যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘অন্ধবধূ’ কবিতায় একজন অন্ধ যুবতী এবং তার সাথে কথোপকথনকারী ঠাকুরঝির মধ্যে সংলাপ ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির পরিবর্তন, অন্ধত্বের বেদনা এবং জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি এখানে প্রকাশ পেয়েছে। এই পোস্টে অন্ধবধূ কবিতার জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর লিখে দিলাম।
Table of Contents
অন্ধবধূ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
১। অন্ধবধু কবিতার রচয়িতা কে?
উত্তর: যতীন্দ্রমোহন বাগচী।
২। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর জন্ম কবে?
উত্তর: ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর।
৩। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর জন্মস্থান কোথায়?
উত্তর: নদীয়া জেলার জামশেদপুর গ্রামে।
৪। ‘বন্ধুর দান’ কী ধরনের রচনা?
উত্তর: একটি কবিতার সংকলন (কাব্যগ্রন্থ)।
৫। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর মৃত্যু কবে হয়?
উত্তর: ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে।
৬। অন্ধবধু কার মনের কথা প্রকাশ করে?
উত্তর: এক অন্ধ নববধূর মনের কথা।
৭। কবিতাটির প্রধান চরিত্র কে?
উত্তর: একজন অন্ধ বধূ
৮। কবিতায় কোন ঋতুর উল্লেখ আছে?
উত্তর: জ্যৈষ্ঠ
৯। কবিতায় কোন ফুলের উল্লেখ আছে?
উত্তর: ঝরা-বকুল
১০। কবিতায় কোন পাখির উল্লেখ আছে?
উত্তর: কোকিল
১১। কবিতায় কোন দিকের হাওয়ার উল্লেখ আছে?
উত্তর: দখিন হাওয়া
১২। অন্ধ বধূ কীসের উপর পা রাখে?
উত্তর: ঝরা-বকুল ফুলের উপর
১৩। বধূ বসে থাকে কোথায়?
উত্তর: দোরের পাশে
১৪। রাতে বধূর কী মনে হয়?
উত্তর: আকাশ-পাতাল ভাবনা আসে
১৫। জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে কতদিন বাকি?
উত্তর: কয়েকদিন
১৬। কবি আমের গায়ে কী দেখতে পান?
উত্তর: বরণ (পাকার লক্ষণ)
১৭। কোকিলের ডাক শুনতে কবে পাওয়া যায়?
উত্তর: অনেকদিন আগে
১৮। দখিন হাওয়া কখন বন্ধ হয়?
উত্তর: জ্যৈষ্ঠ মাসে
১৯। দীঘির ঘাটে কী হয়েছে?
উত্তর: নতুন সিঁড়ি জেগেছে
২০। শ্যাওলা পিছলে কী হতে পারে?
উত্তর: পা পিছলে জলে পড়ে যাওয়া
২১। অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব কী?
উত্তর: দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা
২২। বধূর কী নেই বলে কবি উল্লেখ করেন?
উত্তর: দুঃখ নেই
২৩। কে আগে বাঁচবে বলে উল্লেখ আছে?
উত্তর: দাদা
২৪। কোন মাসে আবার দাদার বিয়ে হবে?
উত্তর: আষাঢ় মাসে
২৫। বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে না পাওয়ার অর্থ কী?
উত্তর: নতুন জীবন শুরু করতে হবে
২৬। ‘চোখ গেল’ বলে কে চেঁচায়?
উত্তর: অন্ধ বধূ
২৭। চোখ হারানোর পর কী বারণ?
উত্তর: কাঁদার সুখ
২৮। কাঁদতে পারলে কী হতো?
উত্তর: বাঁচত
২৯। শোক কীভাবে কমত?
উত্তর: কাঁদলে
৩০। বধূ কোথায় ফিরে যাবে?
উত্তর: আবার বাড়ি
৩১। একলা থাকার স্থান কী?
উত্তর: গৃহকোণ
৩২। কবিতার শুরুতে কীসের উপর দিয়ে হাঁটছিল অন্ধ বধূ?
উত্তর: ঝরা বকুল ফুলের উপর দিয়ে।
৩৩। অন্ধবধু কীভাবে বোঝে যে সে বকুলের ওপর হাঁটছে?
উত্তর: পায়ের নিচে নরম ঠেকার অনুভূতি থেকে।
৩৪। অন্ধবধু ‘ঠাকুরঝি’ বলে কাকে সম্বোধন করেছে?
উত্তর: ননদকে। (অন্ধবধুর স্বামীর বোন)
৩৫। অন্ধবধুর দোরের পাশে বসে কী মনে হয়?
উত্তর: রাতের মধুময় সুবাসে আকাশ-পাতাল নিয়ে নানা কল্পনা করে।
৩৬। কবিতায় ‘মধুমদির বাসে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: রাতে বকুল ফুলের সৌরভে মাতাল পরিবেশ।
৩৭। কোকিলের ডাক শুনে অন্ধবধু কী ভেবেছিল?
উত্তর: জ্যৈষ্ঠ মাস চলে এসেছে।
৩৮। দীঘির ঘাটের নতুন সিঁড়ি দেখে অন্ধবধুর কেমন অনুভূতি হয়?
উত্তর: পিছলে পড়ে জলে তলিয়ে যাওয়ার ভয় হয়।
৩৯। অন্ধবধুর মৃত্যুভয় কেমন?
উত্তর: সে মনে করে, তলিয়ে গেলে তার দুঃখ শেষ হয়ে যাবে।
৪০। বিয়ের পর কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে অন্ধবধু?
উত্তর: নতুন বাড়ির পথ খুঁজে না পাওয়ার ভয়।
৪১। অন্ধবধুর মতে প্রবাস কীভাবে অনুভূত হয়?
উত্তর: একাকীত্বে কষ্ট দেয়।
৪২। অন্ধবধুর মতে, যারা চোখ হারিয়েছে তাদের ভরসা কী?
উত্তর: দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা।
৪৩। অন্ধবধুর দুঃখ কোথায়?
উত্তর: সে জানে, তার চোখ আর কখনো ফিরবে না।
৪৪। ‘কাঁদার সুখ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: দুঃখ প্রকাশ করতে পারার মানসিক আরাম।
৪৫। অন্ধবধু কেন কাঁদতে পারে না?
উত্তর: কারণ সে জানে, তার দৃষ্টিহীনতার কোনো প্রতিকার নেই।
৪৬। অন্ধবধুর মতে চক্ষুহীনদের দুঃখ কেমন?
উত্তর: তারা কোনো অভিযোগও করতে পারে না।
৪৭। কেউ অন্ধবধুকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে সে কী বলে?
উত্তর: ‘কিসের তাড়াতাড়ি! সেই তো ফিরে যাবো আবার বাড়ি।’
৪৮। ‘একলা-থাকা’ বলতে অন্ধবধু কী বোঝাতে চায়?
উত্তর: তার নিঃসঙ্গ জীবন।
৪৯। অন্ধবধুর একাকীত্ব কোথায় বেশি অনুভূত হয়?
উত্তর: নিজের ঘরে গৃহকোণে।
৫০। অন্ধবধু কোথায় শান্তি খোঁজে?
উত্তর: দীঘির শীতল জলে।
৫১। দীঘির জলকে অন্ধবধু কীভাবে বর্ণনা করে?
উত্তর: মায়ের স্নেহের মতো স্নিগ্ধ ও শান্ত।
৫২। দীঘির জলে কীসের পরশ পাওয়া যায়?
উত্তর: মায়ের স্নেহের পরশ।
৫৩। অন্ধবধুর মতে দীঘির জল কী ভুলিয়ে দেয়?
উত্তর: তার অন্তরের ব্যথা ও দুঃখ।
৫৪। অন্ধবধুর জীবন কীসে ভরা?
উত্তর: দুঃখ, নিঃসঙ্গতা ও অপূর্ণতায়।
৫৫। অন্ধবধু কীসের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে?
উত্তর: প্রকৃতির কোমল স্পর্শের প্রতি।
৫৬। অন্ধবধু দুঃখের কথা কার সঙ্গে ভাগ করে নেয়?
উত্তর: দীঘির শীতল জলের সঙ্গে।
৫৭। ‘পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো’ – এখানে ‘পরশ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: দীঘির শীতল জল।
৫৮। অন্ধবধুর জীবনে সবচেয়ে বড় বঞ্চনা কী?
উত্তর: দৃষ্টিশক্তির অভাব।
৫৯। অন্ধবধু প্রকৃতি থেকে কী পেতে চায়?
উত্তর: সান্ত্বনা ও মানসিক প্রশান্তি।
৬০। অন্ধবধু কোথায় মুক্তি খোঁজে?
উত্তর: প্রকৃতি ও জলের স্পর্শ
৬১। ‘ঠাকুরঝি’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ননদ, স্বামীর বোন, শ্বশুরকন্যা।
৬২। ‘মধুমদির বাসে’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: মধুর গল্পে মোহময় সুগন্ধে আচ্ছন্ন হওয়া।
৬৩। অন্ধবধূ কিসে সমৃদ্ধ?
উত্তর: অনুভব ও আত্মমর্যাদা বোধে।
৬৪। অন্ধবধূ কোথায় পড়ে গিয়ে ডুবে মরার কথা বলে?
উত্তর: দীঘির ঘাটে শেওলা পড়া পিছল সিঁড়িতে।
৬৫। ‘চোখ গেল’ কী?
উত্তর: একটি পাখির নাম, যার ডাক ‘চোখ গেল’ শব্দের মতো শোনায়।
৬৬। ‘কাঁদার সুখ’ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: কান্নার মাধ্যমে দুঃখ লাঘবের অভিজ্ঞতা বা অনুভব।
অন্ধবধূ কবিতার অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
১। “তবু সেই আঁখি দুটি জাগে সর্ব ঠাঁই”– ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: কবি এখানে একটি গভীর সত্য বলতে চেয়েছেন – আমাদের দেখার জন্য শুধু চোখই যথেষ্ট নয়। অন্ধ বধূর শারীরিক চোখ না থাকলেও তার হৃদয়ের চোখ সম্পূর্ণ খোলা। সে হৃদয় দিয়ে সবকিছু দেখে এবং বোঝে। যেমন আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি, তার চেয়েও বেশি স্পষ্টভাবে সে মানুষ ও প্রকৃতির সত্যতা উপলব্ধি করতে পারে। কবি বোঝাতে চেয়েছেন, প্রকৃত দর্শন হলো হৃদয় দিয়ে দেখা। এই বধূর অন্তর্দৃষ্টি এতই প্রখর যে তা ঘরের চারদেয়াল ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।
২। “তব ঘরে আলো নাই, তবু আলো করি” – ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: এই লাইনটি অন্ধ বধূর আশাবাদী মানসিকতাকে ফুটিয়ে তোলে। বাহ্যিকভাবে তার ঘরে কোনো প্রদীপ বা আলো নেই, কারণ সে আলো দেখতে পায় না। কিন্তু তার হাসি, ভালোবাসা, স্নেহ এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই তার ঘরকে আলোকিত করে রাখে। কবি এখানে দুটি বিষয় বলতে চেয়েছেন: প্রথমত, প্রকৃত আলো বাইরে থেকে আসে না, তা আমাদের ভেতর থেকেই জ্বলে; দ্বিতীয়ত, শারীরিক অন্ধত্ব কখনই মানসিক আলোকে নিভিয়ে দিতে পারে না। বধূর এই গুণই তাকে অন্যদের থেকে বিশেষ করে তোলে।
৩।”অলক্ষ্য সুতরী” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: “অলক্ষ্য সুতরী” হলো অন্ধ বধূর হৃদয়ের গোপন সঙ্গীত। যদিও সে কানে শুনতে পায় না, তবু তার মনে সবসময় এক ধরনের মধুর সুর বাজে। এই সুর তার আনন্দ, বেদনা, আশা-নিরাশার সমন্বয়ে তৈরি। কবি এখানে একটি সুন্দর রূপক ব্যবহার করেছেন – যেমন বীণায় সুর থাকে, তেমনি এই নারীর হৃদয়েও এক অদৃশ্য সুর প্রবাহিত হয়। এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে শিল্প ও সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য দৃষ্টিশক্তি অপরিহার্য নয়। হৃদয়ের কান দিয়েই প্রকৃত সঙ্গীত শোনা যায়।
৪। অন্ধ হয়েও কীভাবে বধূর “বিশ্বময় রঙে রঙে ভরা”?
উত্তর: এখানে কবি একটি অসাধারণ বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমরা সাধারণত মনে করি রঙ শুধু চোখ দিয়েই দেখা যায়। কিন্তু অন্ধ বধূ প্রমাণ করেন যে রঙ অনুভব করার আরও গভীর উপায় আছে। সে ফুলের স্পর্শ থেকে তার রঙ অনুমান করতে পারে, প্রকৃতির গন্ধ থেকে ঋতুর পরিবর্তন বুঝতে পারে, মানুষের কণ্ঠস্বর থেকে তাদের আবেগ অনুভব করতে পারে। এই সবকিছু মিলেই তার মনে এক অদ্ভুত রঙিন জগৎ তৈরি হয়। কবি বলতে চেয়েছেন, আমাদের চোখে যা দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি সত্যি হলো হৃদয় দিয়ে যা উপলব্ধি করা যায়।
৫। “তব স্নেহ-স্পর্শে শিশু হাসে খেলে যায়” – ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: এই চরণটি পড়লে যে কারো মনে হবে একজন আদর্শ মায়ের ছবি। অন্ধ বধূর স্পর্শে শিশুরা নিরাপদ বোধ করে, আনন্দ পায়। এটি তার অসাধারণ মানবিক গুণের প্রমাণ। সে দেখতে না পেলেও তার স্নেহশীলতা এতটাই প্রকৃত যে শিশুরা তা অবিলম্বে বুঝতে পারে। কবি এখানে দেখিয়েছেন যে মাতৃসুলভ স্নেহ কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতায় বাধা পায় না। বরং অনেক সময় শারীরিক অক্ষমতা মানুষকে আরও বেশি সংবেদনশীল করে তোলে। এই বধূর স্পর্শের মাধুর্য তার হৃদয়ের বিশালতারই পরিচয় দেয়।
৬। “মায়ের স্নেহের মতো” পরশ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: কবিতার শেষে এই উপমাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। অন্ধ বধূর স্পর্শকে মায়ের স্নেহের সাথে তুলনা করে কবি বলতে চেয়েছেন যে তার স্পর্শে একইরকম প্রশান্তি, নিরাপত্তা এবং মমতা রয়েছে। যেমন একটি শিশু মায়ের স্পর্শে সব ভয় ভুলে যায়, তেমনি বধূর স্পর্শও মানুষের মন থেকে দুঃখ দূর করতে পারে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে কবি একজন সাধারণ নারীকে মাতৃত্বের মহিমা দান করেছেন। এখানে বোঝানো হয়েছে যে মাতৃস্নেহ শুধু সন্তান জন্মদানকারী নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি সার্বজনীন মানবিক গুণ।
৭। “অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?” – এটি কীভাবে সমাজের ধারণাকে তুলে ধরে?
উত্তর: এই সরল প্রশ্নটি আসলে সমাজের একটি গভীর সমস্যার দিকে আঙুল তুলে ধরে। সাধারণত মানুষ মনে করে অন্ধত্ব মানেই জীবন শেষ, কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু অন্ধ বধূ এই ধারণাকে ভেঙে দেয়। তার এই প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ এবং জীবনকে পূর্ণভাবে বাঁচার দৃঢ় সংকল্প। কবি এখানে সমাজকে বলতে চেয়েছেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনই একজন মানুষের মূল্য বা সম্ভাবনাকে নির্ধারণ করতে পারে না।
৮। অন্ধবধূ কবিতা কীভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করে?
উত্তর: এই কবিতা আমাদের শেখায় যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি করুণা বা দয়া দেখানোর চেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া। অন্ধ বধূর চরিত্র আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মানুষ পূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। আমাদের উচিত তাদের সামর্থ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া। কবি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেখিয়েছেন যে একজন অন্ধ নারী কীভাবে তার সংবেদনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা এবং মানবিক গুণাবলীর মাধ্যমে অন্যদের হৃদয় জয় করতে পারে। এটি আমাদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৯। অন্ধবধূ কেন কোকিলের ডাক শুনে ঋতুর পরিবর্তনের কথা জানতে চায়?
উত্তর: অন্ধবধূ দেখতে পায় না, তাই সে প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো অন্য ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে। সে কোকিলের ডাক শুনে জানতে চায়, জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে আর কতদিন দেরি। সাধারণত বসন্ত ঋতুতে কোকিল ডাকতে শুরু করে, আর বসন্তের পরে আসে গ্রীষ্ম। অন্ধবধূ অনুভব করে, কোকিলের ডাক প্রকৃতির পরিবর্তনের একটি সংকেত। সে চায়, দৃষ্টিশক্তি হারালেও অন্তত তার অনুভূতি দিয়ে সে পরিবেশের পরিবর্তন বুঝতে পারুক। তাই কোকিলের ডাক শুনে সে জানতে চায়, গ্রীষ্মের প্রভাব প্রকৃতিতে কতটা পড়েছে, আমের গায়ে রং ধরেছে কি না।
১০। অন্ধবধূ কিভাবে অনুভবের মাধ্যমে প্রকৃতির পরিবর্তন বুঝতে পারে?
উত্তর: অন্ধবধূর দৃষ্টিশক্তি নেই, কিন্তু তার অন্যান্য ইন্দ্রিয় অত্যন্ত সক্রিয়। সে প্রকৃতির পরিবর্তন উপলব্ধি করতে শ্রবণশক্তি, স্পর্শ এবং ঘ্রাণশক্তির সাহায্য নেয়। ঝরা বকুল ফুলের নরম পরশ সে পায়ের নিচে অনুভব করে, যা তাকে বুঝতে সাহায্য করে যে সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। কোকিলের ডাক শুনে সে বসন্ত এবং গ্রীষ্মের পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চায়। বাতাসের উষ্ণতা পরিবর্তন হলে সে বুঝতে পারে গ্রীষ্ম আসছে। আবার দীঘির ঘাটে শ্যাওলা জমলে এবং সিঁড়ি পিছল হয়ে গেলে সে বুঝতে পারে বর্ষাকাল আসন্ন। তার কাছে প্রকৃতিকে বোঝার একমাত্র উপায় হলো অনুভব করা।
১১। কেন অন্ধবধূ মৃত্যুকে ভয় না?
উত্তর: অন্ধবধূ তার জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করেছে, কারণ সে দেখতে পায় না। তার অন্ধত্ব তাকে সবসময় দুর্বল এবং নির্ভরশীল করে রেখেছে। সে অনুভব করে, সমাজ তাকে বোঝা মনে করে এবং তার জীবনে আনন্দের চেয়ে কষ্টই বেশি। সে যখন দীঘির ঘাটের শ্যাওলাযুক্ত সিঁড়ির কথা বলে, তখন বুঝতে পারা যায় যে সে পিছলে পড়ে গেলে ডুবে যেতে পারে। কিন্তু এতে সে ভয় পায় না; বরং ভাবে, এতে তার অন্ধত্বের সমস্যা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে। তার জীবনে দুঃখ, একাকিত্ব এবং অবহেলার পরিমাণ এত বেশি যে কখনো কখনো সে মৃত্যুকেও স্বস্তির পথ মনে করে।
১২। সমাজ কিভাবে অন্ধবধূর প্রতি অবহেলা করে?
উত্তর: সমাজ সাধারণত শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রতি অবহেলা করে। অন্ধবধূর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। সে বুঝতে পারে, সমাজ তার মতো অন্ধ মানুষদের বোঝা মনে করে। সে বলে, তার স্বামী হয়তো তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে। এতে বোঝা যায়, নারীর দৃষ্টিশক্তিহীনতা তার দাম্পত্য জীবনের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয়। সমাজের চোখে অন্ধ নারী শুধু করুণার পাত্র। এই অবহেলা ও উপেক্ষা তাকে মানসিকভাবে কষ্ট দেয় এবং একাকিত্বের অনুভূতি আরও বাড়িয়ে তোলে।
১৩। অন্ধবধূ কাঁদতে না পারার দুঃখ প্রকাশ করে কেন?
উত্তর: কান্না মানুষের আবেগ প্রকাশের একটি স্বাভাবিক উপায়, যা দুঃখ-কষ্ট কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু অন্ধবধূ অনুভব করে যে তার দুঃখ এত গভীর যে সে কাঁদতেও পারে না। কান্নার মাধ্যমে মানুষ তার কষ্ট ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু তার সেই সুযোগ নেই। দৃষ্টিশক্তি না থাকার কারণে তার কষ্টের গভীরতা আরও বেশি, কারণ সে নিজের দুঃখের কথা কাউকে ঠিকভাবে বোঝাতেও পারে না। তাই সে মনে করে, কান্না তার দুঃখ লাঘব করতে পারত, কিন্তু সে কাঁদতে না পারায় তার শোক আরও ভারী হয়ে ওঠে।
১৪। অন্ধবধূ নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করে?
উত্তর: অন্ধবধূ জানে যে তার জীবন সহজ নয়, এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সে আশঙ্কা করে যে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাবে এবং অন্য কাউকে বিয়ে করবে। সে জানে, সমাজে অন্ধ নারীদের প্রতি সহানুভূতি কম এবং তারা প্রায়শই অবহেলিত হয়। যদি তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বে। তার নিজের কোনো উপার্জনের ক্ষমতা নেই, চলাফেরার জন্যও অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই ভবিষ্যতে সে কীভাবে জীবনযাপন করবে, তা নিয়ে সে উদ্বিগ্ন।
১৫। অন্ধবধূ কেন দীঘির জলে পা ডুবিয়ে রাখতে চায়?
উত্তর: অন্ধবধূর জন্য জল মানে শুধু শীতলতা নয়, বরং এটি তার মানসিক প্রশান্তির উৎস। সে মনে করে, দীঘির ঠান্ডা জল মায়ের স্নেহের মতো কোমল। তার জীবনে যে ভালোবাসা ও সহানুভূতির অভাব রয়েছে, তা এই শীতল জল কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে। যখন সে দীঘির জলে পা ডুবিয়ে রাখে, তখন সে নিজের কষ্ট কিছুটা ভুলে যায়। জল তাকে প্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত রাখে, যা তার মনে এক ধরনের স্বস্তি নিয়ে আসে। তাই সে দীঘির জলে পা রেখে তার দুঃখের কথা মনে করতে চায়।
১৬। সমাজের প্রতি অন্ধবধূর কি অভিযোগ ফুটে উঠেছে?
উত্তর: অন্ধবধূর দুঃখ-দুর্দশার পেছনে সমাজের অবহেলা ও নির্দয় আচরণ অনেকাংশে দায়ী। সে অনুভব করে, সমাজ অন্ধ মানুষদের বোঝা মনে করে এবং তাদের প্রতি প্রকৃত সহানুভূতি দেখায় না। তার স্বামীও হয়তো তাকে ছেড়ে চলে যাবে, যা সমাজের অসংবেদনশীলতার প্রমাণ। সে বারবার বলে, যদি সে দেখতে পেত, তাহলে হয়তো তার জীবন এত কষ্টের হত না। তার এই কথার মধ্য দিয়েই সমাজের প্রতি তার ক্ষোভ ও অভিযোগ প্রকাশ পায়।
১৭। অন্ধবধূ তার ননদের সঙ্গে আবেগভরা কথা বলে কেন?
উত্তর: অন্ধবধূ তার ননদকে খুব আপন মনে করে এবং তার সঙ্গে মনের কথা শেয়ার করতে স্বস্তি বোধ করে। সে জানে, তার জীবন কষ্টে পরিপূর্ণ, আর ভবিষ্যতেও হয়তো তাকে আরও বেশি দুঃখ সহ্য করতে হবে। সমাজ সাধারণত অন্ধ নারীদের অবহেলা করে। স্বামীর ভালোবাসা হারানোর ভয় তার মনে গভীর দুঃখের সৃষ্টি করেছে। তবে ননদই একমাত্র মানুষ, যার সঙ্গে সে তার কষ্টের কথা খুলে বলতে পারে। তাই সে তার মনের কষ্ট, একাকিত্ব ও দুঃখ ননদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়। তার ননদের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাসই তাকে আবেগভরা কথা বলতে বাধ্য করে।
১৮। কবিতায় অন্ধবধূর মনের গভীর যন্ত্রণা কিভাবে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর: অন্ধবধূর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই যন্ত্রণার, কারণ সে দৃষ্টিহীন। সে অনুভব করে, অন্ধত্ব তাকে শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও অসহায় করে তুলেছে। তার জীবন কষ্ট, অবহেলা, একাকিত্ব ও হতাশায় ভরা। সে জানে, সমাজ তাকে বোঝা মনে করে এবং তার প্রতি প্রকৃত সহানুভূতি খুব কম মানুষই দেখায়। সে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত, কারণ তার স্বামী হয়তো একদিন তাকে ছেড়ে চলে যাবে। এমনকি সে কাঁদতেও পারে না, যা তার দুঃখ আরও বাড়িয়ে দেয়। তার কষ্ট, হতাশা, একাকিত্ব এবং সমাজের অবহেলার বিরুদ্ধে তার নীরব অভিযোগই কবিতার মূল সুর হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুনঃ প্রাণ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও অনুধাবনমূলক প্রশ্ন উত্তর