‘ডেভিড কপারফিল্ড’ চার্লস ডিকেন্স রচিত একটি বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস, যা একটি এতিম বালকের শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণের সংগ্রামমুখর জীবনের হৃদয়স্পর্শী কাহিনি তুলে ধরে। এই পোস্টে ৮ম শ্রেণির আনন্দপাঠের ডেভিড কপারফিল্ড গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
ডেভিড কপারফিল্ড গল্পের মূলভাব
ডেভিড কপারফিল্ডের জন্মের আগেই তার বাবার মৃত্যু হয়, তাই বাবার মুখ সে কখনোই দেখেনি। সে তার মা এবং গৃহপরিচারিকা পেগোটি’র স্নেহে বড় হচ্ছিল। পেগোটি ছিল খুবই ভালো মনের মানুষ, আর মা ছিলেন শান্ত স্বভাবের। ছোটবেলায় ডেভিডের জীবন ছিল আনন্দময়। কিন্তু তার জীবনে ঝড় আসে যখন তার মা মার্ডস্টোন নামের এক কঠোর স্বভাবের লোককে বিয়ে করেন। মার্ডস্টোন এবং তার বোন মিস মার্ডস্টোন অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজের মানুষ ছিল। তারা ডেভিডকে ছোট ছোট ভুলে শাস্তি দিত এবং তার স্বাভাবিক পড়ালেখার আনন্দ ধ্বংস করে দেয়। একদিন মার্ডস্টোন সাহেব বেত দিয়ে মারতে গেলে ডেভিড আত্মরক্ষার্থে তার আঙুলে কামড় দেয়। ফলে তাকে একা একটি ঘরে পাঁচদিন বন্দি করে রাখা হয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয়, ডেভিডকে লন্ডনের সালেম হাউস নামের এক আবাসিক স্কুলে পাঠানো হবে। লন্ডন যাওয়ার পথে তার শিক্ষক মেল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি একজন গরিব মানুষ, কিন্তু ভালো মনের মানুষ ছিলেন। স্কুলে গিয়ে ডেভিড বুঝতে পারে, তার বিরুদ্ধে আগেই খারাপ কথা পাঠানো হয়েছে, তার পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বোর্ড: “সাবধান, এটা কামড়ায়।” সহপাঠীরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, তবে স্টিরফোর্ড নামে একজন বড় ছাত্র তাকে সাহায্য করে ও বন্ধু হয়। মেল সাহেব তাকে স্নেহ করতেন, কিন্তু একদিন স্টিরফোর্ড তাকে অপমান করে এবং ডেভিডের মুখে শোনা তার মায়ের দারিদ্র্যের কথা সবাইকে জানিয়ে দেয়। এতে মেল সাহেব অসম্মানিত হয়ে স্কুল ত্যাগ করেন। গল্পের শেষদিকে ডেভিড মেল সাহেবের স্নেহ আর বাঁশির সুরের কথা মনে করে ভীষণ দুঃখ পায়। এই গল্পটি শুধু একজন ছেলেকে ঘিরে নয়—এটি এক অনাথ শিশুর শৈশবের কষ্ট, নিপীড়ন, বন্ধুত্ব আর সহানুভূতির অনুপম চিত্র তুলে ধরে।
ডেভিড কপারফিল্ড গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন
প্রশ্ন ১। ক. ডেভিডের সুখের জীবনে প্রথম ধাক্কা আসে কখন? | ৩ |
খ. ‘ধৈর্য ও সংগ্রামশীলতার মধ্য দিয়েই মানুষকে টিকে থাকতে হয়।’- ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ গল্পের আলোকে আলোচনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ ডেভিডের সুখের জীবনে প্রথম ধাক্কা আসে যখন তার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তখন ডেভিডের বয়স মাত্র আট বছর। সৎ বাবা মার্ডস্টোন সাহেব ছিলেন খুব কড়া মেজাজের। তিনি এবং তার বোন দুজনেই ছোটদের ওপর কঠোর শাসন করতেন। তারা ডেভিডের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন, কিন্তু ভালোভাবে শেখানোর বদলে তাকে শাস্তি দিতেন। তাদের সামনে ডেভিড পড়া ভুলে যেত, এতে তারা আরও বেশি রাগ করতেন। একদিন ডেভিড ভুল করলে মার্ডস্টোন সাহেব তাকে বেত্রাঘাত করেন। ডেভিড রাগে তার আঙুলে কামড় দেয়। এরপর ডেভিডকে একটি অন্ধকার ঘরে পাঁচদিন আটকে রাখা হয়। এই ঘটনার পর তাকে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এইভাবেই তার ছিমছাম ও মায়াভরা জীবনে আসে প্রথম দুঃখের ধাক্কা।
খ) উত্তরঃ চার্লস ডিকেন্সের ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ গল্পে ধৈর্য ও সংগ্রামের এক জীবন্ত চিত্র আমরা দেখতে পাই। ডেভিডের জীবনে শৈশব থেকেই নানা কষ্ট আসে। তার বাবার মৃত্যু হয় সে জন্মানোর আগেই। ছোটবেলায় সে মায়ের স্নেহে বড় হলেও, সেই শান্ত জীবন ভেঙে যায় যখন মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। সৎ বাবা মার্ডস্টোন ও তার বোন ছিল নিষ্ঠুর এবং কড়া স্বভাবের। তারা ডেভিডকে মারধর করত, ছোট ছোট ভুলের জন্য শাস্তি দিত।
ডেভিড পড়াশোনায় ভালো ছিল, কিন্তু ভয় ও দুশ্চিন্তায় তার পড়া গুলিয়ে যেত। একবার বেত্রাঘাত সহ্য করতে না পেরে সে সৎ বাবার আঙুলে কামড় দেয়, আর তাতেই সে আরও বড় শাস্তি পায়। তাকে বাড়ির একটি ঘরে পাঁচদিন বন্দি করে রাখা হয়। এরপর তাকে পাঠানো হয় লন্ডনের সালেম হাউস নামের একটি বোর্ডিং স্কুলে। সেখানেও শুরুতে সে অনেক লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হয়। তার পিঠে সাঁটা হয় একটি বোর্ড যাতে লেখা ছিল: “সাবধান, এটা কামড়ায়।”
তবে সে সব সয়ে নিয়েও ডেভিড হাল ছাড়েনি। ধীরে ধীরে সে স্কুলে কিছু বন্ধু পায়, বিশেষ করে স্টিরফোর্ড নামের এক সহপাঠীর সাহায্যে ডেভিড নতুন করে সাহস ফিরে পায়। সে তার মেধা ও ভালো আচরণের মাধ্যমে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করে। স্কুলে শিক্ষক মেল সাহেবের স্নেহ ও সহানুভূতিও তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। কষ্ট ও অপমান সত্ত্বেও ডেভিড সব কিছু সহ্য করে, কারণ সে বিশ্বাস করত যে, একদিন তার ভালো সময় আসবে।
এই গল্প আমাদের শেখায়—জীবনে যত বাধাই আসুক না কেন, ধৈর্য আর সংগ্রামের মাধ্যমে তা জয় করা সম্ভব। ডেভিড কোনোদিন হাল ছাড়েনি, বরং নিজের কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তর করেছে।
প্রশ্ন ২। ক. মেল সাহেবকে সালেম হাউস থেকে বের করে দেওয়া হয় কেন? | ৩ |
খ. লন্ডনের মতো জনাকীর্ণ শহরেও ডেভিড একা হয়ে পড়ে কেন? ব্যাখ্যা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ মেল সাহেব ছিলেন সালেম হাউসের একজন সৎ ও বিনীত শিক্ষক। তিনি খুব গরিব ছিলেন এবং তাঁর মা একজন দাতব্য আশ্রমে থাকতেন। একদিন ক্লাসে স্টিরফোর্ড তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করে এবং তাঁকে “ভিখেরি” বলে অপমান করে। কারণ, একসময় ডেভিড ভুল করে বলে ফেলেছিল যে মেল সাহেবের মা দান খেয়ে বাঁচেন। এই কথা জেনে স্কুলের মালিক ক্রিকল সাহেব খুব রেগে যান। তিনি ভাবেন, একজন শিক্ষকের আত্মীয় যদি দাতব্য আশ্রমে থাকেন, তাহলে তা স্কুলের মানহানিকর। তাই তিনি মেল সাহেবকে বলেন অব্যাহতি নিতে। মেল সাহেব লজ্জা ও দুঃখে সঙ্গে সঙ্গে স্কুল ছেড়ে দেন। শুধুমাত্র তাঁর সামাজিক অবস্থার কারণে এমন একজন সৎ ও সহানুভূতিশীল শিক্ষককে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়, যা খুবই দুঃখজনক ও অন্যায়।
খ) উত্তরঃ ডেভিড কপারফিল্ড ছিল একজন ছোট্ট ছেলে, যার মনের মধ্যে ছিল অনেক আশা, ভয় আর আবেগ। তার মায়ের পুনরায় বিয়ের পর নতুন বাবা ও ফুফুর কঠোর ব্যবহার তার জীবনে দুঃখের সূচনা করে। তাকে লন্ডনের এক বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয় সালেম হাউসে। লন্ডনের মতো বড়, কোলাহলপূর্ণ শহরে পা রেখেও ডেভিড ভীষণ একা অনুভব করে। চারপাশে হাজার হাজার মানুষ থাকলেও তার পরিচিত কেউ ছিল না। তার পরিবারের কেউ ছিল না তার পাশে, যে তাকে সাহস বা সান্ত্বনা দিতে পারত। এজন্য সে নিজেকে রবিনসন ক্রুসোর থেকেও একা মনে করেছিল, কারণ রবিনসন একা থাকলেও জানত সে কোথায় আছে, আর ডেভিডের সেই নিশ্চয়তাও ছিল না।
ছোটবেলায় পরিবার ও ভালোবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তার মধ্যে ভীষণ একাকিত্ব তৈরি হয়। যে শিশু সদ্য মাতৃস্নেহ হারিয়েছে, তার জন্য অচেনা শহর মানে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। শিক্ষক মেল সাহেব কিছুটা স্নেহ দিলেও তিনিও শেষ পর্যন্ত চলে যান। ক্লাসে সহপাঠীরা প্রথমে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। ফলে ডেভিডের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। অনেক কষ্টে সে ক্লাসের বড় ছাত্র স্টিরফোর্ডের বন্ধু হয়ে কিছুটা সাহস ফিরে পায়। তবু নিজের ভালোবাসার জগৎ ছেড়ে অন্য শহরে একা থাকতে হওয়ায় ডেভিডের ভেতরকার একাকিত্বত্ব বোঝা যায়। এই একাকিত্বই তাকে বাস্তব জীবন সম্পর্কে ভাবতে শেখায় এবং ধীরে ধীরে তাকে পরিণত করে। শহরের জনসমাগম তাকে কোনো শান্তি দিতে পারেনি, বরং সে বুঝতে পারে — মানুষ পাশে না থাকলে হাজার মানুষের মাঝেও একা থাকা যায়।
প্রশ্ন ৩। ক. সালেম হাউসে ডেভিডকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে কে? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. মেল সাহেবের প্রতি স্টিরফোর্ড ও ক্লিকল সাহেবের নিষ্ঠুর আচরণ আলোচনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ সালেম হাউসে ডেভিডকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে স্টিরফোর্ড নামের এক বড় ছাত্র। সে দেখতে সুন্দর, সাহসী এবং অনেক ছেলের নেতা ছিল। স্কুলে ডেভিডকে অন্য ছেলেরা “সাবধান! এটা কামড়ায়” বোর্ড লাগিয়ে নিয়ে বিদ্রূপ করত। কিন্তু স্টিরফোর্ড তার পাশে দাঁড়ায় এবং বন্ধু হয়ে যায়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ডেভিডকে দিয়ে গল্প শোনাতো, যা ডেভিডের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। স্টিরফোর্ডের বন্ধুত্বের জন্য অন্য ছেলেরা আর ডেভিডকে তেমন বিরক্ত করত না। এমনকি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্রিকল সাহেবও স্টিরফোর্ডকে ভয় করতেন। এই বন্ধুত্ব ডেভিডের একাকিত্ব দূর করে এবং তাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সাহায্য করে। তাই বলা যায়, স্টিরফোর্ডই সালেম হাউসে ডেভিডের সবচেয়ে বড় সহায় ছিল।
খ) উত্তরঃ মেল সাহেব ছিলেন সালেম হাউস স্কুলের একজন নিরীহ ও দরিদ্র শিক্ষক। তিনি শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন এবং চেষ্টা করতেন সঠিকভাবে পড়াতে। কিন্তু তাঁর পোশাক-আশাক সাধারণ ছিল, আর তিনি খুব ধীরে ও বিনীতভাবে কথা বলতেন, তাই ছাত্ররা তাঁকে সম্মান করত না। বিশেষ করে স্টিরফোর্ড নামের এক সাহসী ও প্রভাবশালী ছাত্র তাঁকে খুব অপমান করত। একদিন স্টিরফোর্ড ক্লাসে শিস দিচ্ছিল, তখন মেল সাহেব তাকে চুপ করতে বললে সে খুব রূঢ়ভাবে জবাব দেয়। এরপর সে মেল সাহেবকে “ভিখেরি” বলে অপমান করে এবং জানায়, তাঁর মা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে থাকেন। এটা ছিল খুবই কষ্টদায়ক এবং অপমানজনক কথা। ক্রিকল সাহেব, যিনি স্কুলের মালিক, তিনি বিষয়টি জেনেও স্টিরফোর্ডকে কিছু বলেননি বরং মেল সাহেবকে স্কুল ছাড়তে বলেন। তিনি বলেন, “এই স্কুল দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়।” অথচ মেল সাহেব কখনো সাহায্য চাননি, শুধু দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ডেভিড এই ঘটনা দেখে খুব কষ্ট পায়, কারণ সে জানত মেল সাহেব কত ভালো একজন মানুষ। একদিকে ছিল তাঁর দারিদ্র্য, অন্যদিকে ছাত্র ও প্রধান শিক্ষকের অমানবিক আচরণ—সব মিলে তাঁকে জোর করে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সমাজে গরিব ও বিনয়ী মানুষদের অনেক সময় অন্যায়ভাবে অবহেলা ও অপমান করা হয়। মেল সাহেব ছিলেন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, কিন্তু তাঁর প্রতি স্টিরফোর্ড ও ক্রিকল সাহেবের আচরণ ছিল একেবারে নিষ্ঠুর ও অন্যায়।