“ঋতু বর্ণন” কবিতায় ছয়টি ঋতুর প্রতিটি দৃশ্যের পৃথক বৈশিষ্ট্য আলাওল তার কবিতায় নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। বসন্তের মধুরতা, গ্রীষ্মের তাপ, বর্ষার প্রশান্তি, শরতের নির্মলতা, হেমন্তের ফসলের সুখ, আর শীতের শান্ত প্রকৃতি—সব কিছুরই সুনিপুণ চিত্রায়ণ দেখা যায়। এই পোস্টে ঋতু বর্ণন কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর লিখে দিলাম।
ঋতু বর্ণন কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর
১। “নবীন খঞ্জন দেখি বড়হি কৌতুক” চরণটি—ব্যাখ্যা কর।
এই চরণে শরৎ ঋতুর আনন্দময় পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। “নবীন খঞ্জন” বলতে খঞ্জন পাখির চঞ্চল নৃত্য বোঝানো হয়েছে। শরতের নির্মল আকাশে খঞ্জন পাখির নাচ দেখে মানুষের মনে আনন্দের সৃষ্টি হয়। এটি প্রকৃতির সেই স্বচ্ছ, নির্মল রূপের ইঙ্গিত দেয়, যা শরৎ ঋতুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
২। আলাওল বসন্ত ঋতুকে কীভাবে বর্ণনা করেছেন?
আলাওল বসন্ত ঋতুর রূপ বর্ণনা করেছেন এক মুগ্ধকর আবহে। তিনি বসন্তের আগমনে প্রকৃতির নবজীবন লাভের চিত্র এঁকেছেন। বসন্তে চারদিক সেজে ওঠে নবীন পল্লবে, আর মলয়া সমীর দখিনা বাতাস হয়ে প্রেমের বার্তা বয়ে আনে। এই সময় গাছে গাছে ফুল ফোটে। ভ্রমরের গুঞ্জন, কোকিলের মিষ্টি ডাক মনে প্রেমের স্পন্দন জাগে। বসন্ত যেন প্রকৃতি এবং প্রেমের এক অনন্য সম্মিলন।
৩। “মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি” চরণটি ব্যাখ্যা কর।
এই চরণে কবি আলাওল বসন্ত ঋতুর দখিনা বাতাসের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন। “মলয়া সমীর” মানে হলো স্নিগ্ধ দখিনা বাতাস, যা বসন্তে প্রবাহিত হয়। আর “কামের পদাতি” বলতে কামদেবের দূত বা সহচরকে বোঝানো হয়েছে। এই বাতাস প্রেমের বার্তা বহন করে প্রেমিক-প্রেমিকার মনে আবেগের সঞ্চার ঘটায়। বসন্তের এই বাতাস যেন প্রকৃতিকে প্রেমময় এবং সজীব করে তোলে।
৪। কবি কীভাবে গ্রীষ্ম ঋতুর বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন ?
গ্রীষ্ম ঋতুকে আলাওল চিত্রিত করেছেন প্রচণ্ড তাপ এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ক্লান্তির মাধ্যমে। সূর্যের তীব্র রৌদ্রের কারণে মানুষ ছায়ার আশ্রয় খোঁজে। চারদিকে এক রকমের রুক্ষতা বিরাজ করে। তবে এই কঠিন সময়েও প্রকৃতিতে কিছুটা প্রশান্তি এনে দেয় মলয়া বাতাস আর চন্দনের শীতল সুবাস। গ্রীষ্মের রুক্ষতা প্রকৃতিকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনই মানুষের মনের গভীরেও ছোঁয়া লাগে।
৫। আলাওল কীভাবে বর্ষাকালের বর্ণনা দিয়েছেন ?
বর্ষাকালকে আলাওল বর্ণনা করেছেন মেঘের গর্জন, প্রবল বৃষ্টি এবং জলমগ্ন প্রকৃতির মধ্য দিয়ে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়ে, আর বজ্রের শব্দ কৈলাস পাহাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলে। অবিরাম বৃষ্টির ধারা প্রকৃতিকে সজীব করে তোলে। দাদুরী (মাদি ব্যাঙ) আর শিখিনী (ময়ূরী) যেন আনন্দে ডাকতে থাকে। বর্ষার জলে স্নাত প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়।
৬। “মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি”— ব্যাখ্যা কর।
এই চরণে কবি বসন্ত ঋতুতে বনস্পতি গাছের ফুল ফোটার দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। “মুকুলিত” মানে কুঁড়ি ধরা, আর “বনস্পতি” বলতে বোঝানো হয়েছে সেইসব বৃক্ষকে যেগুলোতে সাধারণত ফুল ধরে না, কিন্তু বসন্তে তাদের নতুন কুঁড়ি ও পাতা নিয়ে সেজে ওঠে। বসন্তের ছোঁয়ায় এই গাছগুলো নতুন প্রাণ পায়। প্রকৃতির এই নবজাগরণ বসন্তের মাধুর্যকে ফুটিয়ে তোলে।
৭। কবির বর্ণনায় শরৎ ঋতুতে প্রকৃতি কীভাবে পরিবর্তন হয়?
আলাওল শরৎ ঋতুকে তুলে ধরেছেন নির্মল আকাশ আর স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাধ্যমে। বর্ষার ভারী বৃষ্টির পর আকাশ যেন পরিষ্কার হয়ে ওঠে, আর মৃদু বাতাসে ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শরতের ফুলের পাপড়ি যেন চামরের মতো দোল খায়। এই সময় খঞ্জন পাখির চঞ্চল নাচ প্রকৃতিতে প্রাণচাঞ্চল্য এনে দেয়। দম্পতিরা শরতের এই স্নিগ্ধতায় খুঁজে পান এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি।
৮। “কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল” চরণটি কী নির্দেশ করে?
এই চরণে কবি বসন্ত ঋতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য কিংশুক বা পলাশ ফুলের কথা বলেছেন। বসন্তে যখন পলাশ ফুল ফোটে, তখন গাছে গাছে লাল ফুলের সমারোহ দেখা যায়। এই ফুলের কারণে গোটা বন যেন লাল রঙে রাঙিয়ে ওঠে। প্রকৃতির এই রঙিন রূপ বসন্তের প্রাণময়তা এবং উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করে।
৯। ঋতু বর্ণন কবিতার হেমন্ত ঋতুর প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
হেমন্ত ঋতুতে শীতের আগমনী বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে তখন এক রকমের নীরব শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। আলাওল এই ঋতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন তাম্বুল বা পানের সুখ। এই সময় পুষ্পের কোমলতা এবং তাম্বুলের স্বাদ মানুষকে আনন্দ দেয়। শীতের ভয়ে সূর্য দ্রুত অস্ত যায়, আর রাত দীর্ঘ হয়। দম্পতিরা এই দীর্ঘ রাতে উষ্ণতার খোঁজে একে অপরের সান্নিধ্যে আসে।
১০। “ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব”— ব্যাখ্যা কর।
এই চরণে বসন্তের সঙ্গীতময় পরিবেশের বর্ণনা করা হয়েছে। বসন্তের সময় ভ্রমরের গুঞ্জন আর কোকিলের মধুর কুহুতানে প্রকৃতি মুখরিত হয়ে ওঠে। এই সুরেলা শব্দগুলো প্রেমময় আবহ সৃষ্টি করে। এমন পরিবেশে যুবক-যুবতীর মনে ভালোবাসার অনুভূতি জেগে ওঠে। বসন্ত যেন প্রকৃতিকে এক আনন্দময় সুরের জগতে পরিণত করে।
১১। শীত ঋতুতে দম্পতিদের অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ পায়?
শীত ঋতুতে প্রকৃতি হয়ে ওঠে কঠোর এবং কনকনে। সূর্য যেন শীতের ত্রাসে তাড়াতাড়ি ডুবে যায়। দীর্ঘ রাতের আবেশে দম্পতিরা নিজেদের ভালোবাসার উষ্ণতায় মগ্ন থাকে। চন্দন, কাফুর, কস্তুরী এবং সুগন্ধি চুয়ার সুবাস দম্পতির আবেগকে আরও তীব্র করে তোলে। তারা বিচিত্র বসনের উষ্ণতায় শীতের কামড়কে ভুলে থাকে।
১২। “পুষ্প তুল্য তাম্বুল অধিক সুখ হয়” — কী বোঝানো হয়েছে?
এই চরণে হেমন্ত ঋতুর সৌন্দর্য এবং স্বস্তি তুলে ধরা হয়েছে। “তাম্বুল” বলতে পান বোঝানো হয়েছে, যা হেমন্তের সময় মানুষকে বিশেষ আনন্দ দেয়। পুষ্পের মতো নরম তাম্বুলের স্বাদ হেমন্তের শীতলতায় মানুষকে আরাম দেয়। এটি হেমন্ত ঋতুর আরামদায়ক এবং মনোরম পরিবেশের প্রকাশ।
১৩। বসন্ত ঋতুতে কামদেব কী ভূমিকা পালন করেন?
বসন্তের এই প্রেমময় আবহে কামদেবের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। কবি আলাওল বলেছেন, মলয়া বাতাস কামদেবের দূতের মতো কাজ করে। এই সময় ফুলের সুবাস, কোকিলের ডাক আর ভ্রমরের গুঞ্জনে প্রেমের আবেশ তৈরি হয়। যুবক-যুবতীর মন প্রেমে ভরে ওঠে। প্রকৃতি যেন নিজেই প্রেমের মূর্তি ধারণ করে।
১৪। “শীতের তরাসে রবি তুরিতে লুকাএ” চরণে কী চিত্র ফুটে উঠেছে?
এই চরণে শীত ঋতুর তীব্রতা বর্ণনা করা হয়েছে। “রবি” বলতে সূর্যকে বোঝানো হয়েছে, আর “তুরিতে লুকাএ” মানে দ্রুত লুকিয়ে পড়া। শীতের সময় সূর্যের আলো তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়, আর ঠাণ্ডা বেড়ে যায়। প্রকৃতি যেন দ্রুত সন্ধ্যায় ঢেকে যায়। এটি শীতের সেই কঠিন, কনকনে পরিবেশের ইঙ্গিত দেয়।
১৫। বর্ষার মল্লার রাগ কীভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে?
বর্ষাকালে মল্লার রাগের সুর যেন প্রকৃতির নিজস্ব সঙ্গীতে রূপ নেয়। মেঘের গর্জন আর বজ্রের শব্দের সঙ্গে এই রাগ যেন মিলে যায়। আলাওল উল্লেখ করেছেন, কৈলাস পাহাড়ে মল্লার রাগের সুর ঘন ঘন বেজে ওঠে। এই সময় দাদুরী আর শিখিনী ডাকতে থাকে। মল্লার রাগের এই গম্ভীর সুর একদিকে প্রকৃতিকে সজীব করে তোলে।
১৬।ঋতু বর্ণন কবিতায় খঞ্জন পাখির বিশেষত্ব কী?
শরৎ ঋতুর বর্ণনায় খঞ্জন পাখির চঞ্চলতা এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে এসেছে। কবি বলেছেন, খঞ্জন পাখির নাচ দেখে মানুষের মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। নবীন খঞ্জনের এই চঞ্চলতা শরতের নির্মল প্রকৃতিকে আরও সুন্দর করে তোলে। এই পাখির চঞ্চলতা যেন দম্পতিদের মনে এক অনাবিল কৌতুক এবং ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
১৭। “রৌদ্র ত্রাসে রহে ছায়া চরণে সরণ” চরণটি কী বোঝায়?
এই চরণে কবি গ্রীষ্মের তীব্র রৌদ্রের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। প্রচণ্ড গরমে মানুষ এবং প্রাণীকুল ছায়ার আশ্রয় খোঁজে। “রৌদ্র ত্রাসে” মানে রৌদ্রের ভয়ে, আর “ছায়া চরণে সরণ” বলতে ছায়ার আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গ্রীষ্মের এই তাপ প্রকৃতি এবং মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। এ সময় ছায়াই যেন স্বস্তির একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠে।
১৮। “ঘোর শব্দে কৈলাসে মল্লার রাগ গাত্র” চরণে কী দৃশ্য ফুটে উঠেছে?
এই চরণে বর্ষাকালের বজ্রধ্বনির বর্ণনা করা হয়েছে। “কৈলাসে” বলতে শিবের বাসস্থান কৈলাস পর্বতকে বোঝানো হয়েছে। বর্ষার সময় মেঘের গম্ভীর গর্জন যেন কৈলাসকেও কাঁপিয়ে দেয়। এই গর্জনকে কবি “মল্লার রাগ” এর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা বর্ষার আবহ তৈরি করে। এটি বর্ষার তীব্রতা এবং প্রকৃতির ভয়ংকর রূপকে প্রকাশ করে।
আরও পড়ুনঃ ঋতু বর্ণন কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন উত্তর
Related Posts
- বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ কবিতার মূলভাব – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- ঐকতান কবিতার প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা – একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর
- রেইনকোট গল্পের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন উত্তর (সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন)- একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা
- জীবন ও বৃক্ষ জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও উত্তর