‘কাবুলের শেষ প্রহরে’ ভ্রমণ-কাহিনীর অংশে লেখক বিদায়ের বেদনা ও মানবিক সম্পর্কের গভীরতা ফুটিয়ে তুলেছেন। লেখক আবদুর রহমানের প্রতি এক অসীম কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। এই পোস্টে ৮ম শ্রেণির আনন্দপাঠের কাবুলের শেষ প্রহরে মূলভাব ও বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
কাবুলের শেষ প্রহরে মূলভাব
সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের কাবুলে শিক্ষা বিভাগের চাকরিতে কর্মরত ছিলেন। দেশ ছাড়ার আগের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তাঁর মনে পড়ল প্রিয় গৃহপরিচারক আবদুর রহমানের কথা। আবদুর রহমান প্রতিদিনের মতো রুটি, মামলেট, পনির ও চা নিয়ে এলেও আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। লেখক জানলেন, তাঁকে মাত্র দশ পাউন্ডের মালপত্র নিয়ে যেতে দেওয়া হবে। তিনি কী নিয়ে যাবেন আর কী রেখে যাবেন—এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভীষণ কষ্ট অনুভব করেন। তাঁর সংগ্রহে থাকা রাশান অভিধান, চীনা ভাজ জুতা ও ছোটখাটো টুকিটাকি জিনিস তাঁর জীবনের অমূল্য স্মৃতি হয়ে উঠেছিল। তিনি বুঝলেন, এগুলো তাঁর কাছে মূল্যবান হলেও অন্যদের কাছে তা তুচ্ছ। আবেগে ভরে গিয়ে লেখক আবদুর রহমানকে সব কিছু দিয়ে দেন। লেখকের প্রতি আবদুর রহমানের ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, তিনি লেখকের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। বিদায় মুহূর্তে আবদুর রহমান লেখককে খোদার হাতে সঁপে দিয়ে বারবার বলতে থাকেন, “ব খুদা সম্পূর্দমৎ, সায়েব”। টেনিস র্যাকেট, যেটি লেখক কাউকে ছুঁতেও দিতেন না, সেটিও আবদুর রহমান নিজ হাতে নিয়ে এসেছিল। লেখক বুঝলেন, আবদুর রহমান সেটিকে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মনে করেছিল। প্লেন ছাড়ার সময় লেখক আবদুর রহমানের শেষ চিৎকার শুনতে পান—“সম্পূর্দমৎ!” লেখকের মনে পড়ে যায়, প্রবাসজীবনের প্রথম পরিচয়ের মানুষ আবদুর রহমানই শেষ বিদায়ের সাথী হলো। তিনি অনুভব করেন, আবদুর রহমান তাঁর জীবনের এক প্রকৃত বন্ধু। শেষ দৃশ্যে লেখক জানালা দিয়ে দেখেন, আবদুর রহমান শুভ্র বরফঢাকা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। যদিও তাঁর পাগড়ি ছিল ময়লা, লেখকের কাছে তা বরফের চেয়েও বেশি শুভ্র মনে হয়। কারণ, আবদুর রহমানের হৃদয় ছিল পবিত্র ও বিশুদ্ধ। এই বন্ধুত্ব ও বিদায়ের দৃশ্য পাঠকের মনে গভীর আবেগ জাগিয়ে তোলে।
কাবুলের শেষ প্রহরে বর্ণনামূূলক প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১। ক. আফগানিস্তানে লেখকের উচ্চপদস্থ অনেক বন্ধু থাকলেও তিনি কেন আবদুর রহমানকেই পরম বান্ধব বলে স্বীকৃতি দেন? | ৩ |
খ. চতুর্দিকের বরফের চেয়েও আবদুর রহমানের পাগড়ি ও হৃদয়কে লেখকের অধিক শূদ্রতর কেন মনে হচ্ছে? ‘কাবুলের শেষ প্রহরে’ গল্পের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ যদিও লেখকের আফগানিস্তানে অনেক উচ্চপদস্থ বন্ধু ছিল, তবুও তিনি আবদুর রহমানকেই প্রকৃত বন্ধু হিসেবে দেখেছেন। কারণ, আবদুর রহমান শুধু একজন গৃহপরিচারক ছিল না, ছিল একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। লেখক যখন রাগ করতেন, তখনও আবদুর রহমান কিছু মনে করত না। বিদায়ের সময় আবদুর রহমান তাঁর প্রতি গভীর আবেগ দেখায়। লেখকের পায়ের কাছে বসে সে কাঁদতে থাকে, লেখকের হাতে চুমু খায়। সে লেখকের প্রিয় জিনিস, যেমন টেনিস র্যাকেট, ভালোবাসা দিয়ে তুলে আনে। লেখকের যাবার সময় সে খোদার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে—“ব খুদা সম্পূর্দমৎ, সায়েব।” আবদুর রহমান বিপদে-আপদে, রাষ্ট্রবিপ্লবেও পাশে ছিল। লেখক অনুভব করেন, জীবনের সব পরীক্ষায় আবদুর রহমান একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো পাশ করেছে। তাই তিনি আবদুর রহমানকেই পরম বান্ধব বলে স্বীকৃতি দেন।
খ) উত্তরঃ ‘কাবুলের শেষ প্রহরে’ গল্পের শেষ দৃশ্যে লেখক প্লেন থেকে জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন চারপাশে বরফে ঢাকা এয়ারফিল্ড। সে শুভ্র বরফের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আবদুর রহমান। তার মাথায় পাগড়ি, যা বহুদিন ধোয়া হয়নি বলে ময়লা হয়ে গেছে। কিন্তু লেখকের চোখে সেই পাগড়ি বরফের চেয়েও বেশি সাদা বা পবিত্র মনে হয়। কারণ, আবদুর রহমানের হৃদয় ছিল একেবারে নির্মল ও নিঃস্বার্থ। সে লেখককে অনেক ভালোবাসত, কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই। লেখকের প্রতি তার আন্তরিকতা ছিল নিঃস্বার্থ এবং আত্মিক। বিদায়ের মুহূর্তে সে বারবার খোদার কাছে প্রার্থনা করে বলছিল, “ব খুদা সম্পূর্দমৎ, সায়েব”, অর্থাৎ “আপনাকে খোদার হাতে তুলে দিলাম।” এই দৃশ্য লেখককে গভীরভাবে আবেগে ভরিয়ে দেয়। প্লেন ছাড়ার সময়ও লেখক আবদুর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পান। লেখক বুঝতে পারেন, আবদুর রহমান শুধু একজন চাকর নয়, বরং একজন আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে সে এক বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে পাশে ছিল। তার ভালোবাসা ছিল এতটাই খাঁটি যে, তার পুরোনো ও মলিন পাগড়িটিও লেখকের চোখে পবিত্র হয়ে ওঠে। সেই পাগড়ির ভাঁজে যেন জমা ছিল ভালোবাসা, ভক্তি ও হৃদয়ের গভীর টান। তাই লেখকের কাছে চারপাশের প্রকৃতির চেয়ে আবদুর রহমানের পাগড়ি ও হৃদয় অধিক শুভ্র বলে মনে হয়। বরফের সাদা রঙ শুধু বাহ্যিক, কিন্তু আবদুর রহমানের ভালোবাসা ছিল হৃদয়ের গভীরতা থেকে উৎসারিত। এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ত্যাগই তাকে লেখকের চোখে অসাধারণ করে তোলে। এই জন্যই লেখকের মনে হয়, আবদুর রহমানের হৃদয়ই সবচেয়ে শুভ্র, সবচেয়ে পবিত্র।
প্রশ্ন ২। ক. “আমাকে সে তাঁরই হাতে সঁপে দিয়েছে।”- কথাটি কে কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে? কেন বলেছে? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. একজন বিদেশি গৃহপরিচারকের সাথে লেখকের মানবিক সম্পর্কের যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তা তোমার নিজের ভাষায় উপস্থাপন কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ “আমাকে সে তাঁরই হাতে সঁপে দিয়েছে”—এই কথাটি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী আবদুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। লেখক যখন প্লেনে উঠছেন, তখন আবদুর রহমান বারবার বলছিল, “ব খুদা সম্পূর্দমৎ, সায়েব।” এর অর্থ, “আপনাকে খোদার হাতে তুলে দিলাম।” আবদুর রহমান হাওয়াই জাহাজকে খুব ভয় পেত। তাই সে প্রিয় মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য খোদার কাছে বারবার প্রার্থনা করছিল। লেখকের মনে হয়েছিল, আবদুর রহমান শুধু মুখে বলছে না, সত্যিই সে তাঁর প্রিয় মানুষটিকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিচ্ছে। এই কথা লেখকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। বিদায়ের এমন মুহূর্তে এই কথা লেখকের মনে গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জাগিয়ে তোলে। তাই লেখক বলেন, “আমাকে সে তাঁরই হাতে সঁপে দিয়েছে।”
খ) উত্তরঃ সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘কাবুলের শেষ প্রহরে’ গল্পে লেখকের সঙ্গে একজন বিদেশি গৃহপরিচারক আবদুর রহমানের যে মানবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা সত্যিই অসাধারণ। আবদুর রহমান ছিল লেখকের গৃহপরিচারক হলেও সে কেবল একজন চাকর ছিল না, ছিল এক নিঃস্বার্থ ও বিশ্বস্ত সঙ্গী। লেখক তাকে প্রায়ই বকাঝকা করতেন, কিন্তু আবদুর রহমান কখনো তা মনেও নিত না। সে সব সময় লেখকের ভালো চাইত এবং দায়িত্ব নিয়ে তার কাজ করত। লেখকের দেশত্যাগের সময় আবদুর রহমানের চোখে জল আসে, সে লেখকের পায়ে বসে পড়ে এবং তাঁর হাত চুমো খায়। লেখক তাকে সব কিছু দিয়ে দেন, এমনকি ক্ষমা চান। আবদুর রহমান লেখকের প্রিয় টেনিস র্যাকেটটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে আসে, কারণ সে জানত এটি লেখকের কত প্রিয়। লেখকের চলে যাওয়ার সময় সে বারবার খোদার কাছে প্রার্থনা করে বলেন, “ব খুদা সম্পূর্দমৎ, সায়েব।” লেখক অনুভব করেন, আবদুর রহমান তাঁর জীবনসঙ্গী, যিনি উৎসব, বিপদ, দুঃখ সব সময় পাশে থেকেছে। একজন সাধারণ কর্মচারীর সঙ্গে এমন হৃদ্যতা লেখককে মুগ্ধ করে। লেখক বুঝে যান, সম্পর্কের জন্য জাত-ধর্ম, ভাষা বা দেশের কোনো সীমা নেই—ভালোবাসাই বড়। আবদুর রহমানের আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ লেখকের মনে গেঁথে যায়। এই সম্পর্ক শুধু কাজের নয়, বরং মানবতার, ভালোবাসার আর আত্মার সম্পর্ক। এ থেকেই বোঝা যায়, মানবিকতা সব সম্পর্কের চেয়ে বড়। এই গৃহপরিচারকই লেখকের জীবনের অন্যতম প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন ৩। ক. প্রত্যেক বিদায় গ্রহণে রয়েছে খন্ড-মৃত্যু”- কথাটি কীসের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে? ব্যাখ্যা কর। | ৩ |
খ. ‘কাবুলের শেষ প্রহরে’ ভ্রমণকাহিনিটির মূল বিষয়বস্তু তোমার নিজের ভাষায় তুলে ধর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ “প্রত্যেক বিদায় গ্রহণে রয়েছে খণ্ড-মৃত্যু” কথাটি লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগানিস্তান ত্যাগের সময়ের অনুভূতির প্রকাশ। তিনি বুঝতে পারেন, যখন কেউ ভালো মানুষ বা প্রিয়জনকে বিদায় দেয়, তখন হৃদয়ের এক অংশ যেন মরে যায়। দেশ ত্যাগ করাটা সহজ কথা নয়। যে মানুষগুলোর সঙ্গে লেখকের গভীর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে, তাদের সবাইকে ছেড়ে যাওয়া মানে নিজের সত্তাকে কিছু অংশ হারানো। প্রত্যেক বিদায়ই এক ধরনের ক্ষতি বা মৃত্যু, কারণ তা যন্ত্রণাদায়ক এবং স্মৃতিতে গেঁথে থাকে। বিদায়ের সময় লেখকের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়, আবদুর রহমানের মতো বান্ধবকে ছেড়ে যাওয়া তার জীবনের বড় ক্ষতি। তাই ফরাসি কথাটি দিয়ে লেখক বিদায়ের বেদনাকে সুন্দরভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। এই কথায় বিদায়ের দুঃখ, স্মৃতি ও ভালোবাসার মিশ্রণ লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ, প্রতিটি বিদায় মানে হৃদয়ের একাংশের মৃত্যু।
খ) উত্তরঃ উপরে দেওয়া আছে।