কিং লিয়ার গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ শুধু একটি রাজা ও তার কন্যাদের সম্পর্কের কাহিনি নয়—এটি ভালোবাসা, কর্তব্য, তোষামোদ, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতা ও অনুশোচনার এক অনন্য মানবিক উপাখ্যান। এই পোস্টে ৭ম শ্রেণির আনন্দপাঠের কিং লিয়ার গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর দিলাম।

কিং লিয়ার গল্পের মূলভাব

রাজা লিয়ার বয়স হলে তিনি রাজ্য শাসনের ভার থেকে অবসর নিতে চান। তাই তিন মেয়েকে ডেকে জানতে চান, কে তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বড় মেয়ে গনেরিল ও মেজো মেয়ে রিগান মুখে মুখে প্রশংসা করে এবং রাজা খুশি হয়ে তাদের রাজ্যের দুই ভাগ দিয়ে দেন। ছোট মেয়ে কর্ডেলিয়া সত্য কথা বলে—সে পিতাকে ভালোবাসে ঠিক যতটা একজন কন্যার উচিত, তোষামোদ করে না। এতে রাজা রেগে গিয়ে কর্ডেলিয়াকে ত্যাগ করেন এবং তার প্রাপ্য অংশও দুই বোনকে দিয়ে দেন। কর্ডেলিয়া ফ্রান্সের রাজপুত্রকে বিয়ে করে চলে যায়। পরে গনেরিল ও রিগান আসল রূপ দেখাতে শুরু করে—তারা রাজাকে অসম্মান করে, তাঁর সহচরদের অপছন্দ করে এবং তাঁকে দূরে ঠেলে দেয়। রাজা কষ্টে পড়ে যান, মানসিক ভারসাম্য হারান। এই দুঃসময়ে কেবল বিদূষক ও ছদ্মবেশী কেন্ট তাঁর পাশে থাকে। রাজা ঝড়বৃষ্টিতে পথের মাঝে আশ্রয় নেন এবং প্রায় পাগল হয়ে পড়েন। কর্ডেলিয়া খবর পেয়ে সৈন্য নিয়ে ফিরে আসেন, পিতাকে খুঁজে বার করে সেবা করতে থাকেন। লিয়ার অবস্থা একটু ভালো হতে থাকে। কিন্তু গনেরিল ও রিগান তাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধ করে এবং কর্ডেলিয়া বন্দি হয়ে মারা যান। রাজা এই শোকে ভেঙে পড়েন এবং শেষে মারা যান। কাহিনির শেষ পরিণতি অত্যন্ত করুণ ও বেদনাদায়ক। এটি ভালোবাসা, সত্যবাদিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক গভীর ট্র্যাজেডি।

কিং লিয়ার গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্ন ১। ক. এত কম তোমার বয়স, এখনই এমন কঠিন তোমার মন?” কথাটি কে, কাকে, কেন বলেছেন?
খ. কিং লিয়ার কীভাবে নিজের জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিলেন? বিশ্লেষণ কর।

ক) উত্তরঃ “এত কম তোমার বয়স, এখনই এমন কঠিন তোমার মন?”—এই কথাটি রাজা লিয়ার বলেছেন তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা কর্ডেলিয়াকে। রাজা লিয়ার তাঁর তিন মেয়েকে রাজ্য ভাগ করে দেওয়ার আগে জানতে চান, কে তাঁকে কত ভালোবাসে। বড় দুই মেয়ে গনেরিল ও রিগান মুখে মুখে খুব প্রশংসা করে, কিন্তু কর্ডেলিয়া সত্য কথা বলে—সে বলে, সে পিতাকে ঠিক যতখানি ভালোবাসা কর্তব্য, ততটাই ভালোবাসে। এতে রাজা চটে যান, কারণ তিনি আশা করেছিলেন কর্ডেলিয়াও বাকি দুই বোনের মতো চাটুকারিতা করবে। কর্ডেলিয়ার সরল ও সৎ কথাকে তিনি কঠোরতা মনে করেন। তাই তিনি কষ্ট পেয়ে রেগে গিয়ে বলেন, “এত কম তোমার বয়স, এখনই এমন কঠিন তোমার মন?” তিনি মনে করেন, অল্প বয়সেই কর্ডেলিয়া হঠাৎ গর্বিত ও অমান্যকারী হয়ে উঠেছে। এই কথার মাধ্যমে রাজা লিয়ার কর্ডেলিয়ার সৎ ও নির্লিপ্ত মনোভাবকে ভুলভাবে কঠোরতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

খ) উত্তরঃ রাজা লিয়ার নিজের ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই তাঁর জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে আনেন। বৃদ্ধ বয়সে রাজ্য শাসনের ভার তিনি ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা করার সময় তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি। তিনি তাঁর তিন মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, কে তাঁকে কত ভালোবাসে। গনেরিল ও রিগান মিথ্যা প্রশংসা করে রাজাকে খুশি করে, আর কর্ডেলিয়া সত্য কথা বলে—সে তোষামোদ করে না। রাজা এতে রেগে গিয়ে কর্ডেলিয়াকে ত্যাগ করেন এবং রাজ্যের সব সম্পত্তি দুই বড় মেয়েকে দিয়ে দেন। অথচ কর্ডেলিয়াই তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে রাজা তাঁর ক্ষমতা হারান এবং নির্ভর করতে বাধ্য হন দুই কন্যার ওপর, যারা তাঁকে অবজ্ঞা করে, অসম্মান করে এবং শেষ পর্যন্ত বিতাড়িত করে। রাজা তখন হতাশায় ও দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি ঝড়বৃষ্টির রাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, প্রাসাদ থেকে প্রাসাদে ঠাঁই খোঁজেন। এই দুঃসময়ে কেবল কর্ডেলিয়া, কেন্ট ও বিদূষক তাঁর পাশে থাকে। কর্ডেলিয়া ফিরে এসে তাঁকে খুঁজে পায় এবং সেবা করে সুস্থ করে তোলে। কিন্তু যুদ্ধের পর কর্ডেলিয়াকে হত্যা করা হয়, যা রাজাকে পুরোপুরি ভেঙে দেয়। তিনি মেয়ের মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু বরণ করেন। এইভাবে নিজের আবেগপ্রবণতা, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য না বোঝা এবং অহংকারের জন্য রাজা লিয়ার নিজের জীবনকে ধ্বংস করে ফেলেন। তাঁর জীবনের শেষ পরিণতি হয় অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক।


প্রশ্ন ২। ক. রাজা লিয়ারের কন্যা কর্ডেলিয়াকে ত্যাজ্য করার সিদ্ধান্তটি কেমন ছিল? ব্যাখ্যা কর।
খ. “কর্ডেলিয়া রমণীকূলে রত্নস্বরূপ- কর্ডেলিয়া চরিত্রের বিভিন্ন দিকনির্দেশনাপূর্বক মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।

ক) উত্তরঃ রাজা লিয়ারের কর্ডেলিয়াকে ত্যাজ্য করার সিদ্ধান্তটি একেবারেই অন্যায়, আবেগপ্রবণ ও ভ্রান্ত ছিল। কর্ডেলিয়া মিথ্যা প্রশংসা না করে পিতাকে সৎ ও সংযতভাবে ভালোবাসার কথা বলেছিল। সে তোষামোদ না করায় রাজা রেগে গিয়ে তার প্রাপ্য রাজ্যও কেড়ে নেন। অথচ কর্ডেলিয়াই ছিল সবচেয়ে বিশ্বস্ত, শ্রদ্ধাশীলা এবং কর্তব্যপরায়ণ কন্যা। রাজা লিয়ারের এই সিদ্ধান্ত ছিল অবিবেচক, কারণ তিনি সত্যকে চিনতে পারেননি। কেবল মুখের কথায় বিশ্বাস করে তিনি ভুল মেয়েদের হাতে রাজ্য তুলে দেন। এই ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই তাঁর জীবনে দুঃখ, অপমান ও মৃত্যু ডেকে আসে। পরে রাজা নিজেও বুঝতে পারেন তিনি কর্ডেলিয়ার সঙ্গে ভীষণ অবিচার করেছেন।

খ) উত্তরঃ কর্ডেলিয়া রাজা লিয়ারের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা হলেও সে ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, সৎ এবং আদর্শবান। তার চরিত্রে বিনয়, সত্যবাদিতা ও আত্মমর্যাদাবোধ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যখন রাজা লিয়ার মেয়েদের ভালোবাসার প্রতিযোগিতা করান, কর্ডেলিয়া মিথ্যা প্রশংসা করতে অস্বীকার করে। সে আবেগের চেয়ে বাস্তব ভালোবাসাকে গুরুত্ব দেয়। এই কারণে রাজা লিয়ার রাগের মাথায় তাকে ত্যাজ্য করেন। কিন্তু কর্ডেলিয়া তার বাবার প্রতি ভালোবাসা ভুলে যায়নি।

পরে যখন রাজা লিয়ার নিজের ভুল বুঝতে পারেন ও দুঃখের জীবন যাপন করতে থাকেন, তখন কর্ডেলিয়া বিদেশ থেকে ফিরে আসেন এবং বাবাকে উদ্ধার করেন। এই আত্মত্যাগ ও দায়িত্ববোধ কর্ডেলিয়াকে মহান করে তোলে। সে প্রতিশোধের কথা না ভেবে ক্ষমা, সহানুভূতি ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। কর্ডেলিয়ার মধ্যে আদর্শ নারীর সব গুণ আছে—তিনিই যেন সত্যিকারের রমণীকুলের রত্ন। তিনি দৃঢ়চেতা, নীতিবান ও সহনশীল। দুর্যোগে, অন্যায়ে এবং ত্যাগে তার চরিত্রের দৃঢ়তা ও মহত্ত্ব ফুটে ওঠে। তাই কর্ডেলিয়া চরিত্রটি শুধু নাটকের নয়, সাহিত্য-ইতিহাসেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত।


প্রশ্ন ৩। ক. “অন্তঃসারশূন্য তোষামোদবাক্যই আপনার কাছে বেশি মূল্য পেল?”- কথাটি কে, কাকে বলেছে? কথাটি সে কেন বলেছে? ব্যাখ্যা কর।
খ. “গনেরিল হলো তোষামুদে, স্বার্থান্বেষী ও প্রতারক চরিত্রের”-এই মন্তব্যের যথার্থতা বিচার করে যুক্তিসহ প্রমাণ কর।

ক) উত্তরঃ “অন্তঃসারশূন্য তোষামোদবাক্যই আপনার কাছে বেশি মূল্য পেল?”—এই কথাটি আর্ল অব কেন্ট বলেছেন রাজা লিয়ারকে। তিনি রাজার কাছে বলেছিলেন, কারণ রাজা তাঁর সত্যবাদী কন্যা কর্ডেলিয়ার প্রতি অন্যায় করছিলেন আর মিথ্যা প্রশংসা করা দুই কন্যাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। কেন্ট এই কথা বলেছিল রাজার অবস্থা বোঝানোর জন্য যে, সত্যি ভালোবাসা না দেখে কেবল মিষ্টি ও ফাঁকা কথার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া ভুল। এটি রাজার দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচারবোধের ত্রুটি প্রকাশ করে।

খ) উত্তরঃ গনেরিলের চরিত্র তোষামোদী, স্বার্থান্বেষী এবং প্রতারক বলে বলা হয় কারণ সে রাজা লিয়ারের প্রতি মিথ্যা প্রশংসা করে রাজ্য পাওয়ার চেষ্টা করে। সে তার বাবাকে মিথ্যে বলতে ভয় পায় না এবং শুধু নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য চাটুকারী করে। গনেরিল রাজা লিয়ারের প্রতি যত্ন ও শ্রদ্ধা দেখানোর বদলে তার ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে নিজের জন্য শক্তি অর্জন করে। একবার রাজ্য পাওয়ার পর সে বাবার প্রতি অবজ্ঞা দেখায়, তাঁর সৎ সহচরদের অপমান করে এবং রাজাকে দূরে ঠেলে দেয়। গনেরিলের এই আচরণ প্রকাশ করে তার স্বার্থপর ও কর্তৃত্বপ্রিয় মনোভাব। সে শুধু নিজের লোভ পূরণ করতে রাজা লিয়ারের অনুভূতি ও সম্মানকে মূল্য দেয় না। তাই গনেরিলকে তোষামোদী ও প্রতারক বলা যথার্থ, কারণ সে নিজের মিথ্যা ভালোবাসা দিয়ে বাবাকে ঠকিয়ে শেষ পর্যন্ত তার পতনের কারণ হয়।


Related Posts

Leave a Comment