আবুল মনসুর আহমদের ‘আদুভাই’ গল্পটি একজন অদ্ভুত ছাত্র আদু মিয়ার জীবন ও প্রমোশন পাওয়ার আকুল আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে রচিত। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে ক্লাস সেভেনে পড়েন, কিন্তু কখনোই পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে পারেন না। এই পোস্টে ষষ্ঠ শ্রেণির আনন্দপাঠের আদু ভাই গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
আদু ভাই গল্পের মূলভাব
আবুল মনসুর আহমদের ‘আদুভাই’ গল্পটি আমাদের স্কুলের সবচেয়ে আলোচিত ও মজার চরিত্র আদুভাইকে নিয়ে লেখা। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে শুধুই ক্লাস সেভেনে পড়তেন না, বরং যেন ক্লাসটিকেই নিজের বাসস্থান বানিয়ে ফেলেছিলেন। কেউ জানত না তিনি কত বছর ধরে একই ক্লাসে আছেন, এমনকি অনেক শিক্ষকও না, কারণ কেউ কেউ তো একসময় তার সহপাঠী ছিলেন! প্রতিদিন তিনি শহরতলি থেকে পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতেন—ঝড়, বৃষ্টি কিছুই তাকে থামাতে পারত না। তার উপস্থিতি ছিল এতই নিখুঁত যে প্রতি বছর তিনি “নিয়মিত উপস্থিতি” ও “ভালো চরিত্রের জন্য” পুরস্কার পেতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, একদিন না একদিন নিশ্চয়ই পাকা ছাত্র হয়ে প্রমোশন পাবেন। কেউ নকল করতে বললে তিনি রেগে বলতেন, “জ্ঞান লাভের জন্যই স্কুলে পড়ি, প্রমোশন পাওয়ার জন্য না।”
তিনি নিজেকে কবি ও বক্তা মনে করতেন। সাপ্তাহিক সভায় আবেগময় কবিতা আর বক্তৃতা দিতেন, যেগুলো শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খেত, কিন্তু আদুভাই সেই হাসিকে প্রশংসা ভেবে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতেন। আমি যখন প্রথম ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম, তখনই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি ছিলাম সেরা ছাত্র আর তিনি সবচেয়ে দুর্বল, কিন্তু আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত, স্নেহময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
একদিন আদুভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জানতে পারি, তার ছেলে এবার ক্লাস সেভেনে পাশ করেছে, তাই স্ত্রীর কড়া নির্দেশ—এইবার না হলে স্কুল ছাড়তে হবে। আমি তখন শিক্ষকদের কাছে তার প্রমোশনের জন্য অনুরোধ করি। কিন্তু তার খাতাগুলো দেখে শিক্ষকরাও হতবাক। ফারসির খাতায় বাংলা, অঙ্কে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য, ভূগোলে বলেন পৃথিবী গোল নয়, ইতিহাসে বলেন রাজা-বাদশাহদের কথা অবিশ্বাস্য। ফলে শিক্ষকরা বলেন, এভাবে কোনো ছাত্রকে প্রমোশন দেওয়া যায় না।
হতাশ আদুভাই স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আবেগভরা বক্তৃতা দেন, “আমার ছেলে আমার ক্লাসে! এবার প্রমোশন না পেলে এটাই হবে জীবনের সবচেয়ে বড় লজ্জা!”
কয়েক বছর পর আমি তার কাছ থেকে একটি চিঠি পাই। জানতে পারি, তিনি অবশেষে ক্লাস এইটে উঠেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রমোশনের আনন্দ উপভোগ করার আগেই তিনি মারা যান। তার কবরের ফলকে লেখা ছিল, “এখানে শায়িত আছেন আদুমিঞা, যিনি ক্লাস সেভেন থেকে এইটে প্রমোশন পেয়েছিলেন।”
আদু ভাই গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ১। ক. ‘আদুভাই’ গল্পে ‘বিশেষ শ্রেণি’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? | ৩ |
খ. আদুভাই প্রমোশন পায় না কেন? ব্যাখ্যা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ ‘বিশেষ শ্রেণি’ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ক্লাস সেভেন‑কে। আদুভাই এই শ্রেণিতে পড়তেন এবং আশ্চর্যভাবে একবার নয়, অনেক বছর ধরে তিনি ক্লাস সেভেনে পড়েই ছিলেন। তার কোনো উন্নতি ঘটেনি, আবার স্কুলও তাকে সরাসরি বহিষ্কার করেনি। ফলে তিনি সেই একই শ্রেণিতে পড়ে থেকে গেছেন। গল্পে লেখক ব্যঙ্গ করে বলেছেন, এ যেন এক বিশেষ শ্রেণি, যেখানে সাধারণ নিয়ম চলে না। এই শ্রেণির জন্য নির্দিষ্ট কোনো বই নেই, পরীক্ষার প্রশ্ন নেই, এমনকি ফলাফলও নেই। আদুভাই নিজেই যেন সেই শ্রেণির একমাত্র ছাত্র, আর স্কুলও যেন তার জন্য সেই শ্রেণি তৈরি করে রেখেছে।
খ) উত্তরঃ আদুভাই প্রমোশন পায় না কারণ তিনি নিয়মমাফিক ভালো নম্বর পাননি। তার পরীক্ষার খাতাগুলোতে অনেক ভুল ও অবাস্তব উত্তর ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ফারসির খাতায় ফারসি ভাষার বদলে বাংলা লেখা ছিল এবং অংকের খাতায় প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কহীন উত্তর ছিল। অন্য বিষয়গুলোর খাতায়ও তিনি সঠিক তথ্য দেননি বা অদ্ভুত কথা লিখেছেন। তাই শিক্ষকেরা তাকে প্রমোশন দেয়ার জন্য যথেষ্ট নম্বর দিতে পারেননি। আদুভাই নম্বর বাড়ানোর জন্য কোনো শিক্ষক বা পরীক্ষকের কাছে আবেদনও করেননি। তার বিশ্বাস ছিল, সব বিষয়ে ভালো হয়ে উঠলেই প্রমোশন পাবেন। কিন্তু এই ধীরে ধীরে উন্নতির কারণে শিক্ষকেরা তাকে একেবারে উপেক্ষা করেছেন। ফলে দীর্ঘ চার বছর ক্লাস সেভেনে আটকে পড়েছেন। তার সততা ও অধ্যবসায় থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা ও নিয়ম-কানুনের কারণে আদুভাই প্রমোশন পেতে পারেননি।
প্রশ্ন ২। ক. স্কুলের কোন দুটি পুরস্কার বারবারই আদুভাই পেতেন? | ৩ |
খ. প্রমোশন পাওয়ার জন্য আদুভাই মরিয়া হয়ে ওঠেন কখন? ব্যাখ্যা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ আদুভাই নিয়মিত দুইটি পুরস্কার পেতেন। প্রথমটি ছিল স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত থাকার পুরস্কার। তিনি সবসময় স্কুলে সবাইকে ছাপিয়ে সবার আগে পৌঁছাতেন এবং একবারও অনুপস্থিত থাকতেন না। বর্ষার ঝড়-বৃষ্টি কিংবা অসুস্থতা—কিছুই তাকে স্কুল থেকে দূরে রাখতে পারত না। তিনি স্কুলে সর্বদা সময়মতো উপস্থিত থাকায় শিক্ষকরা তাকে এ পুরস্কার দিতেন। দ্বিতীয়টি ছিল সচ্চরিত্রের পুরস্কার, অর্থাৎ সৎ ও ভদ্র ছাত্র হওয়ার জন্য সম্মাননা। আদুভাই কখনো রাগ, অভদ্রতা বা মিথ্যে কথা বলতেন না, তাই তিনি সবাইয়ের কাছে সম্মানিত ছিলেন। তার এই ভালো চরিত্রের কারণে বারবার এই পুরস্কার পান।
খ) উত্তরঃ আদুভাই অনেক বছর ধরে ক্লাস সেভেনে আটকে ছিলেন, কিন্তু কখনো প্রমোশন পাওয়ার জন্য জোর দেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধীরে ধীরে ভালো হলে একদিন সবাই তাকে প্রমোশন দেবে। তবে সে দিন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আদুভাই তখনো নিজেকে উৎসাহী ও আশা নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু একদিন জানতে পারলেন তার ছেলে একই ক্লাসে প্রমোশন পেয়েছে। আদুভাইয়ের স্ত্রীর কাছে এটি খুব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো, কারণ ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে থাকা পরিবারে ঠিক ছিল না। স্ত্রীর চাপে এবার আদুভাইকে অবশ্যই প্রমোশন পেতে হবে। এজন্য তিনি অনেক উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইতে আসেন এবং শিক্ষক মহলে সুপারিশ করার জন্য অনুরোধ করেন। আদুভাই আগে কখনো কারো কাছে নম্বর বাড়ানোর জন্য যাননি, কিন্তু এবার তার বাধ্যতা ছিল। নিজের বয়স, স্বাস্থ্যের দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি প্রাণপণে প্রমোশন পাওয়ার চেষ্টা করেন। তার মনোযোগ ও চেষ্টা তীব্র হয়, কারণ এটা তার জন্য জীবনের এক বড় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় তিনি হতাশা ও কষ্টে ভুগতে থাকেন, যা তাকে প্রমোশন পাওয়ার জন্য মরিয়া করে তোলে। শেষ পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি প্রমোশন পান, কিন্তু সেই আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ তাকে মেলেনি। তাই বলা যায়, ছেলের প্রমোশন পাওয়ার খবর এবং স্ত্রীর চাপের কারণে আদুভাই প্রমোশন পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
প্রশ্ন ৩। ক. আদু মিয়ার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কীসের ব্যবস্থা করা হয়? | ৩ |
খ. ‘আদুভাই’ গল্পের মূলভাব আলোচনা কর। | ৭ |
ক) উত্তরঃ ‘আদুভাই’ গল্পে আদুভাইয়ের ছেলে তার বাবার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কবরে একটি বিশেষ খোদাই করায়। খোদাইয়ে লেখা ছিল, “Here sleeps Adu Mia who was promoted from Class VII to Class VIII।” এর অর্থ, এখানে শুয়ে আছেন আদুভাই, যিনি সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এটা তার জীবনের সংগ্রাম ও শেষ প্রমোশনের প্রতি সম্মানের চিহ্ন। আদুভাই দীর্ঘ সময় ক্লাস সেভেনে আটকে ছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রমোশন পেয়ে যান। তার শেষ ইচ্ছা ছিল প্রমোশন পাওয়ার পর ছোট একটি অনুষ্ঠান করা। যদিও প্রমোশন পাওয়ার আগেই তিনি মারা যান, তাঁর পরিবার ও বন্ধুরা তাঁর ইচ্ছা মেনে তাকে সম্মান জানায়। এই লেখাটি আদুভাইয়ের অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে খোদাই করা হয়।
খ) উত্তরঃ উপরে লেখা আছে।
Related Posts
- কত কাল ধরে গল্পের বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর (MCQ)
- রবীন্দ্রনাথ হায়াৎ মামুদ প্রশ্ন উত্তর ও বহুনির্বাচনি – ৮ম শ্রেণির বাংলা
- ডিজিটাল প্রযুক্তি ৮ম শ্রেণির ১ম অধ্যায় (শিখন অভিজ্ঞতা-১ এর সমাধান)
- ৭ম শ্রেণির বাংলা ৫ম অধ্যায় ৪র্থ পরিচ্ছেদ (বিশ্লেষণমূলক লেখা)
- ৭ম শ্রেণির গণিত ৩য় অধ্যায় সমাধান-ভগ্নাংশের গসাগু ও লসাগু