবার কষ্টে আছে, তাই প্রবাসে থেকে উপার্জন করে তাদের সাহায্য করত। কিন্তু একদিন ছুটিতে দেশে ফিরে সে জানতে পারে, তার ভাইঝি নাদিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাদিয়ার মুখ দেখে তার ভেতরের সব টান আবার জেগে ওঠে। সে বুঝতে পারে, শুধু নিজের সুখের জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। নাদিয়ার চোখে সে দেখে এক নিঃশব্দ আর্তি, এক ভরসা। লেখক তার হাতে মিথ্যা উপহারের কথা বললেও সেই মিথ্যার ভিতরে ছিল ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতি। সে উপলব্ধি করে, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, নিজের মাটির জন্য তার থেকে যাওয়া দরকার। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর বিদেশে যাবে না। নিজের জন্মভূমিতে থেকেই সে লড়াই করবে। কারণ তার শেকড় এই ভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এ গল্প শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং গোটা ফিলিস্তিনি জাতির বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এটি আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের এক গভীর দলিল।

ফিলিস্তিনের চিঠি গল্পের বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন ১। ক. মুস্তাফার ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাওয়ার কারণ কী?
খ. “দেশ ও স্বজনের পাশে দাঁড়ানোই মানুষের প্রকৃত দায়িত্ব।”-‘ফিলিস্তিনের চিঠি’ গল্প অবলম্বনে আলোচনা কর।

ক) উত্তরঃ মুস্তাফা ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে গিয়েছিল ভালো জীবনের আশায়। নিজের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতেই সে এই সিদ্ধান্ত নেয়। ফিলিস্তিনের যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার মধ্যে সে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়নি। তাই সে চেয়েছিল এক নতুন দেশ, নতুন পরিবেশে গিয়ে নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে। মুস্তাফার মতে, ক্যালিফোর্নিয়া এক সবুজ-শ্যামল, সুন্দর মুখে ভরা দেশ—যেখানে সুখ আর সম্ভাবনা আছে। সে চেয়েছিল লেখককেও তার সঙ্গে নিয়ে যেতে, যাতে তারা একসঙ্গে উন্নত জীবন শুরু করতে পারে। মুস্তাফা চেয়েছিল অর্থ উপার্জন করে ফিলিস্তিনের কষ্টের জীবনকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনে পা রাখতে। সে কুয়েতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি পেয়ে সেই পরিকল্পনার পথে এগিয়েছিল। লেখকের কথায় বোঝা যায়, মুস্তাফা হয়তো পুরোপুরি সুখী ছিল না, তবুও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটাকেই সে বেছে নিয়েছিল। মুস্তাফার মতো অনেকেই তখন দেশের অবস্থা দেখে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছিল।

খ) উত্তরঃ ‘ফিলিস্তিনের চিঠি’ গল্পে লেখক প্রবাসে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও শেষ পর্যন্ত নিজ দেশ ফিলিস্তিনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি বুঝতে পারেন যে, নিজের সুখ আর স্বার্থের পেছনে না ছুটে, দেশের দুর্দিনে পাশে থাকাই একজন মানুষের প্রকৃত দায়িত্ব। লেখকের বন্ধু মুস্তাফা উন্নত জীবনের আশায় ক্যালিফোর্নিয়া চলে যায়। লেখকও শুরুতে সেই পথেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু যখন তিনি দেশে ফিরে তার ভাইঝি নাদিয়ার অসুস্থতার খবর পান, তখন তার হৃদয় কেঁপে ওঠে। তিনি হাসপাতালে গিয়ে নাদিয়ার মুখে কষ্টের ছাপ দেখেন। মেয়েটির চোখে ছিল একরাশ ভরসা, ভালোবাসা আর নির্ভরতা। সেই মুহূর্তে লেখকের মনে পড়ে যায় তার মা, ভাবি ও পরিবারের কথা। এই অনুভূতির জোরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন—তিনি আর দেশ ছাড়বেন না। কারণ এই যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনেই তার শেকড়, তার আত্মপরিচয়। সে বুঝতে পারে, নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকাই তার আসল কর্তব্য। শুধু নিজের স্বপ্ন নয়, নিজের জাতি, নিজের লোকজনের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও তার ওপর বর্তায়। লেখক উপলব্ধি করেন, দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু আবেগ নয়, তা হচ্ছে এক গাঢ় দায়িত্ববোধ। স্বজনদের দুঃখে পাশে দাঁড়ানো, অসহায় শিশুদের ভালোবাসা দেওয়া, আর দেশকে ভালোবেসে তার জন্য কিছু করা—এইসবই একজন প্রকৃত মানুষের কাজ। তাই এই গল্প প্রমাণ করে, ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং দেশ ও স্বজনের পাশে দাঁড়ানোই মানুষের প্রকৃত দায়িত্ব।


প্রশ্ন ২। ক. “আমি জানতাম কিছু একটা রহস্য আছে।”- এখানে কোন রহস্যের কথা বলা হয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
খ. লেখক তাঁর বন্ধু মুস্তাফাকে দেশে ফিরে আসতে বলেছেন কেন? বিশ্লেষণ কর।

ক) উত্তরঃ এই বাক্যে লেখক বুঝিয়েছেন, তার ভাইঝি নাদিয়ার হাসপাতালে ভর্তি থাকার পেছনে কোনো গভীর ঘটনা বা দুঃখজনক কারণ লুকিয়ে আছে। লেখক যখন দেশে ফিরে তার বাড়িতে যায়, তখন তার ভাবি খুব কাঁদছিলেন এবং নাদিয়ার কথা বলেছিলেন। লেখক বুঝতে পারেন, নাদিয়া শুধু অসুস্থ নয়, কোনো বড় বিপদের শিকার হয়েছে। কিন্তু আম্মা ও ভাবি বিষয়টি তাকে খোলাখুলি বলতে পারছিলেন না। তারা কোনো বিষয় গোপন করছিলেন, যেন মুখ ফুটে বলতেও পারছিলেন না। এই অনিশ্চয়তা থেকেই লেখকের মনে রহস্যের অনুভব তৈরি হয়। পরে হাসপাতালে গিয়ে লেখক দেখে, নাদিয়া আহত অবস্থায় শুয়ে আছে, চোখে জল। তার মুখে চাপা কষ্ট ও এক নিঃশব্দ আকুতি। তখন লেখক উপলব্ধি করেন, এই কষ্ট শুধু তার ভাইঝির নয়, বরং একটি গোটা প্রজন্মের—যারা বেড়ে উঠছে পরাজয় আর বাস্তুহীনতার মধ্যে। এই রহস্য ছিল সেই না বলা যন্ত্রণা, যে কষ্ট ভাষায় বলা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

খ) উত্তরঃ লেখক মুস্তাফাকে দেশে ফিরে আসার জন্য বলেছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের মানুষ এবং স্বজনদের পাশে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুস্তাফা যদিও উন্নত জীবনের খোঁজে বিদেশে গিয়েছিল, লেখক দেখেছিলেন তার নিজের দেশের পরিস্থিতি খুবই কঠিন। লেখকের মনে হয়েছিল, শুধু নিজের স্বার্থে দেশ ছেড়ে যাওয়া ঠিক নয়। বিশেষ করে যখন তার ভাইঝি নাদিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে, তখন তার হৃদয়ে দেশের প্রতি টান আরো বাড়ে। নাদিয়ার চোখে সে কষ্ট, ভরসা আর ভালোবাসা দেখতে পেয়ে লেখক বুঝতে পারেন যে, দেশের মানুষদের জন্য তার দায়িত্ব আছে। সে অনুভব করেন, দেশ ছেড়ে পালালে সে তার নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। দেশের সেবা করাই প্রকৃত মানুষ হওয়ার পরিচয়। তাই লেখক মুস্তাফাকে বলেন, জীবন যেখানে হোক, দেশের মানুষ ও পরিবারের জন্য লড়ে যেতে হবে। তিনি চান মুস্তাফা যেন বিদেশের সুন্দরের পেছনে না ছুটে, বরং ফিলিস্তিনের জন্য একসাথে কিছু করতে পারে। এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত স্বার্থের চাইতে দেশপ্রেম আর দায়িত্ববোধই বেশি মূল্যবান। দেশে ফিরে এসে তারা একসঙ্গে যুদ্ধ আর সংগ্রামে অংশ নেবে, যা ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। তাই লেখকের আহ্বান ছিল—দেশ ও স্বজনের পাশে দাঁড়ানোই মানুষের প্রকৃত দায়িত্ব।


প্রশ্ন ৩। ক. লেখকের কেন মনে হয়েছিল তিনি প্রথমবারের মতো পরম সত্য কথা বলেছেন?
খ. ‘ফিলিস্তিনের চিঠি’ গল্পের মূলভাব আলোচনা কর।

ক) উত্তরঃ লেখক যখন হাসপাতালে নাদিয়াকে দেখে, তখন সে তাকে অনেক উপহার দেওয়ার কথা বলছিল। সে জানত, আসলে এই সব উপহার দেওয়া মিথ্যে হবে, কারণ নাদিয়া তখন পুরোপুরি সুস্থ নয় এবং উপহারগুলো সে দিতে পারবে না। কিন্তু সে মিথ্যার মধ্যে দিয়ে এমন একটা কথা বলল যেটা তার অন্তরে সত্যি ছিল—নাদিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা আর যত্নের প্রকাশ। সেই সময় লেখকের মনে হলো, এই মিথ্যার ভেতরেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য লুকিয়ে আছে। কারণ সে আসলে প্রথমবার ঠিকই বুঝতে পারল তার দায়িত্ব আর ভালোবাসার গভীরতা। এই অনুভূতিটাই তাকে পরম সত্য বলে মনে হলো, যা আগে কখনো এত স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারেনি। নাদিয়ার চোখে কষ্ট দেখে ওর জন্যে প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে লেখকের হৃদয়ে সত্যিই একটি নতুন জাগরণ শুরু হয়। তাই সে মনে করল, এ মুহূর্তে সে জীবনের সবচেয়ে প্রকৃত সত্য কথা বলেছে।

খ) উত্তরঃ উপরে লেখা আছে ।


Related Posts

Leave a Comment