জসীমউদ্দীনের ‘জিদ’ গল্পটি আমাদের শেখায় অহেতুক জেদ মানুষের জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করে। জেদ করে না খেয়ে থাকা যেমন নিজের ক্ষতি, তেমনি তা অন্যের জন্যও বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে। এই পোস্টে জিদ গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর – আনন্দপাঠ ৭ম শ্রেণি লিখে দিলাম।
Table of Contents
জিদ গল্পের মূলভাব
জসীমউদ্দীনের ‘জিদ’ গল্পটি এক দরিদ্র তাঁতি ও তার স্ত্রীর জীবন নিয়ে লেখা। একসময় এই তাঁতির হাতে বোনা শাড়ির অনেক কদর ছিল। রাজা-বাদশাহরাও তার কাছ থেকে শাড়ি কিনতে আসত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি কাপড় আর কলের কাপড় এসে সব বদলে দেয়। তাঁতির ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়, আর সে খুব দরিদ্র হয়ে পড়ে। এখন তারা কখনো খেতে পায়, কখনো পায় না। একদিন তাঁর বউ মাছ খাওয়ার জন্য জিদ ধরে। সে রাগ করে বলে, “আজ মাছ না আনলে আমি আর সুতা কাটব না।” তখন তাঁতি তার শেষ ঘষা পয়সা নিয়ে হাটে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনটি ছোট মাছ কিনে আনে। মাছ দেখে বউ খুব খুশি হয় এবং রান্না শুরু করে। কিন্তু তখন শুরু হয় নতুন ঝগড়া—কে কয়টা মাছ খাবে। তাঁতি বলে সে দুইটা খাবে, বউ বলে সে দুইটা খাবে। শেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কেউ আগে কথা বলবে না—যে আগে বলবে সে একটা মাছ পাবে। তারা দুজনেই চুপ করে শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ। পাড়ার লোকেরা তাদের না দেখে চিন্তিত হয়। সবাই ভাবে তাঁতি আর তার বউ মারা গেছে। তারা ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে, দুজনকে নিথর দেখে কবর দেওয়ার আয়োজন করে। যখন কবরে মাটি পড়তে থাকে, তখন হঠাৎ তাঁতি বলে ওঠে, “তুই দুইটা খা, আমি একটা খামু!” এই কথা শুনে সবাই ভয়ে দৌড়ে পালায়। শেষে তাঁতি ও তার বউ হেসে বাড়ি ফিরে আসে এবং শান্তিতে মাছ ভাগ করে খায়।
জিদ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১। ক. “হাট হইতে নকশি-শাড়ি ফিরাইয়া আনিয়া তাঁতিরা কাঁদে”- কেন? | ৩ |
খ. ‘জিদ’ গল্পে আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তার পরিচয় দাও। | ৭ |
ক) উত্তরঃ আগে তাঁতিরা মিহি সুতা দিয়ে নকশি শাড়ি বুনতেন, যা রাজবাড়ি পর্যন্ত যেত। মানুষ সেই শাড়ির জন্য অপেক্ষা করত। কিন্তু বিদেশি বণিক এসে কলকারখানায় তৈরি মোটা সুতার টেকসই কাপড় বাজারে আনায় নকশি শাড়ির চাহিদা কমে যায়। ফলে তাঁতিরা অনেক যত্নে বোনা শাড়ি হাটে নিয়ে গেলেও তা কেউ কিনে না। তারা ফিরে আসে শাড়ি বিক্রি না করে। এতে তাদের মন ভেঙে যায়। শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয় বলে তাঁতিরা কাঁদে। কারণ, এত কষ্ট করে তৈরি করা শাড়ির কোনো মূল্য থাকছে না। সংসার চালানোর মতো আয়ও হয় না। বাজারে মিলের কাপড়ের দাপটে তাদের শিল্প ও স্বপ্ন ভেঙে যায়। এই বেদনা থেকেই তাঁতিরা হাট থেকে ফিরে কাঁদে।
খ) উত্তরঃ জসীমউদ্দীনের ‘জিদ’ গল্পে গ্রামবাংলার এক গরিব তাঁতি ও তাঁর স্ত্রীর জীবনের করুণ বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। এক সময় তাঁতিরা নকশি শাড়ি বুনে ভালো আয় করত। তাদের শাড়ি ছিল রাজা-বাদশাহর পছন্দের জিনিস। একটি শাড়ি বানাতে মাসের পর মাস লেগে যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যায়। বিদেশি বণিকেরা এসে দেশে কাপড়ের কল বসায়। কলের কাপড় সস্তা ও টেকসই হওয়ায় সবাই তা কিনতে শুরু করে। ফলে তাঁতির হাতে তৈরি মিহি সুতা ও নকশার শাড়ির কদর আর থাকে না। তাঁতিরা হাটে গিয়ে শাড়ি বিক্রি করতে পারে না। দিনের পর দিন তাদের হাঁড়িতে চাউল ওঠে না। তারা শুধু শাকভাত খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকে। মিলের কাপড় বুনতে হয়, যার সুতা আবার সহজে পাওয়া যায় না—চোরাবাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয়।তাঁতি ও তাঁর স্ত্রী ঠিক করে, কে বেশি খাবে তা না বলে নির্ধারণ করবে—যে আগে কথা বলবে সে কম খাবে। এই জেদের কারণে তারা কথা না বলেই শুয়ে থাকে, এমনকি কেউ তাদের মৃত মনে করে দাফন পর্যন্ত করতে যায়।
এই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য কীভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে কেমন করে শিল্পীরা হারিয়ে যায়। একসময়কার আত্মমর্যাদা সম্পন্ন তাঁতি পরিবার হয়ে পড়ে ভিক্ষুকের মতো অসহায়। এভাবে গল্পটিতে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কঠিন বাস্তবতা, জীবিকার সংকট এবং দারিদ্র্যজনিত সম্পর্কের টানাপোড়েন তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্ন ২। ক. “তর্ক বাড়িয়া যায়। সেই সঙ্গে রাতও বাড়ে, কিন্তু কিছুতেই মীমাংসা হয় না।”- কী মীমাংসা হয় না? লেখ। | ৩ |
খ. বিদেশি বণিকের কল বসানোতে তাঁতিদের জীবন কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে? | ৭ |
ক) উত্তরঃ তাঁতি হাট থেকে তিনটি ছোট মাছ কিনে আনে। তাঁতি ও তাঁর বউ দুজনেই দুটি মাছ খেতে চায়। তাই তারা তর্ক করতে থাকে—কে দুটি মাছ খাবে আর কে একটি। কেউ কারও কথা মানতে রাজি হয় না। একে অপরকে দোষ দিতে থাকে। দুজনের কেউই পিছপা হয় না। তাদের জেদ বাড়তে থাকে। তর্ক করতে করতেই রাত হয়ে যায়। তবুও তারা সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। শেষে তারা ঠিক করে, কেউ আগে কথা বলবে না—যে আগে বলবে সে একটি মাছ খাবে। এই ছোট্ট মাছ খাওয়ার বিষয়টি নিয়েই মীমাংসা হয় না। এভাবেই তর্ক বাড়ে, রাতও বাড়ে, কিন্তু সমাধান আসে না।
খ) উত্তরঃ ‘জিদ’ গল্পে গ্রামবাংলার এক গরিব তাঁতি ও তার স্ত্রীর জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাঁতি আগে খুব সুন্দর নকশি শাড়ি তৈরি করত। একেকটা শাড়ি বানাতে মাসের পর মাস লেগে যেত। তখন রাজা-বাদশা, নবাব-জাদিরাও এই শাড়ির জন্য অপেক্ষা করত। সেই সময় তাঁতিরা ভালো আয় করত। সংসারে অভাব ছিল না। কিন্তু সময় বদলে যায়। বিদেশি বণিকরা দেশে কাপড়ের কল বসায়। কলের তৈরি কাপড় সস্তা ও টেকসই হওয়ায় সবার পছন্দ হয়ে যায়। ফলে তাঁতির হাতে তৈরি মিহি নকশি শাড়ির কদর কমে যায়। হাটে কেউ আর সেসব শাড়ি কিনতে চায় না। তাঁতিরা শাড়ি ফেরত এনে কাঁদে। সংসারে অভাব বেড়ে যায়।
তাঁতির বউ মাছ খাওয়ার আবদার করে, কিন্তু তাঁতির পক্ষে তা জোগাড় করা কষ্টকর। অনেক কষ্টে হাট থেকে তিনটি ছোট মাছ কিনে আনলেও, কে দুটি খাবে আর কে একটি—তা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে জেদ শুরু হয়। এত বড় অভাব যে, এমন ছোট একটি বিষয় নিয়েও তারা তর্কে জড়িয়ে পড়ে।
এই গল্পে দারিদ্র্য, অর্থকষ্ট, জীবিকার সংকট, হস্তশিল্পের অবমূল্যায়ন ও গ্রামীণ জীবনের কষ্ট স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তাঁতির মতো অনেক শিল্পী ও শ্রমজীবী মানুষ কলকারখানার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। তারা শুধু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে। এভাবেই ‘জিদ’ গল্পে এক কঠিন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে।
প্রশ্ন ৩। ক. কবর থেকে উঠে তাঁতি যখন ‘বলে, ‘তুই দুইটা খা, আমি একটা খাব’- তখন কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? | ৩ |
খ. “অনাবশ্যক জেদ যে মানুষের জীবনকে জটিল করে তোলে এবং অন্যকেও সমস্যায় ফেলে”- এই সত্য ‘জিদ’ গল্পটিতে কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে আলোচনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ তাঁতি ও তাঁর বউ জেদের কারণে দীর্ঘ সময় কথা বলেনি। সবাই ভাবল তারা মারা গেছে। তাদের গোসল করিয়ে, কাফন পরিয়ে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কবর খুঁড়ে তাদের শোয়ানো হয়, এমনকি বাঁশের ওপর মাটি ফেলা শুরু হয়। ঠিক তখনই তাঁতি লাফিয়ে উঠে বলে, “তুই দুইটা খা, আমি একটা খাব।” এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভয় পেয়ে যায়। তারা ভাবে, মরা লোক কথা বলছে, মানে নিশ্চয় ভূত হয়ে গেছে। দুজন কবর খননকারী ও মোল্লা সাহেব ভয়ে দৌড়ে পালায়। এমন মজার ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গল্পে এই অংশটি হাস্যরসের মাধ্যমে মানুষের আচরণ ও ভয়ভীতিকে তুলে ধরে।
খ) উত্তরঃ ‘জিদ’ গল্পে জসীমউদ্দীন অনাবশ্যক জেদের ফলে মানুষের জীবনে যেসব জটিলতা ও সমস্যার সৃষ্টি হয়, তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। গল্পের প্রধান চরিত্র তাঁতি ও তাঁর বউ অভাবের মধ্যেও শান্তি ও সুখে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনটি ছোট মাছ নিয়ে কে কয়টা খাবে, তা নিয়ে তারা একে অপরের সঙ্গে তর্ক শুরু করে। দুজনেই একে অপরের কথা বুঝতে চায় না, মানতে চায় না। তাদের জেদ এতটা বাড়ে যে, তারা সারাদিন কথা না বলে একসঙ্গে বসেও একে অপরের মুখেই কথা বলতে চায় না। তাদের এই অনাবশ্যক জেদের কারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় এবং তাদের সম্পর্কও প্রভাবিত হয়।
তাদের এই জেদ পাড়া-প্রতিবেশীদের ভুল বোঝাবুঝিতে ফেলে দেয়। প্রতিবেশীরা ভাবতে শুরু করে তাঁতি ও তাঁর বউ মারা গেছেন এবং তাঁদের দাফনের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন পরিস্থিতিতে দুজনের মধ্যে থাকা একটুখানি ভালোবাসা বা সম্পর্কের বন্ধনও প্রায় হারিয়ে যেতে বসে।
কিন্তু শেষে যখন তাঁতি কবর থেকে উঠে বলে, “তুই দুইটা খা, আমি একটা খাব,” তখন বোঝা যায়, তাদের মধ্যে মূলে ভালোবাসা ও মমতা এখনও আছে। গল্পের এই অংশটি দেখায়, অহেতুক জেদ ও গোঁড়া মনোভাব মানুষের জীবনকে কতটা জটিল করে তোলে, সম্পর্ককে দূরত্বে নিয়ে যায় এবং নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও সমস্যায় ফেলতে পারে।
আরও পড়ুনঃ তোতা কাহিনী গল্পের মূলভাব, বিষয়বস্তু ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর