জাগো তবে অরণ্য কন্যারা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা

সুফিয়া কামাল ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’কবিতায় ক্ষুধা ও দুঃখময় সমাজে প্রকৃতিকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃতিই মানুষের জীবনে খাদ্য, আলো ও আনন্দ এনে দিতে পারে। এই পোস্টে জাগো তবে অরণ্য কন্যারা কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যা লিখে দিলাম।

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা কবিতার মূলভাব

সুফিয়া কামাল তাঁর ‘জাগো তবে অরণ্য কন্যারা’ কবিতায় বলেছেন, আগে মৌসুমি ফুলের গান তাঁর কণ্ঠে জাগত, কিন্তু এখন আর জাগে না। চারপাশে কেবল ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার তিনি শুনতে পান। ফুলের ফসল নেই, মানুষের মুখে আর গান নেই, সবাই ভয় ও দুঃখে ভরা। ক্ষুধার্ত মানুষের প্রাণহীন দৃষ্টি কবির হৃদয়কে কষ্ট দেয়। কবি দেখেন, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, মাটি চেয়ে থাকে অরণ্যের দিকে। অরণ্যের ছায়া, স্নেহ আর সবুজ পল্লব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই কবি অরণ্য কন্যাদের উদ্দেশে আহ্বান জানান “জাগো, তোমরা জেগে ওঠো।” তিনি বলেন, বৃক্ষের বুকে লুকানো আগুন যেন জ্বলে উঠুক। অরণ্যকন্যারা যেন আগুনের শিখার মতো জেগে ওঠে। তাঁদের শক্তি দিয়ে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে হবে। তাঁরা যেন ছন্দে ছন্দে, কণ্ঠে কণ্ঠে মানুষকে নতুন করে জাগায়। পৃথিবীতে যেন আবার ফুলের ফসল ফিরে আসে, ক্ষুধার্তরা খাদ্য পায়। মানুষের আত্মায় আনন্দ ফিরে আসুক, জীবনে আলো ছড়াক। কবি বিশ্বাস করেন, অরণ্যের জাগরণেই অন্ধকার কেটে যাবে। বৃক্ষরাজি মানুষের জন্য খাদ্য, ফুল, ফসল ও প্রাণ বয়ে আনবে। আর মানুষের বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে প্রকৃতির সবুজ ছায়াতলে।

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা কবিতার ব্যাখ্যা

মৌসুমি ফুলের গান মোর কণ্ঠে জাগে নাকো আর

চারিদিকে শুনি হাহাকার ।

কবি বলছেন, আগে তাঁর কণ্ঠে মৌসুমি ফুলের গান জাগত, মানে তিনি আনন্দে, সৌন্দর্যে ভরে উঠতেন। কিন্তু এখন আর সেই গান তাঁর কণ্ঠে জাগে না। কারণ চারদিকে শুধু হাহাকার মানুষের দুঃখ, কষ্ট আর অসহায়তার আর্তনাদই তিনি শুনতে পান।

ফুলের ফসল নেই, নেই কারও কণ্ঠে আর গান

ক্ষুধার্ত ভয়ার্ত দৃষ্টি প্রাণহীন সব মুখ স্নান ।

চারদিকে আর ফুলের ফসল নেই, নেই সৌন্দর্য বা প্রাচুর্যের চিহ্ন। কারও কণ্ঠে আর গান শোনা যায় না, কারণ মানুষ ক্ষুধার কষ্টে কাতর। ক্ষুধার্ত মানুষের চোখে শুধু ভয় আর শঙ্কা, তাদের মুখ প্রাণহীন ও বিবর্ণ। অর্থাৎ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে মানুষের জীবনে আনন্দ-সৌন্দর্য, গান-বাজনা সব হারিয়ে গেছে।

মাটি অরণ্যের পানে চায়

সেখানে ক্ষরিছে স্নেহ পল্লবের নিবিড় ছায়ায়।

চারদিকের শুকনো, নির্জীব মাটি অরণ্যের দিকে চেয়ে থাকে। কারণ সেখানে আছে সবুজ গাছপালার স্নেহময় ছায়া, আছে পল্লবের (পাতার) নিবিড় আশ্রয়। শুকনো মাটিও যেন প্রাণ পেতে চায় সেই অরণ্যের স্নেহে। অর্থাৎ, প্রাণহীন পৃথিবী বাঁচতে হলে অরণ্যের সবুজ ছায়ার প্রয়োজন।

জাগো তবে অরণ্য কন্যারা ! জাগো আজি,

মর্মরে মর্মরে ওঠে বাজি

কবি বৃক্ষরাজিকে ‘অরণ্য কন্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশে আহ্বান জানাচ্ছেন— হে অরণ্য কন্যারা, তোমরা জাগো, আজই জাগো! চারপাশে মানুষের দুর্দশা, অভাব, দুঃখ আর হাহাকার। তাই গাছেদের জেগে ওঠা দরকার। কবি কল্পনা করেন, গাছেরা জেগে উঠলে পাতার মর্মর ধ্বনিতে যেন সারা পৃথিবী কেঁপে ওঠে, বাজনার মতো ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, কবি চান বৃক্ষরাজি জেগে উঠে পৃথিবীতে প্রাণ ও আশার সুর ছড়িয়ে দিক।

বৃক্ষের বক্ষের বহ্নিজ্বালা

মেলি লেলিহান শিখা তোমরা জাগিয়া ওঠো বালা!

বৃক্ষের বুকের ভেতরে যে আগুনের মতো শক্তি, প্রাণশক্তি ও জ্বালা লুকিয়ে আছে, সেটাকে বাইরে প্রকাশ করো। তোমরা যেন লেলিহান শিখার মতো দীপ্ত হয়ে ওঠো। তিনি গাছেদের বালা (কিশোরী কন্যা)-রূপে কল্পনা করেছেন এবং তাঁদের জেগে উঠে পৃথিবীকে জীবন, আলো ও শক্তি দিতে বলেছেন। অর্থাৎ, বৃক্ষের ভেতরের অদম্য শক্তি জাগিয়ে তুলেই পৃথিবীর অন্ধকার দুর্দশা দূর করা সম্ভব।

কঙ্কণে তুলিয়া ছন্দ তান

জাগাও মুমূর্ষু ধরা-প্রাণ

কবি অরণ্যকন্যাদের উদ্দেশ্যে বলছেন, তোমরা তোমাদের কঙ্কণ (হাতের অলঙ্কার) তুলো, তার থেকে যেন ছন্দময় ঝংকার ওঠে। সেই ঝংকারে, সেই সুরের তালে তালে মৃতপ্রায় (মুমূর্ষু) পৃথিবীর প্রাণকে জাগিয়ে তোলো। অর্থাৎ, কবি চান বৃক্ষেরা যেন জীবনের সুর তোলে, শক্তি ও আনন্দ ছড়িয়ে পৃথিবীর ক্লান্ত, দুঃখভারাক্রান্ত প্রাণকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে।

ফুলের ফসল আনো, খাদ্য আনো ক্ষুধার্তের লাগি

আত্মার আনন্দ আনো, আনো যারা রহিয়াছে জাগি

কবি অরণ্যকন্যাদের আহ্বান জানাচ্ছেন, তোমরা ফুলের ফসল এনে দাও, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য জোগাও। শুধু শরীরের আহার নয়, আত্মার জন্যও আনন্দ এনে দাও। যারা এখনো আশা নিয়ে বেঁচে আছে, তাদের জীবনে তোমরা সুখ ও শান্তি ফিরিয়ে দাও। বৃক্ষরাজি শুধু প্রকৃতিকে সুন্দর করে না, তারা মানুষের খাদ্য ও মানসিক আনন্দের উৎসও। তাই অরণ্য ধ্বংস না করে আবার গড়ে তুলতে হবে।

তিমির প্রহর ভরি অতন্দ্র নয়ন, তার তরে

ছড়াও প্রভাত আলো তোমাদের মুঠি ভরে ভরে ।

কবি বলছেন, পৃথিবী যেন অন্ধকার (তিমির) সময় পার করছে। সেই অন্ধকারে অনেকেই জেগে আছে (অতন্দ্র নয়ন), আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে আলোর জন্য। তাই অরণ্যকন্যাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলছেন, তোমরা তোমাদের মুঠি ভরে ভরে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে দাও। যাতে এই আঁধার কেটে যায় এবং নতুন দিনের সূচনা হয়।

Related Posts

Leave a Comment