‘দীক্ষা’ গল্পে মৌলবি সাহেব ও লেবুর মধ্যেকার সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনের শিক্ষা, ক্ষমা, দোষ স্বীকার ও বদলানোর প্রক্রিয়া ফুটে উঠেছে। দুষ্টুমি সত্ত্বেও ভালো গুণাবলী থাকা, শিক্ষকের ধৈর্য ও ভালোবাসা মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে যায়। এই পোস্টে ৭ম শ্রেণির আনন্দপাঠের দীক্ষা গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
দীক্ষা গল্পের মূলভাব
দীক্ষা গল্পটি এক দুষ্টু ছাত্র লেবু আর মৌলবি সাহেবকে নিয়ে লেখা, যিনি সাধারণত ফারসি পড়ান। সেদিন বাংলা শিক্ষক অনুপস্থিত থাকায় হেডমাস্টার তাকে ফোর্থ ক্লাসে বাংলা পড়ানোর দায়িত্ব দেন। মৌলবি সাহেব রাজি হলেও ভয় পান, কারণ লেবু নামের ছাত্রটি তাকে প্রায়ই বিরক্ত করে। ক্লাসে তিনি রচনা লেখার কাজ দেন—”পাঁচশো টাকা পেলে কী করবে?” লেবু বলে, “এত টাকা কোথা থেকে দেবেন?” স্যার বলেন, “মনে করে নাও।” লেবু লিখে, “আমি পায়ে পা তুলে বসে থাকব।” এতে মৌলবি সাহেব রেগে যান, কিন্তু হেডমাস্টারের ডাক আসায় শাস্তি দেন না। পরে স্কুলে অন্য এক পণ্ডিত অভিযোগ করেন যে ছাত্ররা তার ছাত্রদের নিয়ে ঠাট্টা করেছে। হেডমাস্টার জিজ্ঞাসা করলে লেবু স্বীকার করে নেয়। হেডমাস্টার তাকে ক্ষমা চাইতে বলেন, শাস্তি দেন না। এরপর লেবুকে স্কুলে আনা-নেওয়ার দায়িত্ব মৌলবি সাহেবকে দেওয়া হয়, যাতে সে ভালো পথে চলে। একদিন পরীক্ষার সময় মৌলবি সাহেব সন্দেহ করেন লেবু নকল করছে, কিন্তু তার পকেটে সিগারেট নয়, আরশোলা দেখে ভয় পেয়ে যান। আবার একদিন পথে লেবু গুলতি ছুঁড়ে মাটির হাঁড়ি ভেঙে ফেলে। কুমোররা রেগে গিয়ে টাকা চায়, না পেয়ে মৌলবি সাহেব তার ছাতা বন্ধক রাখেন। এই ঘটনায় লেবুর মন খারাপ হয়। সে বুঝতে পারে তার দুষ্টুমিতে স্যার বিপদে পড়েছেন। শেষে সে স্যারের কাছে ক্ষমা চায় এবং বলে, “আমি আর কখনো দুষ্টুমি করব না, স্যার।”
দীক্ষা গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১। ক. মৌলবি সাহেব ক্লাসে সবাইকে রচনা লিখতে দিলেন কেন? বুঝিয়ে লেখ। | ৩ |
খ. ‘দীক্ষা’ গল্পে লেবুর দুষ্টুমির বর্ণনা দাও। | ৭ |
ক) উত্তরঃ সেদিন স্কুলে বাংলা শিক্ষক সতুবাবু অনুপস্থিত ছিলেন, তাই হেডমাস্টার মৌলবি সাহেবকে ফোর্থ ক্লাসে বাংলা পড়াতে বলেন। মৌলবি সাহেব সাধারণত ফারসি পড়ান, বাংলা তাঁর বিষয় নয়। আবার ফোর্থ ক্লাসের লেবুদের মতো দুষ্ট ছেলেরা তাঁকে খুবই অস্থির করে তোলে। তিনি জানতেন, তাদের সামলানো কঠিন হবে। গোলমাল এড়াতে তিনি বুদ্ধি করে একটি সহজ কাজ দিলেন। তিনি সবাইকে কল্পনা করতে বললেন, যেন তারা পাঁচশো টাকা পেয়েছে। সেই টাকা দিয়ে কী করবে, তা নিয়ে একটি ছোট রচনা লিখতে বললেন। এতে সবাই খাতা-পেনসিল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনি চাইছিলেন যেন ক্লাসে শান্তি বজায় থাকে। এইভাবে তিনি ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন।
খ) উত্তরঃ ‘দীক্ষা’ গল্পে লেবু একজন দুষ্টু, চঞ্চল, কিন্তু বুদ্ধিমান ছাত্র। তার দুষ্টুমির শুরু হয় বাংলা রচনা লেখার সময়। সবাই যখন সিরিয়াসভাবে রচনা লিখছে, তখন লেবু কল্পনার টাকা কমিয়ে দিতে বলে এবং শেষে লেখে—”পাঁচশত টাকা পাইলে নিশ্চিন্তে পায়ের উপর পা তুলে বসে খাইব।” এই কথা শুনে মৌলবি সাহেব রেগে গিয়ে তার কান মলে দেন। আবার একবার সে পাঠশালার পণ্ডিতমশাইকে নিয়ে ঠাট্টা করে দেয়ালে ছড়া লিখে দেয়। হেডমাস্টার সবাইকে ডেকে যখন জানতে চান, তখন লেবু নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়। পরে একদিন পরীক্ষার সময় সে পকেটে আরশোলার বাচ্চা নিয়ে আসে, যেগুলো বড়শির টোপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু মৌলবি সাহেব সেটাকে নকল করার সরঞ্জাম ভেবে খুলে ফেলেন এবং আরশোলা বেরিয়ে এসে তাঁকে ভয় পাইয়ে তোলে। তিনি দৌড়ে বেড়াতে থাকেন, ডেস্ক ভাঙেন এবং পুরো ক্লাস অস্থির হয়ে যায়। এছাড়া লেবু একদিন গুলতি দিয়ে কাঠবিড়ালি মারতে গিয়ে কুমোরের হাঁড়ি ভেঙে ফেলে, দায় গিয়ে পড়ে মৌলবি সাহেবের ঘাড়ে। বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রিয় ছাতাটি বন্ধক রাখতে হয়। এই সব ঘটনার পরও লেবু উপলব্ধি করে যে তার দুষ্টুমিতে মৌলবি সাহেব কষ্ট পেয়েছেন। তার মনে অনুশোচনা জাগে। শেষ পর্যন্ত সে ক্ষমা চায় এবং মৌলবি সাহেবের ভালোবাসা ও শিক্ষার মাধ্যমে এক ধরনের মানসিক পরিবর্তনের দীক্ষা পায়।
প্রশ্ন ২। ক. ক্লাসে হেডমাস্টার নোটিশ দেওয়ার কারণ কী? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. মৌলবি সাহেবের চরিত্রের মহানুভবতার দিকটি তুলে ধর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ হেডমাস্টার মশাই ক্লাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নোটিশ জানানোর জন্য সবাইকে কমনরুমে ডেকেছিলেন। চণ্ডীতলা পাঠশালার পণ্ডিত বামাপদবাবু অভিযোগ করেছিলেন যে, এই স্কুলের কিছু ছাত্র তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি পাঠশালার দেয়ালে লেখা একটি ছড়া পাঠিয়েছেন। সেই ছড়া গুরুজনকে কটাক্ষ করে লেখা হয়েছিল। হেডমাস্টার মশাই মনে করেছিলেন, ছড়াটি এই স্কুলের কোনো ছাত্রই লিখেছে। তাই তিনি চেয়েছিলেন দোষী নিজে স্বীকার করুক। যদি কেউ স্বীকার না করে, তাহলে তিনি কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। এজন্য তিনি নোটিশ দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে হাজির করেছিলেন।
খ) উত্তরঃ মৌলবি সাহেব একজন সরল, ভদ্র ও ধর্মপ্রাণ শিক্ষক। তিনি নিজের বিষয়ে শিক্ষাদান করেন এবং নিয়ম-কানুন খুব মানেন। ফোর্থ ক্লাসে বাংলা পড়ানো তাঁর বিষয় না হলেও, হেডমাস্টারের অনুরোধে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও লেবুর মতো দুষ্ট ছাত্রদের জন্য তিনি বেশ অস্বস্তিতে থাকেন, তবুও ধৈর্য হারান না। যখন লেবু রচনায় বিদ্রুপ করে লেখে, তিনি রেগে গেলেও মারধর করেন না—শুধু কান মলে সাবধান করে দেন। ছেলেরা যখন ছড়া লিখে পণ্ডিতমশাইকে কটাক্ষ করে, তখনও তিনি নিজে কিছু না বলে হেডমাস্টারের নির্দেশ মেনে চলেন। এমনকি পরীক্ষার সময় লেবুর পকেট থেকে আরশোলার খালি প্যাকেট বের করে যে হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেখানেও তিনি ধৈর্য ধরে থাকেন। পরবর্তীতে লেবু গুলতি দিয়ে হাঁড়ি ভেঙে দেয় এবং দায় এসে পড়ে মৌলবি সাহেবের ঘাড়ে। তিনি নিজে দোষ না করেও কুমোরকে ছাতাটা দিয়ে দেন। নিজের সম্মান হারিয়েও তিনি উত্তেজিত হন না। এসবের মধ্যেও তিনি শিক্ষকের কর্তব্য ভুলে যান না। এমনকি নিজের দুঃখ-কষ্ট, সংসারের বিপদ, বাড়ির অসুস্থতা নিয়েও কষ্ট চেপে রেখে তিনি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। যখন লেবু দুঃখিত হয়ে ক্ষমা চায়, তখন মৌলবি সাহেব তাকে বুকে টেনে নেন। তিনি বলেন, “তুমি তো ইচ্ছা করে অন্যায় করোনি।” এই কথার মাধ্যমে তাঁর মহানুভবতা ও কোমল হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মতো শিক্ষকই সত্যিকারের ‘দীক্ষা’ দিতে পারেন।
প্রশ্ন ৩। ক. লেবুর মনটা মৌলবি সাহেবের প্রতি সহানুভূতিতে ভরে গেল কেন? বুঝিয়ে লেখ। | ৩ |
খ. মৌলবি সাহেব তাঁর হাতের ছাতাটা বাঁধা রাখলেন কেন? বর্ণনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ লেবুর মনটা মৌলবি সাহেবের প্রতি সহানুভূতিতে ভরে যায় কারণ, হাঁড়ি ভাঙার ঘটনার জন্য দোষ তার হলেও দায় গিয়ে পড়ে মৌলবি সাহেবের ওপর। কুমোরভাঙা হাঁড়ির দাম তিনি দিতে না পেরে তাঁর প্রিয় ছাতাটি বাঁধা রেখে আসেন। লেবু দূর থেকে সব দেখছিল, কিন্তু সাহস করে সামনে যায়নি। সে বুঝতে পারে, তার দুষ্টামির জন্য একজন সৎ ও সরল শিক্ষককে অন্যায়ের শিকার হতে হয়েছে। মৌলবি সাহেব সেই বিষয়ে কিছু না বলে চুপচাপ সহ্য করেন। এই ঘটনাগুলো দেখে লেবুর ভিতরে অপরাধবোধ জাগে। সে অনুভব করে, মৌলবি সাহেব আসলেই ভালো মানুষ এবং তার প্রতি এমন ব্যবহার ঠিক হয়নি। তাই তার মনে সহানুভূতি ও অনুতাপ তৈরি হয়।
খ) উত্তরঃ মৌলবি সাহেব একজন সৎ, নিরহংকার এবং সংযমী মানুষ। হাঁড়ি ভাঙার ঘটনার দিন তিনি লেবুকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। পথে লেবু গুলতি দিয়ে কাঠবিড়ালি শিকার করতে গিয়ে ভুল করে কুমোরের হাঁড়ি ভেঙে ফেলে। কুমোরবাড়ির আধ-পাগলা লোকটি এসে ধরল মৌলবি সাহেবকে, কারণ ঘটনাস্থলে তিনি একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মৌলবি সাহেব যতই বললেন, এটা তাঁর কাজ নয়, কেউ বিশ্বাস করল না। কুমোর লোক বলল, “আপনিই তো রোজ এই ছেলেটিকে নিয়ে স্কুলে যান, তাকেই তো পালিয়ে যেতে দেখলাম।”
অবস্থার বেগে তিনি নিজে দোষ না করেও দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হন। হাঁড়ির দাম দিতে না পেরে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু—ছাতাটি বাঁধা রেখে দেন। এই ছাতাটি মৌলবি সাহেবের নিত্যসঙ্গী ছিল, গরমে রোদ থেকে বাঁচাত, বৃষ্টিতে ভিজতে দিত না। এমনকি এটি ছিল তাঁর আত্মসম্মানের প্রতীক।
তবুও তিনি নিজের সম্মান, অসুবিধা—সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। এমন আত্মত্যাগ একজন প্রকৃত শিক্ষকেরই পরিচয়। তিনি লেবুর ওপর একটুও রাগ প্রকাশ করেননি, বরং চুপচাপ সব সহ্য করেছেন। তাঁর এই ত্যাগী মনোভাব ও অসাধারণ সহনশীলতাই তাঁকে একজন মহান চরিত্রে পরিণত করেছে। এই ছাতা বাঁধা রাখা তাঁর আত্মত্যাগ, সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধের এক নিদর্শন হয়ে থাকে।