কাকতাড়ুয়া গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

সত্যজিৎ রায়ের ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পটি একটি ভৌতিক আবহের মধ্যে দিয়ে মানুষের অপরাধবোধ, ভুল বিচার ও আত্মশুদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরেছে। লেখক মৃগাঙ্কবাবুর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। কখনো কারও ওপর অন্ধবিশ্বাসে (যেমন ওঝার চাল-পরীক্ষা) ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা কতটা অন্যায় হতে পারে। এই পোস্টে কাকতাড়ুয়া গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর লিকখে দিলাম।

কাকতাড়ুয়া গল্পের মূলভাব

‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পটি একজন বিখ্যাত লেখক মৃগাঙ্কশেখর মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে। একদিন তিনি দুর্গাপুর যাচ্ছিলেন, কিন্তু ট্রেনে টিকিট না পেয়ে গাড়িতে রওনা হন। ফেরার পথে গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে যায় এবং ড্রাইভার পেট্রোল আনতে যায়। মৃগাঙ্কবাবু নির্জন মাঠে একা গাড়িতে বসে থাকেন। চারপাশে কুয়াশা, ঠান্ডা আর ফাঁকা মাঠ—একটা কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে ছিল মাঠের মাঝে। হঠাৎ মনে হল কাকতাড়ুয়াটা নড়ছে! তারপর সে মানুষের গলায় বলে ওঠে—”বাবু, আমায় চিনতে পারছেন?” মৃগাঙ্কবাবু বুঝতে পারেন, এটা তাঁর পুরোনো চাকর অভিরামের গলা। অভিরাম একদিন সোনার ঘড়ি চুরির অভিযোগে বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সে আসলে নির্দোষ ছিল—ঘড়িটা আলমারির নিচে পড়ে ছিল, যা কেউ খুঁজে পায়নি। সেই কাকতাড়ুয়া অভিরামের আত্মা ছিল, যে নিজের নির্দোষত্ব প্রমাণ করতে এসেছিল। কথোপকথনের পরে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তখনই মৃগাঙ্কবাবুর ঘুম ভাঙে—তিনি বুঝতে পারেন এটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাড়ি ফিরে তিনি সত্যিই আলমারির নিচে সেই ঘড়ি খুঁজে পান। তিনি খুব অনুতপ্ত হন এবং প্রতিজ্ঞা করেন আর কখনো কুসংস্কারে বিশ্বাস করবেন না। এই গল্পটি আমাদের বলে, মানুষকে সন্দেহ করার আগে সত্যটা জানা জরুরি।

কাকতাড়ুয়া গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন

১। ক. মৃগাঙ্কবাবু কোথায় গিয়েছিলেন? গাড়ি মাঝপথে থেমে যাওয়ার কারণ কী? ব্যাখ্যা কর।
খ. কাকতাড়ুয়া তৈরির উপাদান ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর।

ক. উত্তরঃ মৃগাঙ্কবাবু দুর্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রথমে ট্রেন ধরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু টিকিট না পেয়ে গাড়িতে রওনা দেন। ফেরার পথে, পানাগড়ের কাছে হঠাৎ গাড়িটি থেমে যায়। কারণ ছিল, গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে গিয়েছিল। তখন ড্রাইভার সুধীর কাছের জায়গা পানাগড়ে পেট্রোল আনতে যায়। জায়গাটি মাত্র ৩ মাইল দূরে হলেও সুধীর ফিরতে ২-৩ ঘণ্টা সময় নেয়। তাই মৃগাঙ্কবাবুকে নির্জন মাঠে একা বসে থাকতে হয়। চারপাশে কুঁড়েঘর, তালগাছ আর একটা কাকতাড়ুয়া ছাড়া কিছু ছিল না। এই একাকীত্ব এবং ভয়ের পরিবেশ থেকেই গল্পের রহস্যময় ঘটনার শুরু হয়। পুরো ঘটনা একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে, যা গল্পটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

খ. উত্তরঃ কাকতাড়ুয়া হলো মাঠে বা খেতে পাখি ও অন্য প্রাণীদের তাড়ানোর জন্য তৈরি করা একটি মানবাকৃতির পুতুল। এটি সাধারণত বাঁশ, কাঠ, পুরনো কাপড়, খড় ইত্যাদি জিনিস দিয়ে বানানো হয়। প্রথমে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে একটি কাঁচামাটি মানবের আকার তৈরি করা হয়। তারপর তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে দূর থেকে দেখতে যেন আসল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে মুখের অংশে পুতি বা রং করে মুখাকৃতি দেওয়া হয়। অনেক সময় কাকতাড়ুয়ার মাথায় টুপি বা হ্যাটও পড়ানো হয়। কাকতাড়ুয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো পাখি ও অন্যান্য ক্ষতিকারক প্রাণীদের ফসল থেকে দূরে রাখা। পাখি যখন মাঠে আসে, তখন তারা মানুষ দেখার ভয়ে পালিয়ে যায়। এ কারণে কৃষকরা কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করে তাদের ফসল রক্ষা করেন। এতে ফসলের ক্ষতি কম হয় এবং ফলন ভালো হয়।

কিন্তু ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পে কাকতাড়ুয়ার অর্থ কিছুটা আলাদা। এখানে কাকতাড়ুয়া শুধু একটা পুতুল নয়, বরং এক নরকের কষ্ট সহ্য করা নির্দোষ মানুষের আত্মার প্রতীক।

২। ক. ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের শিক্ষণীয় দিকটি ব্যাখ্যা কর।
খ. গল্পে উল্লিখিত পরিবেশ, সময় ও আবহাওয়ার বর্ণনা দাও।

ক. উত্তরঃ ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্প থেকে আমরা শিখতে পারি, কোনো মানুষকে আগে বিচার না করে সঠিক প্রমাণ দেখা উচিত। অকারণে কাউকে দোষী করা ভুল এবং এটি একজন মানুষের জীবনে কত কষ্ট এবং অবিচারের কারণ হতে পারে। গল্পটি কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করে। ওঝা বা জাদুর ওপর ভরসা না করে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা ভালো। মিথ্যা অভিযোগ অনেক সময় নির্দোষ মানুষের জীবন ধ্বংস করে। তাই আমরা সব সময় শান্তির সঙ্গে সত্য খোঁজার চেষ্টা করব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুব জরুরি। এই গল্প আমাদের সতর্ক করে, মানুষকে বোঝার আগে তার কাহিনী শুনতে হবে। সত্য সামনে আসলে সঠিক বিচার হওয়া উচিত। এমন শিক্ষাই ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্প আমাদের দেয়।

খ. উত্তরঃ গল্পের পরিবেশ খুবই নির্জন এবং একাকী। মাঘ মাসের শীতকালে চারপাশে শুধু ফাঁকা মাঠ। মাঠের মধ্যে কয়েকটি ছোট কুঁড়েঘর দেখা যায় এবং দূরে তালগাছের সারি। এই মাঠগুলো খুবই খোলা এবং শান্ত, সেখানে মানুষজন খুব কম। এমন একটা জায়গায় একা থাকলে নিঃসঙ্গতা এবং কিছুটা ভয়ের ভাব সহজেই জন্ম নেয়। গল্পের সময় সন্ধ্যার দিকে, যখন সূর্য অস্তাচলে নামে, তখন ধীরে ধীরে চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে যায়। সন্ধ্যার ঠাণ্ডা বাতাস বইতে থাকে, আর চারপাশ নীরব হয়ে পড়ে। এই সময় মৃদু ঠাণ্ডা, স্নিগ্ধ বাতাস এবং নিস্তব্ধতা মিলে গল্পের আবহাওয়াকে রহস্যময় ও ভীতিকর করে তোলে। মৃগাঙ্কবাবু যখন নির্জন মাঠের মধ্যে গাড়িতে একা বসে থাকে, তখন চারদিকে শুধু অন্ধকার আর নীরবতা। মাঠের মাঝে থাকা কাকতাড়ুয়া, যা দেখতে মানুষের মতো, আরও ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। সন্ধ্যার অন্ধকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাকতাড়ুয়া যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে, গল্পের সময়, স্থান এবং আবহাওয়া একসঙ্গে মিলে এক অদ্ভুত একাকীত্ব ও ভয়ের অনুভূতি তৈরি করে।

৩। ক. চাকরি চলে যাওয়া অভিরামের জীবনে কীরূপ প্রভাব ফেলে? ব্যাখ্যা কর।
খ. ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

ক. উত্তরঃ অভিরামের চাকরি চলে যাওয়া তার জীবনে খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তিনি ২০ বছর মৃগাঙ্কবাবুর বাড়িতে চাকরি করেছিলেন, কিন্তু এক সোনার ঘড়ি চুরি হওয়ার কারণে তাকে সন্দেহ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। যদিও অভিরাম নিজেকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তবুও কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। চাকরিচ্যুত হওয়ার পরে তার মান-সম্মান নষ্ট হয় এবং সে মানসিকভাবে খুবই কষ্ট পায়। তার পরিবার ও সামাজিক অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। অভিরাম খুব কষ্টে মারা যায়, কিন্তু তার আত্মা শান্তি পায়নি কারণ সে নির্দোষ ছিল। এই ঘটনার কারণে তার জীবনের সুখ-শান্তি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

খ. উত্তরঃ নিচে কাকতাড়ুয়া’ গল্পের চরিত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলোঃ

১। মৃগাঙ্কশেখর মুখোপাধ্যায় — একজন পরিচিত লেখক। তিনি দুর্গাপুরে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। ট্রেনে টিকিট না পাওয়ায় তিনি মোটরগাড়িতে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু গাড়ি চলার সময় মাঝপথে পেট্রোল শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি একাকী নির্জন মাঠের মধ্যে অপেক্ষা করতে বাধ্য হন।
২। অভিরাম — মৃগাঙ্কবাবুর ঘর এবং অফিসের সাবেক চাকর। তিনি খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। কিন্তু একদিন মৃগাঙ্কবাবুর সোনার ঘড়ি চুরি হওয়ার কারণে ভুল বোঝাবুঝির কারণে অভিরামকে চোর সন্দেহ করা হয় এবং চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। অভিরাম নিজের নির্দোষতা অনেকবার দাবি করেও তাকে বিশ্বাস করা হয়নি।
৩। সুধীর — মৃগাঙ্কবাবুর ড্রাইভার। গাড়ি পেট্রোল ফুরিয়ে যাওয়ার পর তিনি দ্রুত পেট্রোল আনতে পাশের পানাগড় গ্রামের দিকে যান। সুধীরের কারণেই মৃগাঙ্কবাবুকে নির্জন মাঠে একা অপেক্ষা করতে হয়।
৪। কাকতাড়ুয়া — মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের আকৃতির একটি পুতুল। এটা সাধারণত মাঠে বা খেতে পাখি ও অন্য প্রাণীদের তাড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়। কিন্তু এই গল্পে কাকতাড়ুয়া কেবল পুতুল নয়, এটি অভিরামের আত্মার প্রতীক।

৪। ক. “কিন্তু তাতে তাঁর মজ্জাগত দোষগুলোর কোনো সংস্কার হয়নি।”- কথাটি বুঝিয়ে লেখ।
খ. “কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস কখনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না।”- ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের আলোকে কথাটির সত্যতা যাচাই কর।

ক. উত্তরঃ “কিন্তু তাতে তাঁর মজ্জাগত দোষগুলোর কোনো সংস্কার হয়নি” মানে হলো, মৃগাঙ্কবাবু যেই ভুল করেছিল, সেটা শুধরে নেওয়ার বা নিজের মনোভাব পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা করেনি। তিনি অভিরামের প্রতি ভুল ধারণা থেকে বের হতে পারেননি। মানে তার ভিতরে এমন কিছু গুণ বা অভ্যাস ছিল যা বদলায়নি। সে এখনও অন্যায় বিশ্বাস বা কুসংস্কারের প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি। নিজের ভুল বুঝলেও সে মন থেকে সঠিকভাবে বদলায়নি। তাই তার মজ্জাগত অর্থ হলো গভীর বা প্রকৃত দোষ। এই দোষগুলো সংস্কার না হওয়ায় তিনি আবারও ভুল করতে পারেন। এটা বোঝায়, ভুল শুধরানো মানেই সব সময় মনোভাব বদলানো নয়। মৃগাঙ্কবাবু এরকমই একজন মানুষ ছিলেন। তাই এই বাক্যটি তার চরিত্রের গভীর দুর্বলতা বোঝায়।

খ. উত্তরঃ “কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস কখনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না” কথাটি ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্পের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পে দেখা যায়, মৃগাঙ্কবাবুর বাবা ওঝার সাহায্যে অভিরামকে ভুলভাবে দোষী সাব্যস্ত করেন। তারা কোনো সত্য বা প্রমাণ না দেখে কুসংস্কারের ওপর বিশ্বাস করেই সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে অভিরাম একজন নির্দোষ মানুষ হলেও তার জীবন নষ্ট হয়, চাকরি চলে যায় এবং সে অকারণে কষ্ট ভোগ করে। পরে যখন সত্য জানা যায়, তখন বুঝতে পারেন এই কুসংস্কারই ভুলের কারণ ছিল। তাই কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস করলে মানুষ অনেক সময় অন্যায়ের শিকার হয় এবং সমাজে অবিশ্বাস ও বিভ্রান্তি বাড়ে। সুতরাং কুসংস্কার কখনো ভালো ফল আনে না, বরং মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। ‘কাকতাড়ুয়া’ গল্প আমাদের শেখায়, যুক্তি ও প্রমাণ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। বাস্তব ও বুদ্ধির ওপর বিশ্বাস রাখা উচিত, কারণ কুসংস্কার থেকে কোনো ভালো ফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা সবসময় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং সত্যকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ নয়া পত্তন গল্পের মূলভাব ও বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর

Related Posts

Leave a Comment