তিরন্দাজ গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর- আনন্দপাঠ ৮ম শ্রেণি

গল্পাংশটি ছোটোদের জন্য লেখা মহাভারতের ‘আদিপর্ব’ থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পের মূল বিষয় পাণ্ডু ও কুরুর
সন্তানদের মধ্যকার পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্ক এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা প্রদর্শন। এই পোস্টে ৮ম শ্রেণির আনন্দপাঠের তিরন্দাজ গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।

তিরন্দাজ গল্পের মূলভাব (যোগীন্দ্রনাথ সরকার)

‘তিরন্দাজ’ গল্পটি হস্তিনার রাজপুত্রদের যুদ্ধবিদ্যা শেখার কাহিনি। রাজা শান্তনুর রাজ্যে সত্যবতী নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল, যাকে ধীবর নামক এক ধীবর পালন করত। রাজা শান্তনু সত্যবতীর সঙ্গে বিবাহ করতে চাইলেন, কিন্তু ধীবর তাকে তার পুত্রের সিংহাসন নেওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় রাজি হননি। রাজা দেবব্রত (ভীষ্ম) সত্যবতীর সঙ্গে বিবাহের জন্য নিজের সিংহাসন ত্যাগ এবং কখনো বিবাহ না করার কঠোর শপথ করলেন। এরপর তাদের দুই পুত্র জন্ম নিল—চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। বিচিত্রবীর্যের পুত্র পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র, যাদের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিল। পাণ্ডুর ছেলেরা পাঁচ ভাই—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—পাণ্ডব নামে পরিচিত। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা একশো জনের বেশি, দুর্যোধন প্রধান, তাঁরা কৌরব নামে পরিচিত। পাণ্ডবদের এবং কৌরবদের মধ্যে শত্রুতা শুরু হয়। রাজকুমাররা শাস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য দ্রোণাচার্যের কাছে যান। দ্রোণাচার্য তাদের প্রশিক্ষণ দেন, বিশেষ করে অর্জুনকে নিজের প্রিয় ছাত্র বানান। অর্জুন তীরন্দাজি ও যুদ্ধে দুর্দান্ত পারদর্শী হন। দ্রোণাচার্য একটি পরীক্ষার জন্য নীল পাখির মাথা লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ার আদেশ দেন, যা অর্জুনই সফলভাবে করেন। এরপর কুমাররা তাদের যুদ্ধকৌশল প্রদর্শন করে সবাইকে মুগ্ধ করেন। অর্জুনের বাণে আগুন, বৃষ্টি, পাহাড় তৈরি হওয়ার মতো অলৌকিক কাজ হয়। গল্পে পাণ্ডবদের ও কৌরবদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা এবং অর্জুনের অসাধারণ তীরন্দাজি ও সাহসিকতা ফুটে উঠেছে।

তিরন্দাজ গল্পের বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন ১। ক. কৌরব ও পান্ডবদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধর।
খ. অর্জুন কীভাবে দ্রোণাচার্যের মন জয় করেছিলেন? ‘তিরন্দাজ’ গল্পের আলোকে বিশ্লেষণ কর।

ক) উত্তরঃ কৌরব ও পাণ্ডব দুই গোষ্ঠীর রাজকুমার ছিলেন, যাদের মধ্যে ছিল গভীর বিরোধ। পাণ্ডব ছিলেন পাণ্ডু রাজার পাঁচ পুত্র—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, ও সহদেব। তারা সরল, সাহসী ও ন্যায্যবান। আর কৌরব ছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের একশো পুত্রের দল, যার মধ্যে দুর্যোধন ছিলেন প্রধান। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় রাজ্য পাণ্ডুর হাতে যায়। কৌরবরা ছিল হিংসুক ও স্বার্থপর, তারা পাণ্ডবদের সঙ্গে রাজ্য ভাগাভাগায় হিংসা করত। কৌরবদের নেতৃস্থানীয় চরিত্র দুর্যোধন ও দুঃশাসন ছিল, যারা পাণ্ডবদের অপমান করত। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ ক্রমশ গভীর হয়, যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সূত্রপাত।

খ) উত্তরঃ ‘তিরন্দাজ’ গল্পে দ্রোণাচার্য রাজকুমারদের যুদ্ধবিদ্যা শেখাতে আসেন। তিনি তাদের পরীক্ষা করার জন্য একটি নীল পাখির মাথা লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ার আদেশ দেন। অনেকেই পাখির সঙ্গে গাছপালা এবং অন্যান্য বিষয়ও দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন, ফলে তারা সঠিকভাবে লক্ষ্য করতে পারেনি। কিন্তু অর্জুন শুধু পাখির মাথাটিই লক্ষ্য করে নিখুঁত তীর ছুঁড়েছিলেন এবং পাখির মাথা কেটে ফেলেন। এই নিখুত লক্ষ্য ও একাগ্রতা দ্রোণাচার্যের মন খুবই আনন্দিত করে। অর্জুনের এই পারদর্শিতা দেখে দ্রোণাচার্য তাকে নিজের ছেলে মত ভালোবেসে আদর করতে শুরু করেন। এছাড়া অর্জুন সাহসী ও নিষ্ঠাবান ছিল, যা তার ব্যক্তিত্বে প্রকাশ পায়। দ্রোণাচার্য মনে করেন, অর্জুন এমন এক যোদ্ধা যাকে সঠিক শিক্ষা দিলে পৃথিবীতে তার কোনো তুলনা নেই। অর্জুনের দক্ষতা ও ধৈর্য তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে। অর্জুনের প্রতি দ্রোণাচার্যের এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস তাকে বিশেষ শক্তি দেয় এবং তিনি অর্জুনকে সবসময় উন্নত করার চেষ্টা করেন। এভাবেই অর্জুন দ্রোণাচার্যের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হন এবং তার প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন।


প্রশ্ন ২। ক. অর্জুনকে কারা হিংসা করত? কেন করত?
খ. মানুষকে যেকোনো কঠিন কাজে পারদর্শী করে তুলতে আগ্রহ, চর্চা ও গুরুভক্তি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা ‘তিরন্দাজ’ গল্পের আলোকে তুলে ধর।

ক) উত্তরঃ অর্জুনকে প্রধানত দুর্যোধন এবং কর্ণ হিংসা করত। দুর্যোধন পাণ্ডবদের প্রধান ও কৌরবদের নেতা ছিল, আর কর্ণ ছিল ধৃতরাষ্ট্রের কুন্তীর ছেলে হলেও সে কৌরবদের পাশে ছিল। তারা অর্জুনকে হিংসা করত কারণ অর্জুন দ্রোণাচার্যের প্রিয় ছাত্র ছিল এবং তীরন্দাজিতে খুব দক্ষ ছিল। দ্রোণাচার্যের আদর পাওয়ায় অর্জুন অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিল। দুর্যোধন ও কর্ণ এই ভালোবাসা ও প্রশংসা দেখে ঈর্ষান্বিত হতেন। এছাড়া অর্জুন সবসময় ন্যায়পরায়ণ ও সাহসী ছিল, যা দুর্যোধনের মতো স্বার্থপর ও হিংসুক ব্যক্তির পছন্দ ছিল না। তাই তারা বারবার অর্জুনকে অপমান করত এবং তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করত। এই হিংসার কারণে অর্জুন ও পাণ্ডবেরা সতর্ক ও সাবধান থাকত।

খ) উত্তরঃ ‘তিরন্দাজ’ গল্পে দেখা যায়, অর্জুন কীভাবে দ্রোণাচার্যের মন জয় করে সেরা তীরন্দাজ হয়ে ওঠে। এর পেছনে তার গভীর আগ্রহ, কঠোর চর্চা ও গুরু দ্রোণাচার্যের প্রতি পূর্ণ ভক্তি ছিল। অর্জুন শুধু নির্দেশ মেনে চলেনি, বরং নিজের মনোযোগ দিয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করতে শিখেছে। দ্রোণাচার্যের কথা শুনে সে আগ্রহ নিয়ে অনুশীলন করত এবং শাস্ত্রপাঠের পাশাপাশি যুদ্ধকৌশলও শেখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করত। গুরুদের শিক্ষা ও পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে সে ধৈর্য্য ধরে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। অর্জুনের এই মনোভাবই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে এবং তীরন্দাজিতে শ্রেষ্ঠ করেছে। গল্পটি দেখায় যে, কোনো কঠিন কাজে সফল হতে হলে শুধু স্বাভাবিক চেষ্টা নয়, অন্তরের আগ্রহ, নিয়মিত চর্চা আর গুরু বা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াও জরুরি। এই তিনটি মূল দিক মিলে একজন সাধারণ মানুষকে পারদর্শী করে তোলে। তাই ‘তিরন্দাজ’ গল্প আমাদের শেখায়, গুরুভক্তি ও পরিশ্রম ছাড়া কঠিন কাজের সঠিক সফলতা পাওয়া কঠিন। অর্জুনের চরিত্র থেকে বোঝা যায়, আগ্রহ ও চর্চা ছাড়া প্রতিভাও পূর্ণতা পায় না। তাই জীবনে যেকোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে এই তিনটি বিষয় মেনে চলা প্রয়োজন।


প্রশ্ন ৩। ক. ভীষ্ম কার ওপর ছেলেদের অস্ত্র শিক্ষার ভার দিয়েছিলেন? কেন দিয়েছিলেন?
খ. কীভাবে অর্জুনের জয়ধ্বনিতে চারদিক ভরে উঠল? ‘তিরন্দাজ’ গল্পের আলোকে অর্জুনের বীরত্বের পরিচয় তুলে ধর।

ক) উত্তরঃ ভীষ্ম রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার দায়িত্ব দ্রোণাচার্যের ওপর দিয়েছিলেন। এর কারণ ছিল দ্রোণাচার্য খুবই দক্ষ এবং সুবিখ্যাত অস্ত্রশিক্ষক। তিনি কৃপাচার্যের পরিবর্তে দ্রোণাচার্যের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন কারণ দ্রোণাচার্য নতুন পদ্ধতিতে ছেলেদের যুদ্ধবিদ্যা শেখাতে পারতেন। দ্রোণাচার্যের উপস্থিতি ও দক্ষতা দেখে ভীষ্ম বুঝতে পারেন যে, শুধু শাস্ত্রপাঠ নয়, ছেলেদের প্রকৃত যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলা দরকার। তাই তিনি ছেলেদের জন্য দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে তারা সত্যিকারের যোদ্ধা হয়ে উঠতে পারে।

খ) উত্তরঃ ‘তিরন্দাজ’ গল্পে অর্জুন একজন অসাধারণ তীরন্দাজ ও বীর যোদ্ধা হিসেবে উঠে আসেন। দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে কঠোর পরিশ্রম এবং অনুশীলনের ফলে অর্জুন তীর ছোঁড়ায় নিখুঁত দক্ষতা অর্জন করেন। পরীক্ষার সময় সে শুধু পাখির মাথা লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে সফল হয়। তার তীর থেকে আগুন জ্বলে ওঠে, বরুণবাণ দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয়, মেঘ ও বৃষ্টি সৃষ্টি করে, এমনকি বিশাল পর্বতও গড়ে তোলে। এসব অলৌকিক দক্ষতা দেখে সবাই অবাক হয়। অর্জুনের এই বীরত্ব, সাহস এবং অদ্ভুত ক্ষমতা রঙ্গভূমিতে উপস্থিত সকলের মন জয় করে নেয়। যখন সে জয়ধ্বনি দেয়, তখন চারদিক আনন্দ ও উৎসবে ভরে ওঠে। তার এই জয়ধ্বনি শুধু নিজেকে নয়, সকলকে উদ্দীপনা দেয় এবং পাণ্ডবদের প্রতি বিশ্বাস ও সাহস যোগায়। অর্জুনের বীরত্ব ও তীরন্দাজির গুণাবলি তাকে এক অনন্য যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই গল্প আমাদের শেখায়, কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও দক্ষতার মাধ্যমে মানুষ যেকোনো কঠিন কাজে সফল হতে পারে এবং অন্যদের প্রেরণা দিতে পারে।


Related Posts

Leave a Comment