রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘নিরীহ বাঙালি’ প্রবন্ধটিতে লেখক বাঙালির ‘সুন্দর’, ‘নরম’, ‘সহজ’ এবং ‘কোমল’ স্বভাবের প্রতি আলোচনা করেছেন। তিনি বাঙালিকে একটি মূর্তিমতী কবিতা বলে মন্তব্য করেছেন এবং খাদ্য, পোশাক, এবং দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য দিক তুলে ধরেছেন। এই পোস্টে নিরীহ বাঙালি প্রবন্ধের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
নিরীহ বাঙালি প্রবন্ধের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
১। নিরীহ বাঙালি প্রবন্ধটির লেখক কে?
উত্তর: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
২। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কবে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তরঃ ৯ই ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে।
৩। রোকেয়ার জন্মস্থান কোথায়?
উত্তরঃ রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে।
৪। রোকেয়ার পিতার নাম কী?
উত্তরঃ জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের।
৫। রোকেয়ার পিতা কী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন?
উত্তরঃ তিনি ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী।
৬। ছোটবেলায় কে রোকেয়াকে বাংলা শেখাতে সাহায্য করেন?
উত্তরঃ বড় বোন করিমুন্নেসা বেগম।
৭। রোকেয়া ইংরেজি ভাষা কার তত্ত্বাবধানে শেখেন?
উত্তরঃ বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের তত্ত্বাবধানে।
৮। রোকেয়ার স্বামীর নাম কী?
উত্তরঃ সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন।
৯। বিবাহের পর তিনি কী নামে পরিচিত হন?
উত্তরঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে।
১০। ‘কুন্তলীন’ কী ছিল?
উত্তরঃ লেখকের আমলে জনপ্রিয় চুলে দেয়ার তেলের নাম।
১১। রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত দুটি সংগঠনের নাম কী?
উত্তরঃ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ও আনজুমান-ই-খাওয়াতীন-ই-ইসলাম।
১২। ‘কেশলীন’ কী ধরনের জিনিস?
উত্তরঃ এটি একটি জনপ্রিয় চুলের তেলের নাম।
১৩।। ‘হাওয়ার শাড়ি’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ সূক্ষ্ম সুতোর পাতলা শাড়ি।
১৪। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কবে মৃত্যুবরণ করেন?
উত্তরঃ ৯ই ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে।
১৫। ‘তণ্ডুল’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তরঃ চাল।
১৬। ‘দিব্যাঙ্গনা’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ স্বর্গের রূপসী বা হুরপরি।
১৭। লেখকের দৃষ্টিতে বাঙালির স্বভাব কেমন?
উত্তর: দুর্বল, নিরীহ, অলস ও কোমল।
১৮। ‘বাঙালি’ শব্দটি লেখিকার কাছে কেমন মনে হয়?
উত্তর: সুমধুর, তরল ও কোমল।
১৯। ‘মিল্ক অভ রোজ’ কী ধরনের বস্তু?
উত্তরঃ এটি একটি সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধনী।
২০। লেখিকা বাঙালিকে কীসের সঙ্গে তুলনা করেছেন?
উত্তর: কুসুম, চন্দ্র, মধু, নবনী, চন্দ্রিকা ইত্যাদির সঙ্গে।
২১। লেখিকা বাঙালিকে কোন ধরনের কবিতা বলেছেন?
উত্তর: মূর্তিমান কবিতা।
২২। ভারতবর্ষ যদি অট্টালিকা হয়, বাঙালি কোথায়?
উত্তর: বৈঠকখানা বা drawing room।
২৩। ভারত যদি উপন্যাস হয়, বাঙালি কী?
উত্তর: নায়িকা।
২৪। বাঙালি পুরুষকে লেখিকা কী বলেছেন?
উত্তর: পুরুষিকা।
২৫। বাঙালির ক্রিয়াকলাপ কেমন?
উত্তর: সহজ ও সরল।
২৬। বাঙালির প্রধান খাদ্যদ্রব্য কী?
উত্তর: পুঁইশাক, সজিনা, পুঁটি মাছের ঝোল।
২৭। বাঙালির প্রিয় মিষ্টান্ন কী কী?
উত্তর: সন্দেশ, রসগোল্লা, ক্ষীর, নবনীত।
২৮। বাঙালির খাদ্য কেমন?
উত্তর: সরস, সুস্বাদু, মধুর।
২৯। সজিনার তুলনায় লেখিকা কী বলেছেন?
উত্তর: সজিনা যেমন বীজবহুল, বাঙালির ভুঁড়িও স্থূল।
৩০। ‘শুভ্রনীলাম্বর’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ পরিষ্কার নীল আকাশ।
৩১। বাঙালির পরিধেয় কেমন?
উত্তর: সূক্ষ্ম ও হালকা, শিমলার ধুতি-চাদর।
৩২। নারীরা কেমন পোশাক পরেন?
উত্তর: সূক্ষ্ম ও মসৃণ ‘হাওয়ার শাড়ি’।
৩৩। ‘কালিডর’ কী কাজে ব্যবহৃত হতো?
উত্তরঃ এটি একটি সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী।
৩৪। বাঙালি নারীদের লেখিকা কী নামে সম্বোধন করেছেন?
উত্তর: লজ্জাবতী ললিতা লতিকা।
৩৫। ‘সাশ্রুসজলনয়ন’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ জলভরা চোখ।
৩৬। বাঙালি খাঁটি সোনা-রূপা কেন রাখে না?
উত্তর: টাকার অভাবে।
৩৭। ‘দীর্ঘকেশী’ তৈল তৈরি হলে বাঙালি কী করে?
উত্তর: ‘হ্রস্বকেশী’ তৈল তৈরি করে।
৩৮। বাঙালি কৃষিকে কীভাবে দেখে?
উত্তর: পরিশ্রমসাধ্য ও কঠিন কাজ হিসেবে।
৩৯। বাঙালি কোন চর্চাকে সহজ মনে করে?
উত্তর: মস্তিষ্ক চর্চা (brain culture)।
৪০। কৃষির চেয়ে কী সহজ?
উত্তর: মুখস্থ বিদ্যার জোরে অর্থ উপার্জন।
৪১। বাঙালির অন্যতম পেশা কী?
উত্তর: পাস (শিক্ষাগত যোগ্যতা) বিক্রি।
৪২। ‘ভিনোলিয়া পাউডার’ কী?
উত্তরঃ এটি একটি সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধনী সামগ্রী।
৪৩। ‘আত্মপ্রশংসা’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তরঃ নিজের প্রশংসা।
৪৪। নারীদের রান্নার অনুরোধ করলে লেখিকা কী বলেন?
উত্তর: সেই ব্যক্তির ত্রিবিধ দণ্ড হওয়া উচিত।
৪৫। বাঙালির কবিতায় কোন রস বেশি?
উত্তর: করুণরস।
৪৬। ‘সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ রূপচর্চার জন্য ব্যবহৃত প্রসাধনী দ্রব্য।
৪৭। লেখিকার মতে কবিতার অশ্রুজল কী করছে?
উত্তর: বঙ্গদেশকে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
৪৮। লেখিকার মতে, সব বাঙালিই কী?
উত্তর: কবি।
৪৯। “নিরীহ বাঙালি” গল্পটি কোন সংকলনে প্রথম প্রকাশিত হয়?
উত্তর: “মতিচূর” (প্রথম খণ্ড, ১৯০৪)।
৫০। গল্পে বাঙালির কোন দিকগুলো ব্যঙ্গ করা হয়েছে?
উত্তর: অলসতা, ভীরুতা, আত্মমুগ্ধতা ও অনুকরণপ্রিয়তা।
৫১। বাঙালিকে কী কী উপমায় বর্ণনা করা হয়েছে?
উত্তর: কুসুমের কোমলতা, মধুর মাধুরী, নবনীর নরমতা ইত্যাদি।
৫২। বাঙালি নারীদের কী বলা হয়েছে?
উত্তর: “লজ্জাবতী লতিকা”, “সুকুমারী”।
৫৩। “খাঁ বাহাদুর” উপাধি পাওয়াকে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: দেশসেবার চেয়ে সহজ উপায়ে খ্যাতি অর্জন।
৫৪। দুর্ভিক্ষ নিবারণের চেয়ে কী সহজ?
উত্তর: বিদেশ থেকে ভিক্ষা চাওয়া।
৫৫। স্বাস্থ্যরক্ষার চেয়ে কী সহজ?
উত্তর: ডাক্তারের কাছে অর্থ ব্যয় করা।
৫৬। “ত্রিবিধ দণ্ড” কী কী?
উত্তর: তুষানলে দগ্ধ, জবেহ, ফাঁসি।
৫৭। ‘ঝঞ্ঝাবাতে’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ ঝঞ্ঝার বাতাসে।
৫৮। “অতি শুভ্রনীলাম্বর” শব্দটি কী নির্দেশ করে?
উত্তর: বাঙালির কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা।
৫৯। বাঙালির অর্থ উপার্জনের সহজ উপায় কী?
উত্তর: শ্বশুরবাড়ি লুণ্ঠন।
৬০। ‘সৌকুমার্য’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তরঃ সৌন্দর্য।
৬১। গল্পে ভারতবর্ষকে কী কী উপমায় দেখানো হয়েছে?
উত্তর: অট্টালিকা, সরোবর, উপন্যাস।
নিরীহ বাঙালি প্রবন্ধের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর
১. “আমাদের কাব্যে বীররস অপেক্ষা করুণরস বেশি” – কেন?
বাঙালি জাতির স্বভাব কোমল, ভীরু ও সংবেদনশীল। তাই তাদের কাব্যে বীরত্বের চেয়ে দুঃখ-দুর্দশার বেশি প্রাধান্য দেখা যায়। বাঙালি কবিরা ছোট ছোট বিষয় যেমন পুরনো কাঁথা, ফাটা চটি নিয়েও কান্নার কবিতা লেখেন। তাদের কবিতায় ভালোবাসা, হারানো স্মৃতি, মৃত্যুশোক ইত্যাদি বিষয় বেশি থাকে। সাহসিকতা, যুদ্ধ, সংগ্রাম – এসবের পরিবর্তে প্রেম, বঞ্চনা ও দুর্ভাগ্য নিয়ে লেখা হয়। ফলে করুণরস বেশি, বীররস তুলনায় কম।
২. লেখিকা বাঙালিকে ‘মূর্তিমতী কবিতা’ বলেছেন কেন?
লেখিকার মতে বাঙালি খুবই সংবেদনশীল, ভীরু ও অলস জাতি। তাদের ব্যবহার, জীবনযাপন, ভাষা সবকিছুতেই অতিরিক্ত কোমলতা ও সৌন্দর্য আছে। তারা কুসুমের মতো কোমল, চন্দ্রের মতো শান্ত, নবনীর মতো সরল। তাদের এই কোমল ও কল্পনাবিলাসী স্বভাব কবিতার সঙ্গে মিলে যায়। বাঙালির জীবনে এতটাই ভাবপ্রবণতা যে মনে হয় তারা হাঁটাচলা করছে, অথচ তারা যেন এক একটি জীবন্ত কবিতা। এই কারণে লেখিকা তাদের ‘মূর্তিমতী কবিতা’ বলেছেন।
৩. “আমাদের এখানে লেখিকা অপেক্ষা লেখিকার সংখ্যা বেশি।” – কেন?
লেখিকার মতে, বাংলায় সত্যিকারের জ্ঞানী ও চিন্তাশীল নারী লেখিকা কম। কিন্তু যারা নিজেকে লেখিকা দাবি করেন, তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকেই স্রেফ আবেগে, অল্প বিদ্যায় কবিতা বা গদ্য লেখেন, কিন্তু তা সাহিত্যিক মানে পৌঁছায় না। তারা ভাবপ্রবণ হলেও যুক্তিসম্মত ও চিন্তাশীল লেখালেখি করতে পারেন না। তাই লেখিকা বলেন, প্রকৃত ‘লেখিকা’ কম, অথচ ‘লেখিকার সংখ্যা’ বেশি। এটি একটি বিদ্রুপ।
৪. আইনচর্চা অপেক্ষা কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চা করা কঠিন কেন?
কৃষি একটি শারীরিক পরিশ্রমের কাজ, যেখানে প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ও জমির ব্যাপারে জ্ঞান দরকার। এর জন্য সূর্য, বৃষ্টি, মাটি – সব কিছু বোঝার অভিজ্ঞতা লাগে। অন্যদিকে, আইনচর্চা অনেকটা মুখস্থভিত্তিক ও আলোচনাভিত্তিক কাজ। শহরে বসেই অনেকে শুধু পাস করে আইনের চাকরি করতে পারে। কিন্তু কৃষি করতে হলে মাঠে নেমে কাজ করতে হয়, যা কষ্টসাধ্য। তাই আইনচর্চার চেয়ে কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চা কঠিন।
৫. “আমাদের অন্যতম ব্যবসায়—পাশ বিক্রয়।” কথাটি বুঝিয়ে দাও।
লেখিকা এই বাক্য দিয়ে বিদ্রুপ করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাঙালির সমাজে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। অনেক সময় মেয়ের বিয়েতে ছেলের ডিগ্রি (পাশ) দেখিয়ে অর্থ দাবি করা হয়। অর্থাৎ, ছেলে যত বেশি ‘পাশ’ করে, তার দাম তত বেশি। ছেলের পাস বিক্রি হয়, আর শ্বশুরবাড়ি তা কিনে নেয়। একে লেখিকা রসিকভাবে ব্যবসা হিসেবে তুলনা করেছেন। এর মাধ্যমে বাঙালির ভোগবাদী ও অলস মানসিকতা ফুটে উঠেছে।
৬. বিদেশী বড়লোকদের মৃত্যুদুঃখে আমরা ‘শোক সভার’ সভ্য হই কেন?
লেখিকার মতে, বাঙালিরা অকারণে আবেগে ভেসে যায়। কোনো বিদেশী লেখক বা বড়লোক মারা গেলে, তারা তাদের চেনেন না, জানেন না, তবুও শোক সভা করে। এটা একধরনের ভণ্ডামি বা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা। নিজেদের সমাজে দুঃখ-কষ্ট থাকলেও তাতে তারা শোক প্রকাশ করে না। বিদেশী প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে শোক প্রকাশ করে তারা যেন নিজেকে জ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক মনে করে। এটি একধরনের বাহ্যিক দেখনদারি, যার মধ্যে গভীরতা নেই।
৭. বাঙালির গুণের কথা লিখতে ‘অনন্ত মসী, কাগজ ও অক্লান্ত লেখিকা’ প্রয়োজন কেন?
লেখিকা বিদ্রুপের ভাষায় বলেছেন, বাঙালির গুণ এত বেশি যে তা লিখে শেষ করা যায় না। একে তো তারা অলস, আবার বড় বেশি আবেগপ্রবণ। তাদের কথাবার্তা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভাবপ্রবণতা—সবকিছুতেই আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। তাই তাদের সব গুণ লিখে শেষ করতে গেলে অশেষ কালি, অনেক কাগজ আর অবিরাম লিখে যাওয়ার মতো এক জন ক্লান্তিহীন লেখিকা দরকার। এটি আসলে বাঙালির বাহ্যিক সৌন্দর্য ও ভেতরের দুর্বলতা নিয়ে ব্যঙ্গ। লেখিকা বোঝাতে চেয়েছেন—এই সব গুণ আসলে কাজে লাগে না, বরং এসব অলসতার প্রকাশ।
৮. বাণিজ্যকে আমরা সহজ ও স্বল্পায়াসসাধ্য করে নিয়েছি কেন?
বাঙালি জাতি পরিশ্রম করতে চায় না, তাই তারা বাণিজ্যকেও সহজ পথে নিতে চায়। তারা ঝুঁকি নেয় না, বড় জাহাজে বাণিজ্য করতে চায় না। বরং, তারা নকল জিনিস যেমন- নকল কেশতৈল, অলংকার বা ওষুধ বিক্রি করে। এসব জিনিসে পরিশ্রমও কম, লাভও হয়। বাঙালিরা কঠিন পরিশ্রমে ভয় পায়, তাই বাণিজ্যকে খেলনা বানিয়ে ফেলেছে। এতে দেশের অর্থনীতি মজবুত হয় না, কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থে সন্তুষ্ট থাকে।
৯. লেখিকা বাঙালির খাদ্যসামগ্রীকে ত্রিগুণাত্মক বলেছেন কেন?
ত্রিগুণাত্মক মানে—তিনটি গুণে ভরপুর। বাঙালির খাদ্য যেমন সরস (রসাল), সুস্বাদু (মজাদার), এবং মধুর (মিষ্টি)। যেমন: পুঁইশাক, সজনে, পুঁটি মাছের ঝোল—রসাল; ক্ষীর, রসগোল্লা, সন্দেশ—সুস্বাদু; আম-কাঁঠাল—মধুর। লেখিকা ব্যঙ্গ করে বলছেন, এমন খাওয়া খেয়ে বাঙালি ভীষণ নরম স্বভাবের হয়ে গেছে। খাদ্য যেমন কোমল, তাদের শরীর ও মনও তাই। এইভাবে লেখিকা খাদ্যরস আস্বাদন ও অলসতার যোগসূত্র দেখিয়েছেন।
১০. সহজ কাজ বলতে কী বোঝ?
সহজ কাজ মানে এমন কাজ যেটাতে খুব বেশি পরিশ্রম বা ঝুঁকি নেই। যেমন—নকল জিনিস বানানো, ঔষধ বেচা, রংচঙে পণ্য বিক্রি, বিদেশী মৃত্যুতে শোক সভা করা। এসব কাজে মস্তিষ্ক বা শরীরকে বেশি কষ্ট দিতে হয় না। কৃষি বা শিল্পের মতো কঠিন ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ থেকে বাঙালিরা দূরে থাকে। তারা মুখে মুখে কাজ সারতে পছন্দ করে। এইসব কাজ আসলে অলসতার পরিচয়।
১১. কৃষি দ্বারা কীভাবে অন্ন বৃদ্ধি হয়?
কৃষি হল শস্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া, যা মাটি চাষ করে ধান, গম, সবজি ইত্যাদি ফলায়। জমিতে চাষ করলে শস্য হয়, আর শস্য থেকেই খাদ্য হয়। খাদ্য উৎপাদন বাড়লে দেশে অভাব কমে। কৃষি ছাড়া মানুষের খাদ্যচাহিদা মেটানো অসম্ভব। তাই কৃষিই হলো অন্ন বৃদ্ধির প্রধান উপায়। কিন্তু বাঙালিরা তা না করে অলসভাবে মাথার চর্চায় (brain culture) ব্যস্ত থাকে।
১২. “আমাদের কাব্যে বীররস অপেক্ষা করুণরস বেশি।” – কেন? ব্যাখ্যা কর।
বাঙালিরা আবেগপ্রবণ, কল্পনাবিলাসী ও নরম প্রকৃতির। তাই তাদের সাহিত্যে সাহস, যুদ্ধ, সংগ্রামের চেয়ে কান্না, বেদনা ও ভালোবাসার প্রাধান্য বেশি। ছোট ছোট বিষয় নিয়েও তারা দুঃখ প্রকাশ করে। তাদের লেখায় বেশি দেখা যায় চোখের জল, হারানো প্রেম, পরাজয়ের গল্প। সাহসিকতার পরিবর্তে তাদের রচনায় থাকে হাহাকার। তাই তাদের কবিতা বা কাব্যে করুণরস বেশি, বীররস কম।
১৩. সামান্য অর্থ ব্যয়ে মহৎ কাজ দ্বারা খ্যাতি লাভ করার চেয়ে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি লাভের জন্য অর্থ ব্যয় সহজ কেন?
মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ, সময়, শ্রম ও ধৈর্য লাগে। দরিদ্রের পাশে দাঁড়ানো, স্কুল তৈরি করা, দুর্ভিক্ষে সাহায্য করা—এইসব কাজে পরিশ্রম ও আন্তরিকতা দরকার। কিন্তু বাঙালিরা পরিশ্রম এড়িয়ে যায়। তারা টাকা খরচ করে সোজা পথে ‘রায় বাহাদুর’ বা ‘খাঁ সাহেব’ উপাধি কিনে নেয়। এতে খ্যাতিও পাওয়া যায়, আবার কষ্টও কম। লেখিকা ব্যঙ্গ করে বোঝাতে চেয়েছেন—এটা অলসদের সহজ সাফল্য লাভের কৌশল।
১৪. আমরা কেন ‘দীর্ঘকেশী’ তেলের অনুকরণে ‘হ্রস্বকেশী তেল বাহির করি?
‘দীর্ঘকেশী তেল’ বিদেশি এক ধরনের কেশতেল যা চুল লম্বা করে—এই দাবি করে। বাঙালিরা এর অনুকরণে নিজেরাও ‘হ্রস্বকেশী তেল’ তৈরি করেছে। এতে বোঝা যায়, তারা নিজেরা কিছু মৌলিক উদ্ভাবন করতে পারে না, শুধু অনুকরণ করে। এই ‘হ্রস্বকেশী তেল’ নামটিও ব্যঙ্গাত্মক—মানে এমন তেল যা চুল ছোট করে দেয়! লেখিকা এর মাধ্যমে বাঙালির ব্যবসায়িক অলসতা ও কল্পনাবিলাসিতাকে উপহাস করেছেন। তারা বাস্তব কাজের চেয়ে মিথ্যা প্রচারে বেশি আগ্রহী।
১৫. বাঙালি নারীদের পোশাক ও প্রসাধনী সম্পর্কে লেখকের মত ব্যাখ্যা কর।
লেখিকা বলেছেন, বাঙালি নারীরা সাজগোজে অত্যন্ত আগ্রহী। তারা চুলে সুগন্ধি তেল মাখে, মাথায় ফুল গুঁজে রাখে, মুখে পাউডার মাখে। হাতের আঙুলে আংটি, কানে দুল, গলায় মালা—সবসময় গহনায় সজ্জিত থাকে। সাজগোজে এত মনোযোগ দেয় যে, ঘরকন্না বা জ্ঞানচর্চায় মন দেয় না। লেখিকার মতে, এই সাজগোজ আসলে বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়ালেও ভিতরের শূন্যতাকে ঢেকে রাখতে পারে না। এটি একপ্রকার সামাজিক ব্যঙ্গ, যেখানে মূলত নারীদের অলসতা ও ভ্রান্ত অভ্যাসকে তুলে ধরা হয়েছে।
১৬. “আমরা দুর্বল নিরীহ বাঙালি।” এ কথা লেখিকা কেন বলেছেন?
লেখিকা বলেছেন, বাঙালিরা শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে দুর্বল। তারা পরিশ্রম করতে চায় না, সাহস দেখাতে চায় না, সংগ্রাম করতে ভয় পায়। তাদের সাহিত্যে কান্না ও দুঃখের গল্প বেশি, বীরত্বের গল্প কম। তারা সহজে পরের কথায় বিশ্বাস করে, বিদেশিদের অনুকরণ করে, নিজেরা কিছু নতুন করে না। তাই তারা নিরীহ—মানে কারো ক্ষতি করে না, আবার নিজেদের ভালোর জন্য লড়েও না। লেখিকা এসব বৈশিষ্ট্য দেখে মজা করে বলছেন—আমরা সত্যিই নিরীহ বাঙালি।
১৭. কাদের পদ্যের অশ্রুজলের বন্যায় বঙ্গদেশ ডুবে যাচ্ছে? ব্যাখ্যা কর।
লেখিকা ব্যঙ্গ করে বলেছেন, বাংলার কবিরা এমন সব করুণ কাব্য লেখেন যা চোখে জল এনে দেয়। সেই অশ্রুতে যেন সারা দেশ ভেসে যাচ্ছে। এগুলো প্রেমহীন প্রেমিকের কান্না, বঞ্চিত বধূর হাহাকার, অথবা অভাগার বিলাপ। এসব পদ্যে সাহস নেই, সংগ্রাম নেই—শুধুই দুঃখ, হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস। এই করুণ পদ্যের পরিমাণ এত বেশি যে লেখিকা বলছেন—দেশটাই যেন ডুবে যাচ্ছে! এর মাধ্যমে বাঙালির অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতাকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
১৮. বাঙালি পুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে লেখকের মত ব্যাখ্যা কর।
লেখিকা বলেছেন, বাঙালি পুরুষের পোশাক খুব সাধারণ এবং একঘেয়ে। তাঁরা সাধারণত ধুতি, পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরে। কিন্তু সেই সাধারণ পোশাকে অহংকারও করে, আবার শোভাবর্ধনের চেষ্টা করে। কেউ কেউ রঙিন পাগড়ি, মোটা চশমা বা দামি ঘড়ি পরে নিজেকে বড় প্রমাণ করতে চায়। অথচ তারা আসল কাজ—জ্ঞানচর্চা বা শ্রম—নিয়ে ভাবে না। লেখিকার মতে, পোশাকের বাহারে নয়, মন ও কাজে পরিপক্বতা দরকার।
১৯. ‘নিরীহ বাঙালি’ প্রবন্ধের আলোকে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ব্যাখ্যা কর।
লেখিকা বলেছেন, বাঙালিরা খাওয়ার ব্যাপারে ভীষণ রসিক। তারা পঁইশাক, শুঁটকি, পুঁটি মাছ, ইলিশ, ক্ষীর, সন্দেশ—এসব খেতে খুব পছন্দ করে। তাদের খাবারে আছে সরসতা, মিষ্টতা ও নরম স্বভাব। খাদ্য গ্রহণে এতটা আনন্দ নেয় যে কখনও কখনও তা অলসতার রূপ নেয়। তারা খাওয়ার স্বাদে ডুবে থেকে কঠিন কাজ বা সংগ্রাম থেকে দূরে থাকে। লেখিকা মনে করেন, এই খাদ্যাভ্যাসই বাঙালিকে কোমল ও নিরীহ করে তুলেছে।
২০. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাঙালিকে ‘মূর্তিমান কাব্য’ বলেছেন কেন?
লেখিকা মনে করেন, বাঙালির জীবন বাস্তবের চেয়ে কাব্যে বেশি মানায়। তাদের কথাবার্তা, পোশাক, চালচলন—সবকিছুতেই আবেগ আর নাটকীয়তা মেশানো। তারা বাস্তব কাজের চেয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে বেশি পছন্দ করে। এরা কল্পনায় বীর, বাস্তবে নিরীহ ও অলস। তাই রোকেয়া তাদের ‘মূর্তিমান কাব্য’ বলেছেন—মানে যেন নিজের জীবনকে একটি কবিতা বানিয়ে বেঁচে আছে। এতে মজা করে বোঝানো হয়েছে, বাঙালি বাস্তব থেকে দূরে থাকে।
২১. ‘পাশ বিক্রয়’ বলতে কী বোঝ?
‘পাশ বিক্রয়’ মানে পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য টাকা দিয়ে নম্বর কিনে নেওয়া। লেখিকা এই কথার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্নীতিকে ব্যঙ্গ করেছেন। কেউ পরিশ্রম না করে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট পায়। এতে প্রকৃত মেধাবী ছাত্ররা পিছিয়ে পড়ে। এই অবস্থা জাতির জন্য ক্ষতিকর। লেখিকার মতে, এ এক ধরনের ব্যবসা—যেখানে শিক্ষার চেয়ে লাভ বড় হয়ে দাঁড়ায়।
২২. যারা স্ত্রীদের রান্না করতে বলে তাদের দণ্ড হওয়া উচিত কেন?
লেখিকা ব্যঙ্গ করে বলেছেন, রান্না করা একটি কঠিন শিল্প, কিন্তু পুরুষেরা তা মেয়েদের জন্য ফেলে রাখে। মেয়েরা অন্য গুণে গুণান্বিত হলেও, রান্না না জানলে তারা অযোগ্য বলে মনে করা হয়। অথচ যারা নিজেরা রান্না করতে জানে না, তারাই স্ত্রীদের রান্নার জন্য চাপ দেয়। লেখিকা মনে করেন, এটি একপ্রকার অবিচার। তাই ব্যঙ্গ করে বলেছেন, যারা স্ত্রীদের রান্না করতে বাধ্য করে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এতে নারী-পুরুষের অসম আচরণকে তুলে ধরা হয়েছে।
২৩. ভারতবর্ষ ও বাঙালিকে রোকেয়া কীভাবে তুলনা করেছেন?
রোকেয়া বলেন, ভারতবর্ষ একটি দেশ হলেও তার সব জাতি এক রকম নয়। কেউ সাহসী, কেউ ব্যবসাবান, কেউ যোদ্ধা—তবে বাঙালি সবচেয়ে নিরীহ ও কোমল। অন্য জাতিরা যুদ্ধ করে, শাসন করে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে। আর বাঙালি শুধু কাব্য, কান্না আর খাবারের প্রেমে মগ্ন। এই তুলনার মাধ্যমে লেখিকা বাঙালির দুর্বলতাকে তুলে ধরেছেন। এটা একপ্রকার ব্যঙ্গ ও আত্মসমালোচনামূলক মন্তব্য।
২৪. “আমরা কোমলাঙ্গ- তাঁহারা কোমলাঙ্গী।” – বুঝিয়ে দাও।
সাধারণভাবে ‘কোমলাঙ্গী’ বলা হয় মেয়েদের, যাদের শরীর নরম, মন সংবেদনশীল। কিন্তু লেখিকা মজা করে বলছেন, এখনকার বাঙালি পুরুষরাও এতটা নরম ও দুর্বল যে তাদেরও ‘কোমলাঙ্গ’ বলা চলে। মানে, তারা কাজকর্মে অক্ষম, কষ্ট সহ্য করতে পারে না, একটু পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নারীরা যেভাবে নরম স্বভাবের বলে পরিচিত, পুরুষরাও এখন তাই হয়ে গেছে। লেখিকা এভাবে বাঙালি পুরুষদের অলসতা ও অপারগতা ব্যঙ্গ করেছেন। এতে পুরুষদের আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
২৫. আমাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিস নেই কেন?
লেখিকা বলেন, বাঙালির দোকানে বাহারি জিনিস থাকে—সুগন্ধি, তেল, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী। কিন্তু সত্যিই প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন কৃষিযন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম বা শিক্ষার বই পাওয়া যায় না। কারণ, আমরা প্রয়োজনের চেয়ে বিলাসিতা নিয়ে বেশি ভাবি। আমরা যা দেখি, তাই অনুকরণ করি—নিজেরা নতুন কিছু তৈরি করি না। লেখিকা বলেন, এই অভ্যাস আমাদের পিছিয়ে রাখছে। তাই দোকানে আসল জিনিসের অভাব দেখা যায়।
আরও পড়ুনঃ পল্লিসাহিত্য প্রবন্ধের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর
Related Posts
- পল্লিসাহিত্য মূলভাব – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ- ৯ম-১০ম শ্রেণির বাংলা
- প্রবাস বন্ধু গল্পের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর
- রানার কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর
- সুভা গল্পের মূলভাব, বিষয়বস্তু ও বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর
- Natures Tapestry Class 9 English Chapter 2 Answer (বাংলা অর্থসহ)